***
লাল টকটকে রিবনটা দিয়ে চুলগুলোয় শক্ত বাঁধ দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে দেখে ইশারা... নাহ্! সহজে খুলবে না উচ্ছৃঙ্খল চুলগুলো! গতকাল চুল দিয়ে চোখ ঢেকে গেল তারপরই তো হলো ঝামেলা! পা থরথর করে কাঁপছে কেন! নিজেকে বোঝায়... এখানে সবাই তোমাকে নতুন চেনে। ভয় ঢাকো নাহলে যাবে কোথায়! কেন ভুলে যাও সবার কথা? নিজেকে কঠিন রাখো! যেভাবেই হোক! হালকা করে চিকন সাঁকোর পলকা বাঁশগুলোতে থরথরে হাতগুলো রাখে আর এক পা এক পা করে এগোয় ইশারা... নিচের পানির চোয়াল কড়কড়ে শব্দে প্রস্থে বাড়ে...জলদানবের ঠোঁটের হা বড় হয়। চিকন সাঁকোর বাহুগুলো খিঁচুনি ওঠা রোগীর মতো নড়তে থাকে... ইশারার গলা-পেঁচানো কালো গুটির মালায় ওর রক্তশূণ্য আঙুলগুলো জড়িয়ে যায়।
ফায়জুল নয়া আপার ঘরে উঁকি দেয়। জানে কাজটা ঠিক না, বকাও কম খায় নাই। তাও তার মনে হয় আপার ঘটনা আছে কিছু। সেটা না জেনে তার শান্তি নাই। আপা এইখানে বিদেশী অফিসে আসছে, গাঁয়ে নাকি "অডিট ফার্ম" না কি একটা বানাবে এরা। চেয়ারম্যান সাব একটা পাকা ঘর দিসেন আপাদের জন্য। আপারা সবার মতো না, এটা ফায়জুল জানে। কিন্তু সমস্যা বুঝে না ঠিকমতো। "এ্যাই ফায়জুল! আবার আসছিস তুই!"... ইশারার চিৎকারে কয়েক সেকেন্ড একটু থতমত খায় ফায়জুল। দরজার পেছনে মাথা লুকায়। ইশারা সটান সামনে এসেই দাড়ায়, ভুরুগুলো ভীষন এলোমেলোভাবে কুঁচকানো।
- আচ্ছা বলতো তুই আমাদের ঘরে কেন আসিস ? কিছু চাস ? খাবি কিছু ?
- না
- তো ? কারো ঘরে এভাবে তাকাতে হয় না। এটা অভদ্রতা। বাড়িতে শিখায় নি ?
ফায়জুল মাথা নিচু করে আঙুল দিয়ে খড়খড়ে মাটি খোঁটে... প্রায় ফিসফিসিয়ে ওঠে...
আপা, আমার বাপজান বিরাট কবিরাজ। আপনার সমস্যা তারে বলেন।
ইশারা চমকে তাকায়, আমার কি সমস্যা ?
- জানি না।
- তাহলে বললি কেনো ?
- জানি না। বাপজানের কাছে যাবেন ? বাড়ি বেশি দূরে না আমার।
ইশারা ছেলেটাকে দেখে একটু সময় নিয়ে। বছর বারোর এই মায়া মায়া চেহারার শ্যামলা ছেলেটা এখানে আসার পর থেকেই নানান ভাবে তাকে সাহায্য করতে চায়, এটা-ওটা এনে দেয়। সে প্রথমে কিছু বলে নি। তবে এখন মনে হয় বলা প্রয়োজন।
- তোর কেন মনে হলো আমার সমস্যা ?
- আপনে পানিরে ডরান। নাওয়েও উঠেন না।
- আমি সাঁতার জানি না তাই ডরাই
- না। আপনার অন্য সমস্যা আছে।
- তোকে কে বললো ?
- দেখসি
- কি ?
