"আমি কখনো আয়না দেখি নি। নিজের ঠোঁট-নাক-কান কেমন তা হাতড়ে-আঁচড়ে যতোটুক বুঝতাম, ওতেই দিন চলে যেতো। ওর চেয়ে বেশি বোঝার চেষ্টাই করি নি কখনো। কি দরকার নিজেকে এতো চেনার? যতোই চিনবো ততোই তো অসহ্য লাগবে। কখনো কখনো কিছু নতুন বা পুরনো আঁচড়ের ছাপ হয়তো ঢেকে যেতো সময়ের পরতে পরতে। আমি বুঝতেও পারি নি। অচেনা আমার সাথে একটা মোটামোটি সখ্য করে দিন কাটাতাম। "
"হঠাৎ হঠাৎ যে পানিতে নিজের ছায়া দেখি নি তাও কিন্তু না। দেখতাম আর চমকে উঠতাম, ভয় পেতাম। ছায়ার চোখটা আমার দিকে বড়বড় করে তাকাতো। ভেতরের সব দেখতে চাইতো বোধ হয়। আমার সেই ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে গা শিরশির করতো। মনে হতো প্রচণ্ড শীতে একটুকরো বরফ আমার খোলাপিঠ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে; গলছে, জমছে, চেপে বসছে। আমি কাঁপতাম। কাঁপতে কাঁপতে পা দিয়ে পানি এলোমেলো করে ঝাপসা করে দিতাম ছায়াটার চোখ। পিঠ থেকে বরফ অদৃশ্য হয়ে যেতো সাথে সাথে; কিন্তু ঠাণ্ডাটা চলে যেতো না। আমি আগুনের উপর নিজেকে মেলে ধরতাম। পিঠ বাঁকিয়ে হাঁটুতে মাথা গুঁজে নিজেকে গুটিয়ে বসতাম গরম আঁচে। শীতটাও নিজেকে গুটিয়ে আনতো আমার মতো। একটু পর শীত বাষ্প হয়ে গেলে আমি আবার আয়নাহীন পৃথিবীতে ফিরতাম।"
"অনেকের চোখেও নিজেকে দেখেছি। চকচকে পানি টলটল চোখের ভেতরে আমার মুখটাও উঁকি দিতো। আমি আয়না-চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেকে দেখতাম। ওর চোখের টলটলে কষ্ট অগ্রাহ্য করে নিজের কষ্ট-হতাশা খুঁজতাম। খুঁজে না পেলে স্বস্তি পেতাম, আর একটু পশলা বৃষ্টি দেখলে ওটার প্রতিকার খুঁজতাম। ওর চোখটা আমার একটুখানি সান্ত্বনার জন্য টলটল করতো, আকুতি করতো। গুঙিয়ে উঠতো মাঝে মাঝে। আমার ভেতরে ওসব অহেতুক কিছুই ঢোকে নি। আর ঢোকে নি বলে আমার কখনো এতোটুকু অনুতাপ হয়নি তো! আমি ভাল-ই ছিলাম সবসময়। ঐ কষ্টে-পাওয়া আয়না-চোখটা বন্ধ হয়ে গেলে আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখা শুরু করতাম।"
"এতো ধরনের আয়না দেখেও নিজেকে কখনো ভাল লাগে নি। সিনডেরেলার দুষ্টু মা'র মতো মনে হয় নি, আমি-ই সবচেয়ে সুন্দর। বরং শতশত ক্ষত-আঁচড়-জ্বলা-পোড়া মুখটা দেখে বোবা হয়ে যেতাম। মুখটা ঘষে-মুছে দাগ মুছতে গিয়ে আরো দগদগে করে দিতাম।"
"আমার আয়নাহীন জীবনে হঠাৎ খুব নক্সাকরা একেবারে রূপকথার গোলগাল একটা আয়না এসে পরলো। ওতে তাকালে স-ও-ব দাগ মুছে যেতো। অদ্ভুত এক আলো-আভায় ভেসে যেতাম আমি। বরফ করে দেয়া চোখটা কেমন হরিণের মতো মায়া নিয়ে তাকাতো। দাগে ভরা গালটা কেমন নিটোল হয়ে গেলো। আয়নাটা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না আমি। মুখ হাতড়ে একটু আঁচড় পেলেই আয়নার সামনে বসতাম আমি। ওমনি দাগ মুছে একেবারে তাজা পাঁপড়ির মতো নরোম হয়ে যেতো!"
"আজকে হঠাৎ আমার আয়নাটা ঝনঝঝন ভেঙে পড়লো।"
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:২৩