“We live in an age when pizza gets to your home before the police.” - Jeff Arder
ফাস্ট-ফুড সংস্কৃতিপ্রেমীদের জিভে জল এনে দেয়া একটি ইয়াম্মি ইয়াম্মি খাবার -পিৎজা। কি! পিৎজা হাট, ডমিনাস পিৎজার হেঁশেলের সুবাস লাগলো বুঝি নাসিকায়? পিজ্জা কী আসলে? একটা বড়, গোলগাল, ফোলা ফোলা, নরম নয়তো মচমেচ রুটি, টমেটো সসে মাখামাখি! যদিও ষষ্ঠদশ শতাব্দীর পূর্বে কিন্তু ইউরোপিয়ান মেন্যুতে টমোটোর আবির্ভাব ঘটেনি। যেমনটা আমরা জানি, পিজার আদিনিবাস ইতালি; ইতালির কিংবদন্তি গাঁথাও তাই বলে। প্রাচীনকালে গ্রীক ও রোমারদের মধ্যে নানা স্বাদের টপিং দিয়ে ঈস্ট (yeast) ছাড়া, চাপাতি জাতীয় এক ধরনের রুটি (unleavened bread) খাওয়ার প্রচলন ছিল। এধরনের গ্রীক পিজার বর্ণনায় সব্জির ব্যবহার বেশী থাকলেও ইতালীয় পিজার টপিংয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা দেখা যায়; যেমন শুকরের মাংস, অলিভ, শুকনো আঙ্গুর, পাইন বাদাম, মধু ইত্যাদি। সেই সব ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি-পিজার প্রস্তুত প্রণালী অনুসারে এখনো ইতালীর অনেক রেস্টুরেন্টেই সুস্বাদু পিজা পরিবেশন করা হয়।
পিৎজা সংক্রান্ত ইতালীয় কেচ্ছা
১০০০ খ্রিস্টাব্দে পিসেয়া (picea) শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় ইতালিতে। একটি গোলাকার রুটিতে নানা প্রকার টপিং বা পুর দিয়ে বেক করা হতো। পিৎজা শব্দের প্রচলনও ছিল সমসাময়িক কাল থেকেই। পরবর্তীতে পিজা তৈরীতে ঈস্টের ব্যবহার শুরু হয় যা এখন পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে। অনেকটা বর্তমানের পকেট-শর্মা রুটির মত পকেটাকার রুটি (pita type bread), ফোলানো, মচমচে রুটি তৈরীও শুরু হয় এসময়, যা ইতালিয় শব্দ schiacciata নামে পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেও পিজা আসলে পুর দিয়ে রোল করা, ভাঁজ করা (স্যান্ডউইচের মত), কোনাকৃতি, অর্ধচন্দ্রাকার (shaped like a crescent) রুটি ছিল। Calzone নামের এই খাবারে পুর হিসেবে প্রচুর পরিমাণে টমেটো, মোজারেলা পনির (Mozzarella Cheese) আর পিজার অন্যান্য টপিং ব্যবহার করা হতো। পিজার বর্তমান যে চেহারা তার সাথে মূলত ইতালির নেপলস শহরই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের। পিজা সুস্বাদু করতে নেপলসে তেল, রসুন, cinciielli নয়তো anchovies নামের এক ধরনের ছোট মাছ ও মোজারেলা পনির ব্যবহার করতো। প্রথম পিজা রেস্টুরেন্টের নাম ছিল পোর্ট আলবা (Port' Alba)। এই রেস্টুরেন্টে যে ওভেন-চুলা ছিল তাতে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির প্রস্তরখণ্ড জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো, কারণ এগুলো উচ্চমাত্রায় তাপ উৎপাদন করতে সক্ষম। যা পিজ্জা তৈরীতে সহায়ক হতো খুবই।
