প্রসংগ পহেলা বৈশাখঃ মুখোশ ও "মংগল শোভা যাত্রা"
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে চারু কলা থেকে “মূখোশ” মিছল বের করা হয়। সেইসব মূখোশ হয় বিভিন্ন বিদ্বগুটে পশু পাখির। তবে কয়েকটা দর্শন প্রিয় পাখিরও মূখোশ করা হয়-তবে তাও বিকৃত ভাবে।অনেক ব্লগারদেরমত আমিও প্রতি বছরই ব্লগে পহেলা বৈশাখ নিয়ে পোস্ট দেই। অনেক পাঠকই জানতে চান-পহেলা বৈশাখের সাথে মূখোশের কী সম্পর্ক? উত্তরটা আমার জানা নেই। তবে জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি।
মূখোশ মূলত হিন্দু পুরাণের পটভূমি-এতদাঞ্চলে যার ব্যাপ্তি ঘটেছিল সেই পৌত্তলিকতার যুগে। হিন্দু পুরাণ থেকেই কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের সমাজে পশু-পাখি, ধর্মের লোকজবোধ, পুরাণ যাপিত জীবনে পরস্পরের যোগসূত্র। পুরাণের মধ্য দিয়ে মানুষ জীবনে পশু-পাখির মধ্য দিয়ে জীবনের মৌল প্রবৃত্তির অর্থ খোঁজার চেষ্টা আর ধর্মের লোকজবোধ দিয়ে দিন যাপনের মধ্যে জীবনের প্রতি কিংবা অলৌকিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আর এক্ষেত্রে শ্রদ্ধা মূলত ভয় আশ্রিত। আবার এই পুরাণ, লোকগাঁথা, ধর্মের লোকজবোধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সরে এসে মানবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
মূখোশ নিয়ে ধর্মীয় আচার কিম্বা অন্য কিছু আমার লেখার উদ্যেশ্য নয়। আমি এই লেখায় মূলত পহেলা বৈশাখে মূখোশের প্রচলন সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে চাই। মুখোশে ধর্মীয় প্রভাব থেকেই শুরু কৃষিভিত্তিক সমাজ, যেখানে বাস্তব স্বতঃসিদ্ধ নয় বরং ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত। কিন্তু পুরাণের চরিত্রগুলোর সাথে মূখোশ তৈরীর শিল্পীর কল্পিত শৃজনী ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সরে যাওয়ায়ই স্বাভাবিকতা। আর এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ফল উচ্চারিত হয় শিল্পের ফর্মের মধ্যে। কৃষিজ সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে যাবতীয় বিষয়বস্তু সম্ভবত বিশ্বাস ও চিন্তার অন্তর্গত ছিল। সেখানে ব্যক্তি মানুষ ও সমাজের মধ্যে বিরোধ ছিল না। এ বিষয়গুলো শিল্পী তার কর্মে তুলে ধরেন সাবলীলভাবে।
মুখোশের মধ্যে মানুষের কখনো শান্তভাব, কখনো রাগে উত্তাল, কখনো মানবিক আবার কখনো পশুজভাব প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রতিনিধিত্বের সম্পর্ক থেকে তৈরি হয় এক সার মাধ্যমিক ফর্ম, যেসব ফর্ম প্রতীক থেকে অর্থ, যাদু থেকে স্বাভাবিকতা, অতি দেবতা থেকে সামাজিকতার রূপান্তরণ নিশ্চিত করে। এগুলো একই সাথে আবার মুখোশ এবং মুখোশ উন্মোচনের কাজ করে। অভিনেতা যখন মুখোশ পরে তখন সে ব্যক্তি মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। একই সাথে সে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক শ্রেণী থেকেও আলাদা হয়ে যায়। যে মুহূর্তে অভিনেতা তার মুখোশ খুলে ফেলে সে হয়ে ওঠে ব্যক্তি, সে ফিরে আসে তার সামাজিক অবস্থানে। মুখোশ পরে অভিনেতা পূর্বপুরুষ কিংবা অতিদৈবতার প্রতীকে পরিণত হয়। কিন্তু সে দেবতা কিংবা পূর্ব পুরুষের পদবী, সমাজস্তর ও সামাজিক অবস্থান লাভ করে না। তাই এর মাধ্যমে এমন একটি ভুবন তৈরি হয় যাতে দেবতা, পশু-পাখি, পূর্ব পুরুষ, সাধারণ মানুষ সবাই