ফায়জুল সোজা কিন্তু কড়া চোখে ইশারার দিকে তাকায়... " কি আপনে জানেন না ?" ইশারা কিছু বলার আগেই ফিসফিস ওঠে আবার..." আমি পাশেই থাকি, যখন চান ডাক দিবেন... আমি জানি, স-ও-ও-ও-ব জানি।" ইশারা কিছু বলার আগেই দৌড় লাগায় ফায়জুল। প্রায় নিভু নিভু আকাশের দিকে তাকিয়ে ইশারার গায়ে হালকা কাটা দিয়ে ওঠে।
***
আমি পানিতে নামি যখন আকাশ গুলে কালো কালি ছড়ায়... পানির দানব ঘুমিয়ে গেলে আস্তে আস্তে পানির হাউজটায় নিজেকে ছেড়ে দেই।কালো পানিগুলোর শিরশিরে বিচরন খারাপ লাগে না আমার। সন্ধ্যায় আমাদের দলের বাকিরাও ফিরে আসে ঘরে। এখানে রাত আটটা না বাজতেই নিশুতি। ঘুমে ঢুলুঢুলু হারিকেনের সলতেগুলো উস্কে দিতে হবে। আজকে সময় যাচ্ছেই না। বাকিরাও এসে পৌঁছায় নি কেউ। আমরা দলে সাতজন ছিলাম, এখন পাঁচজন। প্রত্যেকেই আলাদা, আবার প্রত্যেকেই একরকম। সেজন্যেই আমরা একসাথে থাকি। যেকোনো বিপদে নিজেদের ভয়গুলো ঢেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। আলাদা হলেই আমাদের বিপদ। রবিন আর সারাহ্কে মেরে ফেলেছে আগের জায়গার মানুষগুলো। ওরা নাকি খারাপ আত্মা! এখন আমি, মৌ, টুশি, রাকিব আর জাহিদ আছি। আমরা আমাদের প্রত্যেকের দানবদের চিনি। আর মানুষদের থেকে নিজেদের বাঁচাতে জানি। নিজেদের অডিট ফার্ম আছে আমাদের। এই ক্যামোফ্লেইজের ভেতর গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াই, নিজেদের রং বদলাই। কালো, সবুজ, কমলা... ঘর পালিয়েছি বহু আগেই। এখন ঘরের কেউ খবর নেয় না।
সাইকোলজির ভাষায় আমাদের বলে "ফোবিক"। আমরা নাকি নিজেদের ভেতর চিন্তা করে আলাদা একটা ভয়ের পৃথিবীতে থাকি! আমাদের দানোগুলো আমাদের নিয়ে মোমপুতুলের মতো খেলে যায়। আমরা নাকি কেউ পানির, কেউ আঁধারের বা কেউ আগুনের দানোর ভয়ে থাকি! তবে আমি কেন জলদানবের দাঁত দেখি ? তার নখের খসখস শব্দ শুনি, তার ভারী গরম নিঃশ্বাস পাই ?? পানির কালো শিরা-উপশিরায় নিজের মৃত্যু দেখতে পাই! মৌকে আঁধারের দানব মেরে ফেলতে চায় শ্বাসরোধ করে, মৌ সেই দানোর নখের আঁচড় দেখায় ওর শরীরে। অন্ধকারে কোন এক অশরীরী পিচ্ছিল দেহের সাপ ওর গা বেয়ে ওঠে, পেঁচিয়ে মেরে ফেলতে চায় ওকে। মৌয়ের গোঁ-গোঁ শুনলেই আমরা বাতি জ্বেলে ওকে বাঁচিয়ে দেই। টুশিকে কেউ ছুঁতে পারে না। ও দেখে সবার নোংরা-ঘিনঘিনে হাতগুলো ওকে হাতড়ে হাতড়ে শেষ করে দিচ্ছে! দানোর ছোঁয়া পেলেই ও মৃগীরোগীর মতো তড়পায়! রাকিব আগুনের মাঝে ওর দানোকে দেখে। আগুনে-দানব ওকে অনেকবার শেষ করে দিতে চাইলেও আমরা বাঁচিয়ে দিয়েছি। জাহিদ ব্যথা ভয় পায়। যেকোনো ব্যথাই ওর কাছে হাজারগুণ তীব্র হয়ে বিঁধে। আমরা ওকে ব্যথা পেতে দেই না। আমরা সবাই সবার দানব থেকে সবাইকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। আপ্রান চেষ্টা।