পিজা-কেচ্ছা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি মার্গারেটা পিজা নিয়ে না বলা হয়। এই কাহিনী ১৮৮৯ সালের, যখন আমবার্তোর (Umberto I) সহধর্মিনী রাণী মার্গারিটা তেরেসা গিওভানি (Queen Margherita Teresa Giovanni) রাজাসমেত নেপলস্ পরিদর্শনে আসেন। Pietro Il Pizzaiolo –এর মালিক ডন রাফায়েলের(Don Raffaele Esposito) প্রতি আদেশ ছিল রানীর সন্মানার্থে বিশেষ ভোজ প্রস্তুতির। রাফায়েল তার স্ত্রী’র সাথে শলাপরামর্শ করেন এই বিষয়ে। তার স্ত্রী ছিলেন পিজা তৈরীতে সিদ্ধহস্ত। তারা দু'জন মিলে টমেটো, মোজারেলা, বেসিল পাতা সহযোগে পিজা তৈরী করে সেই পিজা নাম দেন পিৎজা মার্গারিটা। উল্লেখ্য যে, মোজারিলা পনির তৈরী হয় মহিষ দুগ্ধ হতে। নেপলসবাসী যদিও পনির, বাসিল, টমেটো, মোজারেলা পনিরের অনুরক্ত ছিল, কিন্তু এর সমন্বয় পিজাকে যে এই পরিমাণ তৃপ্তিদায়ক করতে পারে তা পূর্বে বোধগম্য হয়নি তাদের কাছে।
পিৎজা সংক্রান্ত আমেরিকান কেচ্ছা
এক ইতালিয় অভিবাসী আমেরিকানদের পরিচিত করায় পিজার সাথে। ১৯০৫ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে নিজের রেস্টুরেন্টে জেনারো লোমবার্ডি (Gennaro Lombardi) প্রথম পিজা তৈরী করেন। এই রেস্টুরেন্ট যদিও ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখেনি, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিকাগোতে প্রথম পিজা রেস্টুরেন্ট Pizzeria Uno - তে গভীর প্যানে তৈরী মোটা পিজা, যা চিরাচরিত ইতালীয় পদ্ধতি থেকে একটু ভিন্ন ছিল, আমেরিকারদের পিজা-প্রেমী করে তোলে। অবশ্য যুদ্ধকালীন সময়েও এ ধরনের মোটা পিজার খাদ্যাভাস গড়ে উঠেছিল, কারণ এগুলো দামে স্বস্তা এবং একসাথে অনেকের উদরপূর্তি সম্ভব হতো।
পিৎজা কুটির
শুরুটা ছিল সেই ১৯৫৮ সালে। স্থান কানসাসের উইশিতা স্টেট ইউনিভার্সিটি (Wichita State University) ক্যাম্পাস। উদ্যোক্তা ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুই ছাত্র এবং সম্পর্কে দুই ভাই ফ্রান্ক (Frank) ও ড্যান কারনে (Dan Carney)। বর্তমানের পেপসি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার পিৎজা হাটের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাইকে কিন্তু তাদের মায়ের কাছ থেকে ৬০০ ডলার ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে হয়েছিল।
বিশ্বের আনাচে-কানাচে পিৎজা হাট যেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তেমনি এখনো বহাল আছে ইউশিতা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেই প্রাচীন পিৎজা হাট।
খামিরঃ পিৎজার গোপন রহস্য
পিৎজার জন্য খামির তৈরী চটজলদি না হলেও খুব একটি জটিল কোন পদ্ধতিও নয়। ময়দা, ঈস্ট, লবণ, পানির সমন্বয়ে তৈরী খামিরে উন্নতমানের সাদা ময়দা ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু দেশে রুটি জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরীর জন্য আলাদাভাবেই ময়দা পাওয়া যায়। অবশ্য সাধারণ ময়দা দিয়েও খামির তৈরী করা যাবে। তবে মানের তারতম্যের কারণেই খামিরের স্থিতিস্থাপকতায় ব্যাপক তারতম্যও দেখা যাকে। পেশাদার বাবুর্চিদের পিজার রুটিকে নানাভাবে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন রকম কসরৎ করতে দেখা যায়, অথচ রুটিটি কিন্তু ছিঁড়ে যায়না। এর থেকে খামিরের ময়দার মান এবং খামিরটি যে যথাযথ তা আন্দাজ করা যায়।
একটি সহজ পিজ্জা রেসিপিঃ
উপকরণঃ
*
ময়দা - ৩ কাপ
ঈস্ট - ২ চা.চা.
সয়াবিন তেল -দেড় চা.চা.
লবণ -দেড় চা.চা.
