ভোতা ব্যাথাটা এখনো আছে। কেমন যেনো এক জায়গায় উতপত্তি হয়ে মাথার সবযায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে সমান যন্ত্রণা নিয়ে। এমন অবস্থায় সুতীক্ষ্ণ একটা শব্দ এসে তীর্যক ভাবে আঘাত করছে প্রতিটি নিউরনে। নাড়িয়ে দিচ্ছে অনুভুতি। এরকম মুহুর্তে শ্রবনশক্তি থাকাটাও পাপ মনে হয়। হাতে যদি একটা দূরনিয়ন্ত্রক থাকতো তবে শব্দহীন করে দিতাম অদূরেই অবস্থিত তারস্বরে চেচিয়ে যাওয়া মুঠোফোনটিকে। কোমলতাহীন শব্দ তাও এত উচ্চস্বরে কেউ ব্যবহার করতে পারে আমার জানা ছিলোনা। হয়তো তার কাছে শব্দটা কোমল কোনো সংগীতের মতনি। আমার কাছে ভয়াবহ রাত্রির দুঃস্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে। ইশ! থাকতো যদি একটা দূরনিয়ন্ত্রক। ইচ্ছামত কমিয়ে বাড়িয়ে দিতাম শব্দ নামক কম্পনের তীব্রতা। মধুর সঙ্গীতকে আপন করতাম, থামিয়ে দিতাম অযাচিত কম্পনের বাহুল্য। এই মুহুর্তে উচ্চকিত মুঠোফোনটা ছাড়াও আর কি কি থামিয়ে দেওয়া যায়!! হ্যা, পেয়েছি। ঐতো উচ্চস্বরে কন্ঠনালি ফাটিয়ে চিৎকার করছে বিরক্ত উদ্রেককারী পথশিশু, তার সৃষ্ট কম্পন থামিয়ে দিলে কেমন হবে।নাহ! বিষাদ লাগছে অপুষ্ট শিশুটির শব্দহীন জগতকে। সেখানে ভনিতা নেই, তার চোখে মুখে অপ্রাপ্তির সত্যিকার ছায়া পড়েছে তার চেয়ে বরং শব্দময় জগতটায় ভালো ছিলো। তার সৃষ্ট শব্দের জন্য তিরস্কার করা যেত, বিরক্তি প্রকাশ করা যেত এখন মায়াময়তা ঘিরে ধরছে। ওর চেয়ে বরং থামিয়ে দেওয়া যেতে পারে রাস্তায় চলাচলরত যানের শব্দগুলোকে। আহ! সত্যি দারুণ হতো তাহলে। কি ছিমছাম জগত। শব্দহীন কম্পনহীন জগত। প্রয়োজনের তাগিদেই চলবে, তাড়া নাই কারো সে জগতে। একে অন্যের শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে পথ চলার আনন্দ সবার চোখেমুখে। কিংবা হাত পা ছুড়ে তীব্র স্বরে প্রতিপক্ষকে গালাগালরত নীতিনির্ধারক হতে চাওয়া ব্যক্তিটির সৃষ্ট কম্পঙ্ক কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হা হা হা, অদ্ভুত হাস্যকর লাগছে শব্দহীনতায় ব্যক্তিটিকে। একজন ভাড় যেন পৃথিবীর আদি অকৃত্তিম সমস্ত কৌতুক একে একে পরিবেশন করছে অদ্ভুত অভিনয়ের ভঙ্গিমায়। কি হাস্যকর! চোখেমুখে বিরক্তি এবং লোভ খেলা করছে।
- তুমি হাসছো কেনো?
ধ্যান ভাঙ্গলো একটি শিশুর জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে।
এর প্রতিউত্তর সাথে সাথে দেওয়াটা দুস্কর। একজন মধ্যবয়সি লোক অতিপ্রয়োজনীয় নীতিনির্ধারনি সভার অদুরে দাঁড়িয়ে হাসছে, সেটা ব্যখ্যা করা সহজ হতো যদি সত্যিই এটা একটা অভিনিত মঞ্চ হতো। আবার জিজ্ঞাসু চোখকে ফাঁকি দিয়ে সটকে পড়ার উপায় ও নেই কারন সে পালিয়ে যাওয়ার পথের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মিথ্যাও বলা যাবে না। কারন শিশুদের মাঝে ভণিতা নেই বলেই তারা সত্য এবং মিথ্যাকে খুব সহজেই আলাদা করতে পারে। তাদের জগতটা সত্যের সেখানে মিথ্যার প্রয়োজনীয়তা বাহুল্য বৈ কিছুই নয়। তাই তাকে সত্য বলতেই প্রস্তুত হলাম যদিও ভয় ছিলো সে সেটা বুঝতে পারবে কিনা। বললাম,
- বক্তৃতা প্রদানকারীকে লক্ষ্য করো শব্দ ছাড়া! তাহলে বুঝবে আমি কেনো হাসছি।
শিশুটি বিস্ময়মাখা চোখ দেখে ভয় পাই সে আমাকে মস্তিস্কবিকৃতদের দলে ফেলে কিনা তাই ভেবে। কিন্তু কিছুক্ষন সে সভা অবলোকন করে হাসিতে ফেটে পড়ে। আশেপাশে উপস্থিত তার বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরে কারন অনুসন্ধানে। হাসির মাত্রা বেড়ে যায়। এবার আমি সটকে পড়ি কারন আমি জানি হাসি সংক্রামক। উপস্থিত জনতার মাঝে ভাড়ের সত্যিকার গুনগ্রাহি কেউ থাকতেই পারে সে বা তারা শিশুদের কিছু না বললেও হাসির যোগানদাতা আমাকে ছেড়ে দেবে সেটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
একটু নিরিবিলিতে চলে আসি। শব্দহীন জগত সৃষ্টি করাটা খুব অসম্ভব কিছুনা। তার প্রমাণ আমি কিছুক্ষন আগেই পেয়ে গেছি। এখনো মনে হচ্ছে আমি সেই জগতে আছি, সেটা আমার অবস্থান নিরিবিলি স্থানে হওয়ার জন্য হলেও হতে পারে। একঝলক ঠান্ডা বাতাস আমাকে জড়িয়ে চলে গেলো। কিন্তু আমি তার আগমনী শব্দ শুনতে পাইনি। এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম সত্যি কি আমি শ্রবনশক্তি হারিয়ে ফেলেছি!! মধুর সঙ্গীতের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলেও খুব একটা দুঃখিত হয়নি এই ভেবে যে আমার শ্রবন যন্ত্রের কাছে সবসময় মধুময় কথা বলার লোক নেই বললেই চলে। ওর থেকে শ্রবনহীন থাকাই ভালো। অনুভুতিটা তীব্র হবে।
সূর্যালোকে চোখটা জ্বলছে হঠাৎ করেই। এখন আমার চোখহীন জগত অনুভব করতে ইচ্ছে করছে প্রচন্ড!