হারিকেনের টিমটিমে আলোতে ঘরে এক এক করে ঢোকে ওরা। প্রত্যেকে সতর্ক, সচেতন। জাহিদ ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলে, "এখান থেকে যেতে হবে ইশারা। আমার ভাল লাগছে না অবস্থা!" মৌ মাথা নাড়ে, "গ্রামের এক কবিরাজ নাকি আমাদের দোষে ধরা বলে দিয়েছে শুনলাম।" ইশারা চমকায়, "ফায়জুল!" জাহিদের চোখে প্রশ্ন দেখে ইশারা বলে, "একটা দশ-বারো বছরের ছেলে। আমাদের ঘরের এদিক দিয়ে ঘোরাঘোরি করে। বলে আমার নাকি সমস্যা আছে। পানি দেখলে ভয় পাই।" রাকিব আৎকে ওঠে, "আরে! দেখ ঐটাই ছড়িয়েছে ঐসব!" ইশারা বলে, "ওর বাবা কবিরাজ।" এবার মুখ খোলে টুসি, "আমাদের যেতে হবে ইশারা। রবিনদের পর আমরা আর রিস্ক নিতে পারি না।" সবাই চুপচাপ খেয়ে নেয়। রাতে এক ঠিকে ঝি এসে সব পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। তাকে যেতে দেখে ফায়জুল ঝট করে মাথা নামায় জানালার পাশ থেকে। বাবা আর চেয়ারম্যান তাকে এদের ওপর চোখ রাখতে বলে দিছেন বারবার করে। সে দায়িত্ব এড়ায় না।
সকালে চেয়ারম্যানবাড়িতে একটা বৈঠক হয় গ্রামের তিন মাথাকে নিয়ে। চেয়ারম্যান, কবিরাজ আর স্কুলের মাস্টার। আরো একজন থাকে সেখানে। ছায়ার মতো বিশ্বস্ত। ফায়জুল। চেয়ারম্যান নড়ে ওঠেন, "আপনারা ফায়জুলের থেকে সব-ই শুনছেন। ঐ পোলা-মাইয়ারা দোষে-ধরা। আমরা তাগোরে আমাগো রাস্তায় চিকিৎসা দিবো, নাইলে তাগো গেরাম ছাড়তে হৈবো।" কবিরাজ মাথা নাড়ে, "তা তো অবশ্যি! দোষে ধরা মানুষ গেরামের জন্য বিপদের।" মাস্টার কিছু না বলে বেশ বিরক্ত হয়েই বসে থাকেন। চেয়ারম্যান বলে, "মাস্টার আমাদের অঞ্চলে নতুন, তাই এসব জানেন কম। আপনারে আমার লোকেরা বুঝায় দিবে সব আস্তে আস্তে। আমরা আজ সন্ধ্যায় যাবো ওগো ঘরে। সবাইরে মশাল নিতে বইলা দিবা। আর কবিরাজ, দুপুর নাগাদ একটা গাঁও-বন্ধন দিবা। এখন আপনারা আসেন।" কবিরাজ মাথা ঝাকায়। আসর ভেঙে যায় তখনের মতো।
সন্ধ্যায় ওরা নিজেদের ব্যাগ-প্যাক গুছিয়ে তৈরী হয়ে নেয়। আজ রাতে রওনা দিবে। হঠাৎ অনেক মানুষের গমগমে শব্দে রবিনদের সময়টা চোখে থরথরায় সবার। ইশারা বেশ ঠান্ডা মাথার মেয়ে। রাকিব,জাহিদ আর টুশিকে ভেতরে রেখে ও আর মৌ বের হয়ে আসে। ওদের দানোরা এ সময় শক্তি পায়। বের হয়েই দু'জনের পা গেঁথে যায় মাটিতে। প্রায় কয়েক'শ মানুষ, আগুন হাতে কিসব বলতে বলতে আসছে। সবার সামনে ফায়জুল, ওর বাবা, মাস্টার আর চেয়ারম্যান। ওরা কাছে আসলে ইশারা তেজের সাথে জ্বলে ওঠে, "কোন সমস্যা হয়েছে?" চেয়ারম্যান বলে, "তোমাদের চিকিৎসা করবেন আমাদের কবিরাজ। আমরা যা বলি করো।"
- আমাদের কোন অসুখ নাই। চিকিৎসা কেন লাগবে?
- যা বলি করো মেয়ে। তোমরা দোষে ধরা। তোমরা সবাই।
- মাস্টার স্যার, আপনিও এসব বিশ্বাস করেন ?