সম-মর্যাদায় সমাসীন। মুখোশ নৃত্যের সাথে জড়িত। সে কারনেই চৈত্র সংক্রান্তিতে, পহেলা বৈশাখ এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা অনূষ্ঠানে নৃত্যানূষ্ঠান থাকেই। মুখোশগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়- ক. পুরাণের সাথে যুক্ত- মহাদেব মুখোশ, কালী মুখোশ, রাধাকৃষ্ণ, হর পার্বতী, গঙ্গা মুখোশ প্রভৃতি খ. পশু জগতের সাথে যুক্ত,-বাঘ, কুমির, বানরের মুখোশ, কল্পিত রাক্ষশ-খোক্ষশ ইত্যাদি গ. যাপিত জীবনের সাথে যুক্ত, যেমন-বুড়োবুড়ির মুখোশ, প্রেমিক-প্রেমিকা দেবদেবীর মূখোশ ঘ. উৎসব, অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত, যেমন-যাত্রা, পালা, সং ইত্যাদির মুখোশ।
মহাদেব বা শিবের মুখোশের কপালে ঐতিহ্যানুগ করে তৃতীয় চক্ষু আঁকা হয়। কালীর মুখোশ একটি একক কাঠ দিয়ে বানানো। খালি একটা আলগা কাঠ লকলকে জিভের জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানে সাদা রঙে চোখ, কালো রঙে চোখের পুত্তলী, বাকি মুখমণ্ডল লাল লাইনে নীলের ওপর আঁকা। ঐ লাল লাইনের মাধ্যমে মুখের দুই প্রান্ত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। ভুরু ও অলঙ্কারও লাল লাইনে আঁকা-যা ভয়ের প্রতীক। বুড়োবুড়ির মুখোশে মধ্যবয়সী বুড়োবুড়ির মুখোশ পরে নাচে। তাদের সে নৃত্যে উন্মীলিত জীবনে বেড়ে ওঠার যুগল আনন্দ দেখানো হয়। মুখোশে দুম্বটি ইমেজ মিলে একটি নতুন সত্তা তৈরি হয়। একটি মুখ ঢেকে একটি চরিত্র তৈরি হয়। আর মুখটি ঢাকা পড়ে ইমেজের নিচে। মনে হয় ধ্বংসের পরে পূর্ণ সৃষ্টি, মৃত্যুর ওপর জীবনের জয়ধ্বনি, লুকানো অর্থ উন্মোচন করা আর মৃত্যু অর্থ বেঁচে থাকা। প্রতিটি মুখোশ একটি ঘটনা কিংবা ঘটনার অংশ। ঘটনাটি বোধগম্য হয় যখন অনুষ্ঠান শুরু হয়, যখন মুখোশ পরিহিত ও মুখোশহীন ব্যক্তিদের মধ্যে আন্তক্রিয়া শুরু হয়। সনাতন ধর্মে মুখোশ ক্ষমতা, দৈব, পশু-পাখি জগৎ কিংবা সমাজ নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক। যখন সমাজের নিচু স্তরের মানুষ উঁচু স্তরকে প্রচণ্ড ও নির্মম ব্যঙ্গ করে তখন এটি সংজাতীয় অনুষ্ঠান। আমাদের অনুভূতির গভীরতা ও জটিলতা শরীরের মধ্যে কোলাহল তোলে, অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিছক শরীরের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। তাই বিকল্প মাধ্যম হিসেবে মুখোশ ভূমিকা পালন করে। পুরাণে, রূপকথায়, ধর্মজ উপাখ্যানে মানুষের শরীর এবং বাইরের প্রকৃতির মধ্যে দ্বিমুখী যোগাযোগ রয়েছে। ফলে মানুষ দেবতা হয়, দেবতা মানুষ হয়, মানুষ গাছ হয়, গাছ মানুষ হয়। এই রূপান্তরণের মাধ্যম মুখোশ পরলেই মানুষের বদল ঘটে। মানুষের শরীর ও বাইরের প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক অব্যবহিত এবং স্পষ্ট। পুরাণ, রূপকথা, ধর্মজ উপাখ্যানের ব্যাখ্যা সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিসরে সম্ভব। কিন্তু এতে কিছু বৈপরিত্য দেখা যায়- একপক্ষে মানুষের কল্পনার বিভিন্নতা ও বিশালতা, অপরপক্ষে নির্দিষ্ট ব্যক্তি-মানুষের শরীরে স্বীকৃত সীমাবদ্ধতার মধ্যে বৈপরীত্য। মানুষের শারীরিক কাঠামো আমাদের জানা, কিন্তু সেই শরীরটাই যখন কল্পনার মধ্যে উন্মীলিত হয় তখন বাস্তবের শরীর থেকে পৃথক হয়ে যায়, বিশাল হয়ে যায়, ভিন্ন হয়ে যায়।
