জাহাজ চলার মত জোয়ার আসলো রাত ৯ টায়। আমরা রওয়ানা হলাম কটকার পথে। ২/৩টি জাহাজের বাতি দেখে আস্তে আস্তে আগাচ্ছি। জাহাজের বাতি দেখা যায় কী যায় না। চারদিকে ভয়ানক কুয়াশা। জাহাজের ব্রিজে আমি, বন্ধু রাশেদ আর আমাদের গাইড মোতাহার। জাহাজের ডাইন আর বাম থেকে আওয়াজ আসছে- এব বাঁও, এক হাত... এক বাঁও, ২ হাত....। পানি মাপছে জাহাজের লোকেরা। না চলার মত করে চলছে জাহাজ। বামে পানি কমতে শুরু করলো। আমরা ডানে ঘুরলাম। এতটাই ঘুরলাম যে, ১৫ মিনিট পর আর অন্য জাহাজের বাতি দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাইনোকিউলার দিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না। খালী চোখেতো নয়ই। আবার অথৈ সাগরে। ঠান্ডায় জমে যাবার দশা আমাদের। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। অবশেষে আমাদের গাইড মোতাহারের চোখে জাহাজের লাইট ধরা পড়লো। আমরা অন্যরা কিছুই দেখছিনা। ভরসা করতেই হলো। আস্তে আস্তে জাহাজের মুথ ঘুরানো হলো বায়ে। কটকায় অন্য জাহাজের কাছে আমরা যখোন পৌঁছলাম, রাত তখন প্রায় ১১ টা। জাহাজের নোঙ্গর ফেলা হলো।
৩ টা জাহাজের মধ্যে ২ টা জাহাজের মাস্টারের সাথে কথা বলে নিলাম। একজন যাবেন ১ দিন পর। বাকী ১ জন আজকেই ভোর ৪ টায় রওয়ানা হবে। তার সাথে আমরা যাবো, বলে আসলাম। তার কোনো আপত্তি নেই। আমাজের জাহাজে ফিরে এসে সুকানীকে বল্লাম- ভোর ৪ টায় যেনো রওয়ানা করে। ওই জাহাজের পিছে পিছে। তাহলে আর পথ হারানোর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। জাহাজের ম্যানেজার, সুকানী আর মাস্টারকে সব বুঝিয়ে বলে ঘুমাতে গেলাম ২ টার দিকে। ওদের ডাকে ঘুম ভাঙলো। জাহাজ মাত্র ছেড়েছি- বল্লেন ম্যানেজার। ঠিকাছে বলে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম- ৪ টা বেজে ১০ মিনিট। সব্বোনাশ ! ওই জাহাজ ছেড়েছে ১০ মিনিট আগে। তারমানে আবার পথ হরাবো আমরা। দৌড়ে ব্রিজে উঠে এলাম। সুকানীকে বল্লাম- ওই জাহাজটা কতদুর ? বেটা বললো, সামনে কোথাও...। পিত্তি জ্বলে গেলো। কী বলবো ? ডান-বাম-সামনে-পিছে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুধু কুয়াশা। হাল ছেড়ে দিলাম। ১০/১৫ মিনিট চলার পর জাহাজ থেমে গেলো। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর যেতে পারবে না। রোদ উঠার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তারপর রাস্তা দেখে আগাবে...
রোদ ঠিকই ঊঠলো। কুয়াশা আর কমে না। ১৫ হাত দুরের জিনিসও দেখা যায় না। সকাল ১০ নাগাদ একটু একটু করে চারপাশ পরিস্কার হলো। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক বাদে আমরা সাগরকে একপাশে ফেলে তীরের দিকে আগালাম। পশুর নদীতে ঢুকলাম। ডান আর বামে সুন্দরবনের গাছ পালা। সে এক অন্য রকোম সুন্দর ! সবাই ৩ তলায় আর ছাদে চলে গেলো। আশে পাশে বন দেখার পর সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসলো। ইতোমধ্যে আমরা যে সঠিক পথে ঢুকেছি সেটা সবাই বুঝে গেছে। এখান থেকে মঙলা যেতে আমাদের সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মত। নিচে নেমে আসলাম। এতক্ষনে টের পেয়েছি- প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে। নাস্তা সেরে নিলাম। একহাতে গরম চায়ের গ্লাস, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলাম। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে নাটকীয় ঘোষনা দিলাম-
সূর্য উৎসবে আগত সকল অভিযাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আমি এই জাহাজের স্ব-ঘোষিত ক্যাপ্টেন। আমার নাম মেসবাহ। আমরা ঠিক পথে জাহাজ নিয়ে ঢাকার পথে যাচ্ছি। চিন্তা করার কিছু নেই। এখন থেকে ঢাকা পৌঁছা পর্যন্ত আমার কথামতো জাহাজ চলবে। আশা করছি দুপুর ৩ টা নাগাদ আপনাদের ঘন্টা খানেকের জন্য মাটিতে নামাতে পারবো....। ধন্যবাদ সবাইকে।
এরপরের ঘটনা খুবই সাদামাটা। বিকেল সাড়ে তিনটায় আমরা এসে করমজল নামক ট্যুরিস্ট স্পটের মাটিতে নামলাম। ৩ দিন পর মাটির স্পর্শ ! ক্ষাণিক সময় ঘুরে আমাদের থাকা ট্রলার এবং আরো দুটো ট্রলার ভাড়া নিয়ে সবাই পাশের খাল দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বেশ কিছুটা বনের মধ্যে ঢুকে গেলো। মধু কিনলো কেউ কেউ। সূর্যাস্তের আগেই সবাই জাহাজে ফিরে আসলো। পেটের অবস্থা কাহিল সবার। তখনো দুপুরের খাবার খায়নি। পড়িমরি করে দুপুরের খাবার খেলো সন্ধ্যায়। সবার চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ। সন্ধ্যার পর শুরু হলো কুইজ প্রতিযোগিতা, র্যাফেল ড্র। র্যাফেল ড্রয়ের টিকিটের দাম ছিলো ১০ টাকা। পুরস্কার ছিলো ম্যালা দামী। নিঝুম দ্বীপ এবং সেন্টমার্টিন-এ অবকাশ হোটেলের সৌজন্যে, সেন্টমার্টিনে সীমানা পেরিয়ে রিসোর্টের সৌজন্যে, বান্দরবানে গাইড ট্যুরের সৌজন্যে ২ দিন ২ জনের থাকা এবং নাস্তা ফ্রি। রঙয়ের সৌজন্যে ১০ টি গিফট প্যাকেট। যাতে ছিলো- ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, শাল, শাড়ি, শর্ট পাঞ্জাবী ইত্যাদি। এছাড়া অন্য পুরস্কারও ছিলো। মোট পুরস্কার ছিলো ৭০/৭৫ টা। এভাবে আনন্দেই কাটলো বেশ কিছু সময়। মঙলা থেকে জোয়ার আসার পর আমাদের জাহাজ পারাবত- ১ যখন ঢাকার পথে ছাড়লো তখন রাত ১১ টা। এখান থেকে এক নাগাড়ে জাহাজ চালালে ঢাকা যেতে আমাদের সময় লাগবে ২০ ঘন্টা। কালকে অফিস করতে পারবো। তবুও শান্তনা যে, অনেক বড় একটা বিপদ থেকে অবশেষে উদ্ধার পেয়ে আমাদের জাহাজ ঢাকার পথে... রাতের শেষ সিগারেটটা টেনে ঘুমাতে রুমে গেলাম ১.২৫ মিনিটে। গন্তব্য ঢাকা সদরঘাট...।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৩৫