তীব্র অভিমান নিয়ে বসে আছি প্রিয় নদীটির পাড়ে। ডাকবাংলোর বারান্দায়। যা নদীটির পাশেই মৌনতা নিয়ে অবস্থান করছে যুগযুগ ধরে। রাত্রীর গভীরতার সাথে সাথে আমার অভিমানের তীব্রতা বাড়ছে। আজ আব্বু ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন, নাহয় পড়তে বসলে ঘুম চলে আসে তাই বলে এত রাগ কেনো করবেন। আমি নাকি সারাদিন ক্রিকেট খেলে বেড়ায়, পড়ায় মন নেই। ভাবছি আর কান্না দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে আসেছে। আর বাড়ি ফিরবো না ভাবছি, সকাল হলেই বাস ধরবো যেদিকে দুচোখ যাই চলে যাব। দরকার হলে মুটেগিরি করবো খাবার যোগানোর জন্য। নাহয় কষ্ট হবে, তাই বলে অপমান করবে না কেউ। আব্বু প্রতিদিনি এমন করে। অভিমানি রাতে যেনো শুধু কষ্টের কথাগুলোয় বারবার চোখে ভেসে উঠে।
ডাকবাংলোটা একটু নিরিবিলিতে। বলা যায় প্রায় পরিত্যাক্ত, আমার যে ভয় করছিলো না তা নয়, তবে সেটা আমার অভিমানের কাছে অতি ক্ষুদ্র। এসব ভাবতে ভাবতে আর সৌম্য নদীটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমে ঢুলুনি চলে এসেছিলো বুঝতে পারিনি। হটাৎ করেই তাকিয়ে দেখিয়ে এক বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, "বাবা, এখানে তুমি কি করো?" আমার অভিমানের তীব্রতার রেশ তখনো কাটেনি তাই উত্তর দেওয়ার বা ভয় পাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি বরঞ্চ উনাকে অবাঞ্চিত মনে হয়েছে। তবে উনি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন। "ওহ বুঝেছি বাসা থেকে পালিয়েছো বুঝি! আমার ছেলেটাও পালিয়েছিলো, কতইবা বয়স হবে তখন। এস এস সি দিবে। কত অনুরোধ করলাম শুনলোনা, তারপর রেগে গিয়ে থাপ্পড় মারলাম। সেই রাতেই ও পালিয়ে গেলো।" সগোক্তির মত বলে যাওয়া কথা এই পর্যন্ত থামলে আমি কিছুটা উৎসাহিত হলাম আবার মনে মনে ভাবলাম ঠিকিতো আছে। পালানোই ভালো।
"প্রতিদিন অপেক্ষা করি। ওর অভিমান ভাঙ্গলে চলে আসবে ভেবে। অভিমান ভাঙ্গেনা। দরজায় কান পেতে থাকতাম, যেকোনো শব্দ হলেই ছুটে যেতাম। আশাহত হতে হত অনাহুত দেখে দেখে। সেইদিন হালকা বৃষ্টি পড়ছিলো, ধুমধাম করে শব্দ পেয়ে মেয়েটা দরজা খুলতেই একদল আর্মি সেইসাথে পাড়ার রমজান ঢুকে পড়লো। অকথ্য গালাগালি, আর ঘরময় উলটপালটের পর ওরা ধরে নিয়ে গেলো আমার মেয়েটিকে শাস্তিস্বরুপ। আমি পায়ে পড়েছিলাম আমার চেয়েও বয়সে ছোট রমজানের, কাজ হয়নি। আমার সন্তান নাকি দেশদ্রোহী হয়ে গেছে তাই এ শাস্তি। আমি বললাম আপনাদের ভুল হচ্ছে এতটুকুন ছেলে দেশদ্রোহী হয় কিভাবে!! শুনলো না হায়েনারা, দেশদ্রোহী ছেলেটার জন্য আমার মেয়েকে সম্ভ্রম এবং জীবন দিতে হলো। তারপরো ওরা ক্ষান্ত হয়নি, তাকে ট্রাকের পিছনে বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়েছিল। দেশদ্রোহী ভাইয়ের শাস্তিস্বরুপ। চলার সময় তুমি রাস্তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, দেখবে আমার সোনামনির রক্ত লেগে আছে। ওর লাল রক্তই আস্তে আস্তে কালো পিচ হয়ে আছে তোমাদের চলার পথে। আমি ঐদিন পাগল হয়ে বলেছিলাম এমন ছেলে চাই না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার কথা শুনেছিলেন, তাই কিছুদিন পর খবর পেলাম ক্যাম্পে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। পাগলের মত ছুটে এসেছিলাম এখানে, এখানেই ক্যাম্পটা ছিলো। রমজানের পায়ে পড়লাম আবার, পায়ে পড়লাম সব আর্মি অফিসারের। ওরা আমাকে মারলো, জানো ওদের লাথি আমার এতটুকুও লাগেনি!! বারবার তৃষ্ণা নিয়ে ওদের পায়ে ধরেছি মানিককে একনজর দেখার জন্য। দেয়নি, বরং আমাকেই আটকে রেখে নির্যাতন করেছে প্রতিদিন, হাসি ঠাট্টা করেছে প্রতিনিয়ত। আমাকে বলতো "তোমার ছেলেকে দেখবা?",আমি পাগলের মত ওদের কাছে অনুনয় করতাম সেটা ছিলো ওদের বিনোদনের খোরাক। এমন করে দুঃসহ এক একটা দিন পার করতাম, তবুও অপেক্ষা করতাম আমার মানিকের জন্য। নাহ! অভিমানি ছেলেটা আর ফেরেনি, ওর বন্ধুরা ফিরে আসলো, জব্বার ফিরে আসলো, পুবপাড়ার রফিক ফিরে আসলো। ও শুধু অভিমান নিয়ে দূরে থাকলো। তারপরো আমার সবসময় মনে হয়েছে ও একদিন ফিরে আসবেই। বাবার উপর কি ছেলে রাগ করে থাকতে পারে? পারেনা।"
একটু থেমে কথাগুলো যোগ করলেন বৃদ্ধটা। "বাবা, রাগ করে থেকোনা বাসায় চলে যাও সকাল হয়ে আসছে " বলে বৃদ্ধটা আস্তে আস্তে চলে গেলেন ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারের ঘরের দিকে। তারপাশে রয়েছে একটি কুয়া, যেখানে ৭১ এ পাক আর্মিরা মানুষকে মেরে ফেলে রাখতো। রাতের অভিমানে যা ভুলে গিয়েছিলাম।
পূবের আকাশ রাঙ্গা হয়ে উঠেছে। কখন আমি আমাদের আঙ্গিনায় আব্বুর মুখোমুখি নতমুখে এসে দাঁড়িয়েছি বুঝিনি। দুজনেই কিছু বলছিনা, আমি আব্বুর চোখের দিকে তাকাতে সাহস ও পাচ্ছিনা। কারন আমি জানি ওখানেও আমার মত চোখের জল সকালের আলোয় চিকচিক করছে।