somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলুন, কলকাতায় কবি নজরুলকে দেখে আসি, ১৯২১ সালে কেমন ছিল তার অবয়ব?

১১ ই জুলাই, ২০১১ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কাজী নজরুল এলেন কলকাতায়। ১৯২০ সালের কথা। বিশ একুশ বছর বয়সী তরুণ নজরুল তখনও সৈনিক জীবনের মায়া ছাড়তে পারেন নি।
অস্বীকারের উপায় নেই, তার এ সৈনিক জীবনে তিনি যতদিন করাচীতে ক্যাম্পে ছিলেন, সেখানেও তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এ সৈনিক জীবনে তিনি এক মৌলভীর কাছে ফার্সী ভাষাটা আরও ভালভাবে শিখে কবি হাফিজের বেশ কিছু কাব্য অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়।
এ ছাড়া তিনি কিছু লেখালেখি করতেন সেখানে বসে আর সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন কলকাতার মোসলেম ভারত ও অন্যান্য পত্রিকায়।
কলকাতায় এসেও তিনি নামের আগে কাজী আর হাবিলদার খেতাব ব্যবহার করতেন, শুধু তাই নয়, খেয়ালী কবি কারো কথা তোয়াক্কা না করে তখনও বুট পরে কখনও সৈনিক পোষাক পড়ে বিভিন্ন সভায় হাজির হতেন, তার হো হো অট্টহাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো, এ আবার কোত্থেকে এল?

একুশের সেই নজরুলকে কেমন লাগতো দেখতে তখন? নজরুলকে নিয়ে তার তৎকালের বন্ধুরা সবাই প্রায় একই ভাষায় তার অবয়ব বর্ণনা করেছেন, এর সারাংশ হচ্ছে এই-
‌‌সবল শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো যেন পেয়ালা, আর সে পেয়ালা দুটো যেন কখনো খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদা ভরপুর, তার গলা সারসের মতো পাতলা নয়, বরং পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সরল বীর্য-ব্যঞ্জক, গলার স্বর ছিল ভারী, তার সেই মোটা গলার সুরে ছিল যাদু, ঢেউয়ের আঘাতের মতো তার গান আছড়ে পড়তো ঝড়ের ঝাপটা হয়ে শ্রোতার বুকে। প্রবল হতে সে ভয় পেতো না, নিজেকে মিঠে দেখানোর জন্য সে চেষ্টা করতো না। এ বর্ণনা করেছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নজরুল ছিল একাই একশো। চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড়ো বড়ো মদির তার চেজাখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবী এবং তার উপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি রঙীন জামা পরেন কেন? ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে চট করে চোখে পড়ে তাই’, বলে ভাঙা ভাঙা গলায় হো হো করে হেসে উঠতেন তিনি। কথার চেয়ে বেশী তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশী তার গান।একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণ চা এবং অনেকগুলো পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘন্টা একনাগাড়ে গান করতে থাকতেন। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না। এ বর্ণনা কবির বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর।

আবুল মনসুর আহমদও এক লেখায় কবিকে ১৯২২ সালে প্রথম দেখার কথা বর্ণনা করেছিলেন এ ভাষায়, সভায় গিয়ে অন্যান্য সবার সাথে নজরুল ইসলামের সাথেও পরিচয় হলো। মিলিটারী ইউনিফর্ম পরা কাঠখোট্টা লোক, কবি বলে পছন্দ হলো না, কিন্তু চোখ দুটো তার ভাসা ভাসা হরিণের মতো, দেখে আকৃষ্ট হলাম। আমার এক কথায় সভার সমবেত সবার হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে যে ছাদ ফাটানো গলা শুনতে পেলাম, সেটি নজরুলের আওয়াজ। সভা শেষে তিনি আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি তার গায়ের অসাধারণ শক্তিতে বিস্মিত হলাম।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল, নজরুল এলেন। সৈনিক বেশ, কাঠখোট্টা চেহারা, দাঁিড় গোফ নেই, খনখনে অট্টহাসিতে ঘর মুখরিত করে আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন।
প্রবোধ কুমার লিখেছেন, নজরুল যখন তার অনুরাগরঞ্জিত কবি জীবন নিয়ে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার রাজপথে, তখন তার একদল লক্ষীছাড়া বন্ধুভিন্ন অপর সহায় সম্বল বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এমন একটি প্রবল উজ্জ্বল প্রাণ, এমন একটি সরল উজ্জ্বল ও হাস্যোদ্দীপ্ত জীবন, যেটি সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত করে রাখতো তার বন্ধু সমাজকে। তার স্বভাবের দীপ্তি, তার প্রাণবন্যা এবং তার হাস্যমুখরতা- এদের আকর্ষণে একদা কলকাতার রাজপথে ভীড় জমে যেত।