মুখোশের ইমেজ শুধু ইঙ্গিতের ভূমিকাবহ, ভাবনার সাথে তার সহ-অবস্থান। ইমেজ ভবিষ্যৎ ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে রাখে। অবশ্য এই উন্মুক্ততা প্রথমেই দেখা যায় না, কারণ মুখোশের বাহ্যিক অবয়ব সবার কাছে স্পষ্ট ও পুরানো। যেমন-মহাদেব মুখোশ, কালী মুখোশ। যেখানে মানুষ ও পৃথিবী পরস্পরের আয়না, সেখানে ইমেজ উজ্জ্বল কিংবা ধূসর, কৌণিক কিংবা চতুষ্কোণ, মানুষের মনের ক্ষমতা ও দৃশ্যের ইঙ্গিতবহ। কৃষি ভিত্তিক সমাজে নানা ইমেজের মুখোশ যেন পরস্পরকে পরস্পরের মুখোমুখি করে দেয়, দেবতা এভাবে মানুষের সামনে দাঁড়ায়। উঁচু শ্রেণীর পরক্রমশালী ব্যক্তি নিম্নশ্রেণীর সামনে আসে-এভাবে উভয়ের দূরত্ব বিলীন হয়ে যায়।
যাত্রাদলের বিবেক যখন মঞ্চে আসে নির্ধারিত মুখোশ তাকে চিনিয়ে দেয়। আমরা জানি, চরিত্রটি বিবেক, সে গোপন সংশয় প্রকাশকারী, চেতনা উদ্দীপক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং সাহসী। সে সাহস সঞ্চার করে অন্য চরিত্রে, দর্শকের নিকট ভবিষ্যৎ মেলে ধরে, বীর চরিত্রকে লক্ষ্যে সচেতন করে তোলে আর আমাদের মধ্যে সংশয়, জ্বালা, দ্বিধা ও যন্ত্রণা প্রবেশ করিয়ে দেয়। এই মুখোশ পরা চরিত্রটি প্রধান চরিত্র ও অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে সেতু তৈরি করে, যোগসূত্র স্থাপন করে চরিত্র ও দর্শকদের মধ্যে। বিবেক চরিত্রের অভিনেতার মুখ মুখোশে ঢাকা, মুখোশটি বিবেকের প্রতীক, আর আমরা বিবেকের মুখোমুখি। চরিত্রটি সাহস সঞ্চারকারী; সাহস হচ্ছে ভয় ও দুঃখের এক বিপরীত সাড়া। সেই সঙ্গে বীরত্বের উদাহরণ ও ধৈর্যের নজির। প্রতিটি সমাজ এবং সমাজ অন্তর্গত প্রতিটি শ্রেণী নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনমাফিক বীর তৈরি করে, বীরের বিবেক তৈরি করে- পহেলা বৈশাখের মেলায় চারু কলার সংশ্লিষ্ঠদের একক প্রয়াশ। যার সাথে পহেলা বৈশাখের কোনোই সংশ্লিষ্ঠতা নাথাকলেও সাধারন মানুষের মাঝে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে-বললে ভুল বলা হবেনা।
উপমহাদেশ তথা আমাদের দেশ জুড়েই আছে কৃষকদের বঞ্চনার ইতিহাস। আর ভুস্বামীদের আছে খেটে খাওয়া কৃষকদের উপর জুলুমের ইতিহাস। তখনকার দিনে ভূস্বামীরা কৃষকদের নিকট থেকে শস্য, খাজনা ইত্যাদি নিয়ে কৃষকদের বিনোদনের জন্যই মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজে মূখোশ কাহিনীর সূত্রপাত। কৃষিভিত্তিক সমাজের পুরাণে, প্রাচীনকালে “মগংল বিনাশী” শত্রু কল্পনা করাহতো-সেই মগংল বিনাশী শত্রুকে প্রতিহত করার জন্যই “মগংল শোভা যাত্রা” অনুষ্ঠিত হতো হিন্দু দেব দেবী ও মহারাজা, জমিদারদের সৌজন্যে। সেইসব মগংল যাত্রা প্রজাদের মধ্যে একধরনের আনন্দ উপভোগের বিষয় ছিল-যাতে দরিদ্র নীপিড়ীত প্রজারা নিজেদের বঞ্চিত হবার বিষয়টা ভুলে দেব-দেবী কিম্বা রাজ বন্দনায় ব্যাস্ত থাকে।
ঘটনাগুলো অতীতের, কিন্তু তা গত কয়েক বছরে চারুকলাই পহেলা বৈশাখে অন্তর্ভূক্ত করেছে। মুখোশ একদিকে জড় অপরদিকে জীবনী উদ্দীপক ও জীবনী শক্তি সম্পন্ন। ফলে এই মুখোশ মানুষের মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে আমাদের নিকট উপস্থিত। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সমাজে এর ব্যাপক প্রচলন ও পরিচিতি মুখোশকে আমাদের লোকজ কলার অংশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
তথ্য সূত্রঃ
উপপুরাণ
মহাপুরাণ ন
হিন্দু পৌরাণিক ঋষি
হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র