দলীয় সরকার ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ছয়টিই অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিন জোটের আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হয়। প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়; যদিও জাতীয় পার্টি ও তার নেতাদের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
একানব্বইয়ের নির্বাচনের পর শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয়। ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন বিএনপি বিরোধী দলের দাবি উপেক্ষা করে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই এ নির্বাচন হয় এবং তাতে বিএনপি জয়ী হয়। বিরোধী দলের চাপে পড়ে বিএনপি সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এদিকে মার্কিন দুই সিনেটর রিচার্ড লুগার ও ক্লেইবর্ন পেল-এর হস্তক্ষেপে পর্দার আড়ালে চলে সমঝোতা। ২৯ মার্চ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে যায়। ৩০ মার্চ বিএনপি সরকার ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে। সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১২ জুন সব দলের অংশগ্রহণে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ও পরে সংগঠিত কর্মকাণ্ড সবাইকে অবাক করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত ও বিপুল ভরাডুবির স্বীকার হয়। শেখ হাসিনা নির্বাচনে স্থূল কারচুপির অভিযোগ আনেন। তারপর ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। প্রথমে ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদের সরকার, পরে ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ নেতৃতাধীন সরকার। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ নেতৃতাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের কাঠামো ভেঙে সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটায়।
সংবিধানের কোথাও তো নেই যে, ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে?
সংবিধানে না থাকলেও তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা নির্বাচন কমিশনের বিধিমালায়
উল্লেখ আছে।
একটু আগেই বলছিলাম, ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ নেতৃতাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘ সময় ধরে জরুরি অবস্থা জারি রেখে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার চর্চা করে। জাতীয় নেতাদের আটক, নামমাত্র দলের উত্থান আর স্থানীয় সরকারের ধুয়া তুলে। এরপর ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮-এ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর তারা ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ত্রয়োদেশ সংশোধনী বাতিল করে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে বিলুপ্ত হয়।
বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতা বলেছেন, সংসদে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিল উত্থাপন করলে তারা আলোচনায় যেতে রাজি। আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজিনা সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যে বোঝা যায়, সরকার এরই মধ্যে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার জন্য অনানুষ্ঠানিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ও তরিকুল ইসলামের কথানুসারে তাদের দাবি অনেকটা ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’-এর মতো। এ অবস্থায় আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আলোচনা হতে হবে প্রকাশ্য। আমার মতে, দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সংলাপ হতে হবে সঙ্গোপনে। আলোচনা যত প্রকাশ্য হবে, সফলতার সম্ভাবনা তত কম থাকবে। এক্ষেত্রে নিনিয়ানের
সংলাপ দৃষ্টান্ত হতে পারে।
এ সমঝোতার উদ্যোগে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সমঝোতার লক্ষ্যে বিদেশী বন্ধুদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, নচেত্ একাধিক নির্বাচন হতে পারে। ১৯৯৬ সালে অংশগ্রহণবিহীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় মার্কিন দুই সিনেটর রিচার্ড লুগার ও ক্লেইবর্ন পেল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ওই বছর ২৯ মার্চ তাদের দেয়া এক পৃষ্ঠার চিঠিতে তিনটি সুপারিশের উল্লেখ ছিল। ১. বিদায়ীদের জানমালের নিরাপত্তা; ২. এরশাদের নিঃশর্ত মুক্তি; ৩. সব নির্বাচন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দ্বারা নিরীক্ষিত হবে। অন্যথায় তা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
পরের দিন খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে বিজয়ীর বেশে জাতীয়তাবাদী মঞ্চে ওঠেন। আওয়ামী লীগ নেতারা আরোহণ করেন জনতার মঞ্চে আর জামায়াত নেতারা কেয়ারটেকার মঞ্চে। পেছনে কাজ করে আন্তর্জাতিক শক্তি। উল্লিখিত দুই মার্কিন সিনেটর ১৯৮৫-’৮৬ সালে ফিলিপাইনে ক্ষমতার পালাবদলের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে শেখ হাসিনা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। যেটাকে বলে ‘Incommunicado’। তখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আটলান্টা থেকে শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। জিমি কার্টার শেখ হাসিনাকে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার অধ্যাপক আলী আশরাফের কাছে শপথগ্রহণের ব্যাপারে রাজি করান।
শোনা যাচ্ছে, ভারতও এ ব্যাপারে সমঝোতার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কী?