মাস্টার ইশারার কথায় মাথা নিচু করে বলে, "মা, চিকিৎসা না করলে গ্রাম ছাড়ো। তোমাদের সময় ভাল না।"
ইশারার কাঁধের পেছন থেকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঁকি দেয় রাকিব, জাহিদ আর টুশি। রাকিবের দানো ওকে দেখেই দাউদাউ করে ওঠে মশালগুলো থেকে। আগুনে-দানোর নখগুলো এঁকে-বেঁকে তেড়ে আসে রাকিবের দিকে। রাকিব তীব্র-রগছেঁড়া চিৎকারে দানোকে ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। জাহিদ আর টুশিও তাদের দানোদের মুখ-নখ-চোখ দেখে পুরোপুরি ভড়কে যায়। দানোগুলোর গরম নিঃশ্বাসের তান্ডবে ওদের নাক-মুখ পুড়ে যেতে থাকে। নিজেদের ঢেকেঢুকে কোনরকমে ভেতরে ঢুকে যায় ওরাও। ইশারা একটু থমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। শক্ত করে দরজার সামনে মৌয়ের হাত ধরে দাড়ায় আর গলা উঁচিয়ে বলে, "আমার বন্ধুরা ভয় পেয়েছে। আপনারা বললে আমরা এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো। আজকে রাতেই। আপনারা ভুল বিশ্বাসে আমাদের ক্ষতি করবেন না। আমাদের কোন দোষ নেই। আমরা আগুন ভয় পাই কারন আমাদের দু'জন বন্ধুকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আমাদের মানসিক অবস্থা ভাল না। আপনারা আমাদের বাধ্য করে কোন ভুল চিকিৎসা দেবেন না।" মাস্টার চেয়ারম্যানের সাথে পরামর্শ শেষে দলের বাকিদের সাথে কথা বলে স্বিদ্ধান্ত নেয় তারপর মাস্টার এগিয়ে আসে ইশারার দিকে, "তোমাদের গ্রাম ছাড়তে হবে। আজকে, এ মুহুর্তে। গ্রামের মানুষ দোষে-ধরা মানুষ তাদের অঞ্চলে রাখবে না।" ইশারা কিছুটা আশা পেয়ে প্রায় সাথে সাথেই বলে, "আমরা এক্ষুণী চলে যাবো। তবে আপনাদের মশাল সরিয়ে ফেলতে হবে, ভিড় কমাতে হবে। আমরা আমাদের মতো সব গুছিয়ে চলে যাবো। আপনারা এমনভাবে থাকলে আমার দলের বাকীরা ভয় পেয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস করুন। আপনাদের বিশ্বাসভাজন কাউকে রেখে যান। আমরা তার কাছে ঘরের চাবি আর অন্যসব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।" চেয়ারম্যান মাস্টারের কানে কথা গুঁজে দিলে মাস্টার বলে, "কবিরাজ আর ফায়জুল থাকবে। আর গ্রামের পাহারাদারদের থেকে থাকবে কয়েকজন। তোমাদের জন্য মশাল নিভিয়ে দিতে বলা হয়েছে।"
এর প্রায় আধ ঘন্টার মধ্য ইশারাদের পাঁচজনের দলটা জড়াজড়ি করে বের হয়। একে অন্যের দানোগুলোকে দাবিয়ে দিয়ে বাঁচার জন্য রং বদলায় ওরা। ওদের দানোগুলো তীক্ষ্ণ নখর বুঁজে ঘুমিয়ে নেয় বোধহয় সেসময়টায়।
***
ইশারাদের দলটা গ্রামের বন্ধন দেয়া এলাকা পাড় হতেই মশাল জ্বালায় কবিরাজ। ঠিক সাথে সাথেই কবিরাজের শক্ত হাতটা আঁকড়ে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে ফায়জুল! ওর টলটলে চোখে মশালের শিখার পেঁচানো নখগুলো প্রতিফলিত হয়ে বিষিয়ে ওঠে...কাঁপতে কাঁপতে চোখ ঢাকে ফায়জুল... গলা দিয়ে কোনমতে শিহরিত কয়েকটা শব্দ ছিটকে ওঠে... "বাপজান! দানো! দানো!"