বাসাটা ভীষণ নিরিবিলি ।
আগে না জানলে বিশ্বাস করতাম না এখানে মানুষ বাস করে । অথচ শহরের সব মানুষ জানে এখানে মানুষ থাকে । বিশেষ একজন মানুষ ।
গত সাতদিন হয়ে গেছে , পত্রিকায় দেবার মত একটা খবরও পাইনি । মানুষ সাধারণত খুন আর ধর্ষণের খবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে , সাতদিনে ভাগ্যে একটাও জোটেনি । আমার দুরাবস্থা দেখে ভার্সিটির এক বড়ভাই এই বাসার খবরটা দিলেন - ভালো একটা স্টোরি হতে পারে বিজয় দিবস সংখ্যার জন্য ।
আঁধারের রেশ চোথে সয়ে আসতেই চোখে পড়ল বারান্দার রংচটা ইজিচেয়ারটা । পাশে অযত্নে পড়ে থাকা ক্যাকটাসের টব , কিছু সুতো , একটি গ্লাস ।
চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম আমার সামনে একজন পৌড়া দাঁড়িয়ে । পোড় খাওয়া চেহারার একজন মহিলা , পরনে সাধারণ শাড়ি ,লাল আর তীব্র একজোড়া চোখ । আশ্চর্য , আমি কোন শব্দ পাইনি , কখন এলেন ?
ইনি সম্ভবত শহীদ আরিফের স্ত্রী । আমি সালাম দিয়ে পরিচয় জানালাম । বললাম আমার আসার উদ্দেশ্য । অবাক হলাম মহিলা বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলেন না , যেন আগে থেকেই জানতেন আমি আসব ।
'ভেতরে আসুন , আমি মা কে ডাকছি' - কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো যেন বহুদূর থেকে শুনছি ।
আমি আলতো পায়ে মহিলাকে অনুসরণ করলাম । ছোট্ট বসবার ঘর , একরকম আসবাবহীন বলা চলে । দেয়ালের প্লাস্টার উঠে গেছে জায়গায় জায়গায় , একটা পুরনো ক্যালেন্ডার , পুরনো ধূলোপড়া বুকসেলফ , হাতে বানানো একটা ওয়ালম্যাট আর বসার জন্য দুটি চেয়ার । চেয়ারগুলিও জরাজীর্ণ , আমি বসতেই প্রতিবাদ জানালো সশব্দে ।
আমি অলস সময়টা বুকসেলফের দিকে তাকিয়ে পার করার চেষ্টা চালালাম । একটা পেপারও নেই , চা-নাস্তা আশা করাটাও বৃথা মনে হচ্ছে ; সাংবাদিক পরিচয়ে অন্তত এককাপ চা আমার সব জায়গায় প্রাপ্য , এখানে তা পাবো বলে মনে হচ্ছে না ।
'আপনার চা নিন '
আমি দ্বিতীয়বারের মত চমকালাম । সাদা কাপ হাতে দাঁড়িয়ে মহিলা , আগের মতই ; ভাবলেশহীন , অনুজ্জ্বল ।
'ধন্যবাদ'
'মা কে ডেকেছি , আসছেন' - ভেতরে চলে গেলেন মহিলা ।
আমি মনে মনে প্রশ্নোত্তরপর্ব গুছিয়ে নিতে থাকলাম । আমার মত পার্টটাইম সাংবাদিকদের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় , সঠিক প্রশ্ন করা । তার ওপর মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীণ , কাজেই আরো সাবধান থাকতে হবে ।
দরজা ঠেলে যে বৃদ্ধা প্রবেশ করলেন তাকে দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না । আমি ভেবেছিলাম সন্তানহারা উদভ্রান্ত কোন মস্তিষ্কবিকৃত মহিলাকে দেখব , মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারাবার বেদনায় ন্যুজ্ব একজন মানুষ । কিন্ত , বৃদ্ধাকে দেখে আমি সম্পূর্ণ হতাশ হলাম এই স্টোরি চলবে না ।
হাসিখুশি একজন মানুষ যাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় , সাদা শাড়ি , সাদা চুল ... চেহারা বলে দেয় মহিলা সুন্দরী ছিলেন একসময় । দুচোখ বেয়ে মায়া উপচে পড়ছে ... চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা । একেবারেই বেমানান এ ড্রয়িংরুমের সাথে ।
'কেমন আছো , বাবা ? ' আমি কিছু প্রশ্ন করবার আগেই মহিলা বলে বসলেন ।
আমি আচমকা প্রশ্নে একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম । আমার খানিকটা ভয়ও করতে লাগল ।
'দেখেছ, রানু , একদম আরিফের মত চেহারা । তুমি আরিফের বন্ধু ? "
আমি কি উত্তর দেব এ প্রশ্নের ? এ প্রশ্নের কি কোন উত্তর আদৌ আছে ? আমি মাথা নাড়ালাম ।
" আচ্ছা , আরিফ কবে আসবে বলতে পারো ? তোমরা তো ওর বন্ধু , জানো ও কোথায় আছে ?"