*
চিকেন সসেজ (ভাজা, টুকরো করে কাটা) - ৩টি
ক্যাপসিকাম (পাতলা, গোল গোল করে কাটা) - ১টি
পেঁয়াজ (মাঝারি আকারের, গোল গোল করে কাটা) - ২টি
পেঁয়াজ কলি (ছোট ছোট গোল গোল করে কাটা) - ৩-৪টি
রসুন কোয়া (মিহি কুচি করে কাটা) - ১টি
শুকনা মরিচ গুড়া ১ চা.চা.
গোলমরিচ গুড়া - ১ চা.চা.
মোজারিলা চিজ (ঝুরি ঝুরি করে নেয়া) - প্রায় এক কাপ বা প্রয়োজন মাফিক
টমেটো সস - প্রয়োজন মত
সবাবিন তেল - ১.টে.চা.
প্রণালীঃ
ঈস্ট মৃদু গরম পানিতে গুলে নিয়ে মিনিট দশেক রেখে দিতে হবে। এরপর ময়দার সাথে তেল, লবণ মিশিয়ে, ঈস্ট গোলানো পানি এবং প্রয়োজনমাফিক আরো পানি দিয়ে খামির করে নিতে হবে। খামিরটি ভালমত ঢেকে গরম জায়গায় (যেমন, চুলার আশেপাশে) রেখে দিতে হবে। এক-দু’ঘন্টা পর খামির ফুলে উঠলে খামির আবারো ভাল মত মথে নিতে হবে। সামান্য খামির আলাদা ভাগ করে নিলে ভাল। ভালমত শুকনা আটা মেখে খামির টুকু দিয়ে মোটা রুটি বেলে নিতে হবে। পিজ্জা তৈরীর পাত্রের গায়ে সয়াবিন তেল মেখে নিতে হবে। এরপর রুটির গা থেকে বাড়তি শুকনো আটা ঝেড়ে ফেলে পাত্রে বসিয়ে দিতে হবে। আলাদা তুলে রাখা খামির লম্বা দড়ির মত করে পিজ্জাপাত্রে রাখা রুটির চারধার দিয়ে জুড়ে দিতে হবে।
এবার টপিং দেয়ার পালা। প্রথমেই টমেটো সস নিয়ে রুটির গায়ে সমান ভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর কিছু টমোটা বিছিয়ে দিয়ে মোজারিলা পনির ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর একে একে পেঁয়াজ কলি, সসেজ, ক্যাপসিকাম বিছিয়ে দিয়ে আবারো মোজারেলা পনির ছড়িয়ে দিয়ে শুকনা মরিচা গুড়া, গোল মরিচ গুড়া, রসুন কুঁচি ছিটিয়ে দিতে হবে। এবার চামচে তেল নিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
এবার ওভেনে ২০০-২২০ সেঃ তাপে ১৫-২০ মিনিট পিজ্জা বেক করুন। গরম গরম পরিবেশন করুন পিৎজা হাটের স্বাদে হোম-মেড পিজ্জা!
স্বাস্থ্যসম্মত টিপসঃ
১. বোতলজাত টমেটো সস ব্যবহার করার বদলে অনেকে বাড়িতেই টমেটো পিউরি বানিয়ে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, এধরনের উচ্চমাত্রার অম্লিয় খাদ্য এ্যলুমিনিয়াম পাত্রে রান্না না করাই শ্রেয়।
২. ফাস্ট-ফুড খাদ্যে স্বাদ লবণ বা টেস্টং সল্ট বা আজিনোমোটো এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি স্লো-পয়জনরূপে কাজ করে।
Moral of the post :
এতোক্ষণ ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে এতোসব পেঁচালের কারণ হলো আজকে বছরের প্রথম দিনে, জীবনে প্রথমবারের মত পিজ্জা তৈরী করলাম। কে জানতো পিজ্জা বানানো যে এত্তো সোজা!!! খামোখা এতোদিন পিজ্জা হাট, ডমিনাসে গাঁটের পয়সা (নিজের না, অন্যের!!! ) খরচা করে পিজ্জা খেয়েছি।
নতুন বছরে ভাবলাম সবাইকে পিজ্জাময় শুভেচ্ছা জানাই।
হ্যাপি নিউ ইয়ার দুই হাজার দশ
পিজ্জাতে দেন মোজারিলা, ক্যাপসিকাম,
পেঁয়াজ, অলিভ, মাশরুম আর
বেশী বেশী টমেটো সস!
New Year Lesson: পিজ্জা বানানি কুনু ব্যাফার না!