বাংলোর বড়ো পাল্লার জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখার সেই দিনগুলো ছিল অন্যরকম। তপ্ত মাটির বুকে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটটা যখন পড়ত সোঁদা গন্ধে চারদিক উন্মাতাল হয়ে উঠত। একটা হালকা প্রশান্তি এসে সারা শরীরে বিলি কেটে যেত। তারপর ঝিরঝির থেকে ঝুমঝুম। দেখতে দেখতে নলি শাখের মাঠটা পুরো ডুবে যেত পানিতে। কলকে ফুলের গাছগুলো বখাটে ছেলের মতো বেকেচুঁরে কোন প্রকার দাঁড়িয়ে থাকত বাতাসে। টিনের চালে কী অদ্ভূত তালে-বাধা একটা আওয়াজ হতো। একধরণের অবসন্নতা পেয়ে বসত। ঘোলা জলে চারদিক থৈ থৈ করত। তখন দূর্গাপুজোর সময় মেলা বসত ম-পে ম-পে। সস্তা দামের পৌরাণিক বইগুলো আমাদের কিনে দেয়া হতো। এতো জল দেখে নিজেদের বাসাটাকে বেহুলার ভেলা মনে হতো। কত অদ্ভূত অদ্ভূত জিনিস না ভাবতাম!
জলের ওপর তখন প্রদীপের মতো ভেসে বেড়াত নাল-নীল কত ফুলের ঝাঁক। আমাদের পাশের বাসায় একটা বিরাট কৃষ্ণচূড়ার গাছ ছিল। প্রতিবার বৃষ্টি এলে এর ডালপালা ছাটিয়ে দেয়া হতো। বস্তির বাচ্চারা এসে এর ডাল নিয়ে হুটোপুটি লাগত। একবার এমনি এক বর্ষায় বড়ো বড়ো করাত নিয়ে কতগুলো লোক এলো ওই বাসাতে। তিন-চারদিন ধরে একটানা শুধু কাটতেই লাগল। আমি তো দুঃখে আধমরা। চৈত্র্যের দাবদাহের সময় কে পাঠাবে হু হু বাতাস। কে আমাদের বাসার পেছনটা আগুনের রঙে লাল করে রাখবে। কে ভাসাবে বৈশাখের বৃষ্টিতে বাসন্তী দীপাবলী। মা তখন আমাকে শান্তনা দিতেন। ‘গাছেরও তো প্রাণ আছে; দেখিস একদিন কৃষ্ণচূড়ার অভিশাপ লাগবে...’
বাবা সবসময় বলতেন তুলরাশির মানুষের কথা নাকি অক্ষরে অক্ষরে ফলে। মা তুলারাশির জাতিকা। তাই মা’র সব শান্তনা-অভয়বাক্যকে চিরকালই ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই মেনে এসেছি। কিন্তু এই কথাটা যে এভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলবে কখনো ভাবিনি।
আসলেই তো এ শহরে কৃষ্ণচূড়ার অভিশাপ লেগেছে। এখন আর পুরোবাসীদের কাছে বৃষ্টি আর বিলাস নয়। বৃষ্টি এক আতংকের নাম। এই বুঝি পাহাড় ধসে পড়ে। এই বুঝি আটকে যায় নর্দমাগুলো। এই বুঝি জল উঠে আসে রাস্তায়। এই অভিশপ্ত নগরে এখনো দুয়েকটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখি। সেদিন টাইগারপাস মোড়ে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখলাম। বিজ্ঞাপনের বাক্সের ভেতর আটকা পড়ে আছে বেচারী। আর কিছুদিন পর বিজ্ঞাপনটা বসে গেলে লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে হারিয়ে যাবে সেও। আরেকটা অভিশাপ বুঝি লাগবে আমাদের গায়ে।