আমি গলা পরিস্কার করার চেষ্টা করি , ' জ্বি....জ্বি , আছে , ভালো আছে "
"সেই কবে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল , আর কোন খবর নেই ....রানু , চিঠিটা কই........ চিঠি দেখবে ?"
আমি মাথা নাড়ালাম । এ আবেদন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই ।
২.
আমার হাতে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া সাদা কাগজ , আজ খেকে উনচল্লিশ বছর আগে এক মা'কে লেখা সন্তানের শেষ চিঠি ।
গোটা গোটা অক্ষরে ভরে আছে পাতাটা । আমি খুব সাবধানে খুললাম । জানি , কোণায় কালো হয়ে যাওয়া ঐ দাগটা রক্তেরই হবে ।
মা ,
কেমন আছো , তুমি ? রানু কেমন আছে ?
আমি আত্রাইতে , আজই এলাম । বাবুভাই , আমি , আমরা আর ও সতের জন । একটা অপারেশন আছে ।
তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না মা , আমি ভালো আছি । আমার কোন সমস্যা নেই । আমার জন্য দোয়া করো । রানুকে বলো চিন্তা না করতে । খুব বেশি খারাপ অবস্থা হলে মামাবাড়িতে চলে যেও । ওদিকের অবস্থা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে ।
আমি ফিরে আসব , মা । তুমি আমার জন্য কাউন কিনে রেখো , তোমার হাতের পায়েশ খাই না অনেকদিন ।
অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিলো , আজ আর সময় নেই ।
- তোমার আরিফ
আমি হতবাক হয়ে বসে থাকলাম । চিঠিটাতে এমন কিছু ছিলো যা আমার সব মুখের কথা কেড়ে নিলো ।আমি যেন অসামান্য কোন চিত্রকর্ম হতে দাড়িয়ে । শিল্পীকে এই চিত্রটি আঁকতে হয়েছে নিজের রক্ত দিয়ে ।
আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে খাকলাম মহিলার দিকে । নিজের মনে আবোল তাবোল বকে চলেছেন হাস্যমুখী বৃদ্ধা , হয়তো বলছেন তার কাউনের পায়েশের কথা , হয়তো বলছেন আরিফের ঘুড়ি উড়াবার নেশার কথা , হয়তো বলছেন আর একমাত্র সন্তানের প্রথমবার সিগারেট টানতে গিয়ে ধরা পড়বার ঘটনা ......
আমি শুনতে পেলাম না কিছুই । আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি খুব ভুল একটি সময়ে ভুল জায়গায় চলে এসেছি । আমি এখানে স্টোরি কভার করতে এসে একটি মাকে মনে করিয়ে দিয়েছি তার আদরের খোকা কখনোই ফিরে আসবেনা তার পায়েশ খেতে । আমি এক বিধবা স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছি তার প্রিয়তমের ছবি বুকে নিয়ে কাটানো দুঃসহ উনচল্লিশ বছরের কথা ।
"বাবা , ও ফিরে আসবে তো ? "
আমি জলভরা চোখে মাথা নাড়ালাম ।
" দেখেছ , রানু , আমি বলেছিলাম না ? বাবা , তুমি খোকাকে একটু বলে দিও ও যেন তাড়াতাড়ি আসে , আমরা ভীষণ চিন্তায় থাকি ওর জন্য "
আমি ভীষন ভুল জায়গায় চলে এসেছি । মানসিক ভারসাম্যহীণ এই বৃদ্ধা এখন থেকে আরও আশায় বসে থাকবেন তার সন্তানের জন্য । আমার মত হাজারো মানুষের মুখে খুজবেন তার সন্তানের চেহারা । পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই তাকে বিশ্বাস করায় , তার প্রাণপ্রিয় খোকা আর কখনোই ফিরে আসবে না ।
এ আমি কি করলাম ?