নিতেই পারে। ষাটের দশক পর্যন্ত পৃথিবী দুই প্রভাববলয়ে বিভক্ত ছিল। একটা সোভিয়েত শিবির, আরেকটা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব। ভারত ছিল সোভিয়েত শিবিরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীর কর্তৃত্ব এখন মার্কিনীদের হাতে। তাই নতুন বাস্তবতায় ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তারা কোনোভাবেই সে সম্পর্ক এড়িয়ে যেতে পারে না।
একদিকে বড় দুই রাজনৈতিক দলের সম্পর্কের টানাপড়েন অন্যদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে হরতাল দেয়ার মাধ্যমে বাম দলগুলোর রাজনৈতিক সক্রিয়তা, আবার সিভিল সোসাইটির কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। এটা জাতীয় রাজনীতিতে ইঙ্গিত বহন করে কী?
বাম ও পেশাজীবী, সিভিল সোসাইটি নিজেদের অস্তিত্বের অবস্থান জানান দিচ্ছে বা জানান দেয়ার মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে এ ট্রানজিশন পিরিয়ডকে। ফলে সবাই এ স্পেসটাকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ সেরে নিচ্ছেন। নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটাই স্বাভাবিক। মুঘল আমল থেকেই ক্ষমতার পালাবদলের সময় এ ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়।
নব্বইয়ের দশক থেকে জোটবদ্ধ তাত্ত্বিক কোয়ালিশনের অস্তিত্ব দেখা যায়। ছিয়ানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ আ স ম আবদুর রবের জাসদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধে ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি চারদলীয় জোট বেঁধে নির্বাচন করে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে জামায়াতকে দুটি মন্ত্রণালয় দেয়া হয়। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলের সমন্বয়ে মহাজোট গঠন করে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে জিএম কাদের, জাসদের হাসানুল হক ইনু ও সাম্যবাদী দলের দিলীপ কুমার বড়ুয়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
এ অবস্থায় তৃতীয় শক্তির উত্থানের কোনো সম্ভাবনা আছে কী?
Fittest will survive. যারা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে।
১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার অধীনে নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। বিরোধী দলগুলো কেন সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না?
সে সময় ‘তীব্র জাতীয়তাবাদী জ্বরে তেতে ছিল দেশ’। সত্তরের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। তখন ছিল স্বাধিকারের প্রশ্ন; সরকার বদলের নয়। ওই নির্বাচনের আগেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। সত্তরের তুলনা এখন আনলে চলবে না, রাশিয়ার ভলগা, ভারতের গঙ্গা, বাংলাদেশের মেঘনা, যমুনার পানি গড়িয়েছে অনেক দূর।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আস্থাহীনতা ও অস্থিরতার ঘূর্ণাবর্তন— এটা কেন হচ্ছে?
ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি, তীব্র জাতীয়তাবাদী সংকট, ক্ষমতার পালাবদলের সময়ের অস্থিরতা নিজেরা মীমাংসা করতে পারছি না। ফলে আন্তর্জাতিক শক্তিকে আমন্ত্রণ
জানাতে হচ্ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
নতুন ফর্মুলার আলোকে নির্বাচন হতে পারে। আর সমঝোতা না হলে সেক্ষেত্রে একাধিক নির্বাচন হতে পারে।
এ অনিশ্চয়তা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কী?
কোনো দৈব ঘটনা ছাড়া সম্ভাবনা নেই। তবে আশা করতে দোষ নেই। বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণে সমঝোতা ও সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হামজা কামাল মোস্তফা
সংলাপ হতে হবে সঙ্গোপনে। আলোচনা যত প্রকাশ্যে হবে, সফলতার সম্ভাবনা তত কম থাকবে