আব্দুল হালিম লিখেছেন, কবির সুডৌল বলিষ্ঠ দেহ, বড় বড় বিস্ফরিত উজ্জ্বল চোখ, মাথায় রুক্ষ দোলায়মান লম্বা চুল, সহাস্য মুখ, দীর্ঘ পিরান, পীত শিরস্ত্রাণ, গৈরিক বেশ হাতে বেণূ কবিকে মহিমান্বিত করে তুলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে গান ও কবিতায়। শেষ হচ্ছে কাপের পর কাপ চা। নজরুলের মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটছে, কলহাস্যে মজলিস মুখরিত, আহার নেই, নিদ্রা নেই, কবি তার ছন্দ দোলায় গান ও কবিতা রচনা করে চলেছেন, শত কোলাহলের মধ্যেও তার লেখনী স্রোতের মতো বেগবান।

নজরুলকে যারা গভীর ভাবে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করেছেন, মৃত্যু অবধি কাজী নজরুলের দু চোখে যে অপূর্ব দীপ্তি ও তেজোদ্দীপ্ত চাহনী ছিল, তাতে সরাসরি কেউ তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না। তার শরীর ছিল নাদুস নুদুস, যে অসুখে ভুগে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন, এর আগে পুরো যৌবন ও তারুণ্যে কখনো তিনি কোন অসুখে পড়েন নি।

কুইজঃ কাজী নজরুলের গানের সংখ্যা কত?

উত্তর- ১৯৩৬ সালের শেষে কিংবা ১৯৩৭ সালের শুরুতে একদিন একসাথে বসে খাচ্ছিলেন কবি নজরুল ও তার বন্ধু মুজাফফর আহমদ। কয়েক বছর ধরে কলকাতায় অনুপস্থিত মুজাফফর তার বন্ধু কবি নজরুলকে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, এই, তুমি এ পর্যন্ত কতগুলো গান লিখেছো? এক দেড় হাজার হবে?’
কাজী নজরুল নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলেন, প্রায় তিন হাজার হবে। শুনে আশ্চর্য হয়ে মুজাফফর তাকে বললেন, বলছ কি তুমি? রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশী?
নজরুল বললেন, হ্যাঁ, তার চেয়েও বেশী।

অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ১৯৬৪ সালে শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর সূত্রে আমি জেনেছিলাম যে, কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গানের সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছেছে। নজরুলের অসংখ্য গান তার জীবদ্দশায় চুরি হয়েছে, হারিয়ে গেছে, নামে বেনামে তার লাইন হুবহু নকল করেছের অনেকে, কিন্তু এসবের দিকে নজর দেননি নজরুল। কেউ তাকে এসব জানালে তিনি হেসে হেসে বলতেন, ‘‘দূর পাগল, মহাসমুদ্র থেকে ক’ ঘটি পানি নিলে কি সাগর ফুরিয়ে যাবে? আর নবাগতের দল এক আধটু না নিলে পানি পাবেই বা কী করে??”

মনে রাখতে হবে, তার সাহিত্য জীবন এর বয়স মাত্র পচিশ বছরেরও কম। মৃত্যু অবধি যদি তিনি লিখে যেতেন, তবে অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকতো? ভাবা যায়?
চলবে.......................................
আগের আরও তিন পর্ব - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১১ বিকাল ৩:০৭
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×