" মা , আপনার খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে ..."
আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করলেন রানু , শহীদ আরিফের বিধবা স্ত্রী । মা কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন তিনি ।
৩.
এক ঘন্টা পর ।
সেই নিরুজ্জ্বল ড্রয়িংরুমে মুখোমুখি বসে আমি আর রানু ।
আমি গল্প শুনছিলাম । এক ছেলেহারা মা , এক স্বামীহারা স্ত্রীর গল্প ।
শহীদ আরিফ মারা যান ২৩শে জুন , ১৯৭১ সালে , নওঁগা জেলার আত্রাই থানায় । পাক হানাদারদের এক কোম্পানি সৈন্যের সামনে পড়ে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা , বেঁচে ফেরেনি কেউই । আরিফ মারা যান ব্রাশফায়ারে , কবর দেবার জন্য লাশ নিতে আসেনি কেউ । লাশ পড়ে ছিল , একসময় বন্যার পানিতে হারিয়ে যায় চিরতরে ।
" মা এখনও মেনে নিতে পারেনি ও আসবে না ।" চোখের কোণ মুছতে মুছতে বলেন রানু ।" আমিও পারি না, এত বছর হয়ে গেল ; এখনো মনে হয় দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে তেজী , আমুদে মানুষটা , আমাদের নিয়ে যাবে এই নরক থেকে "
আমার বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ।
"শেষবার যাবার সময় বলে গিয়েছিল , 'রানু , তোমার জন্য এবার একটা লাল শাড়ি নিয়ে আসব' .... আমি তখন নতুন বিয়ে করা বউ , যাবার সময় একটুকুও কাঁদেনি ...মনে হচ্ছিল বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যাচ্ছে , এই ফিরে আসবে ................"
" এখন আপনাদের সংসার চলছে কিভাবে ? " আমি নরম গলায় জিঞ্জাসা করলাম ।
" ও মারা যাবার পাঁচ বছর পরে আমি একটা স্কুলে চাকরি পাই। এখনও করছি । এই বাড়িটা আছে ...... দুজন মানুষের চলে যায় "
আমি বুঝিনি আমি অর্বাচীনের মত একটি প্রশ্ন করতে যাচ্ছি । আমি প্রশ্নটা কোন কিছু ভেবে করিনি , নিছক কৌতুহল থেকে করা । কিন্তু আমি এমন একটি উত্তর পাব জানলে , আমি কখনোই এ প্রশ্নটা করতাম না ।
"৭১ থেকে ৭৬ , এ সময়টা ?"
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে খাকে আগুনরাঙ্গা একজোড়া চোখ .....ধীরে ধীরে আমি অশ্রুতে ভরে যেতে দেখি একজোড়া চোখকে । একটিও বাক্য বিনিময় না করে আমি পেয়ে যাই সকল প্রশ্নের উত্তর , একজন দক্ষ সাংবাদিকের মত ।
আমার ইচ্ছা হয় আমি ছুটে পালিয়ে যাই , আমার ইচ্ছা হয় আমি পালিয়ে যাই বনে , যেখানে আমাকে কেউ দেখতে পারবে না , আমার ইচ্ছা হয় আমি টুকরো টুকরো করে ফেলি নিজেকে ..... ছিন্নভিন্ন করে ফেলি এই দেহ , যাতে এই চোখের সামনে আমাকে কোনদিন দাঁড়াতে না হয় । প্রভু , আমার ক্ষমতা নেই এই চোখজোড়ার সামনে দাঁড়াবার ।
"আমি আসি "
আমি শুধু এটুকুই বলে চলে এলাম । পালিয়ে এলাম । আমার সাধ্য নেই ফিরে যাই ঐ অভিশপ্ত বাড়িতে .... সাধ্য নেই দাঁড়াই ঐ মা এর সামনে , ঐ স্ত্রী এর সামনে .. আমার সাধ্য নেই ।
যেন আমি সেই মুক্তিযোদ্ধা আরিফ .... নতুন বউ এর জন্য আজও লাল শাড়ি খুঁজছে সে , মায়ের হাতের প্রিয় পায়েশ খেতে আজও ফেরা হয়নি তার ; আজও যে স্বাধীনতা খুঁজছে ।
একজন পরাজিত মুক্তিযোদ্ধা ।
[ এই লেখাটি শহীদ আরিফ ও তার মত আরও ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও তাদের পরিবারবর্গের মহান আত্নত্যাগের প্রতি উৎসর্গ করছি ]