পর্ব ০৪
ত্রিমাত্রিক
আধঘন্টা আগেও মুনীর ভাবে নি, সে এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আজকে এখানে আসবার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। পা দুটো কে ইচ্ছে মতো চলতে দিয়েছিলো সে, ভাবেনি এখানে নিয়ে আসবে তাকে ও দুটো।
গলিটার কোন কিছুই আর আগের মতো নেই, গাঢ় গোলাপী রঙের জারুল গাছ গুলো রোজ সকালে মুনীরের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো আগে। তখনও এতোটা লম্বা হয়ে ওঠেনি মুনীর, শাখা গুলোর নাগাল পেতে হলে মাথার নীল ক্যাপটা খুলে সেটা দিয়ে আঘাত করতে হতো গোছাগোছা ফুলের ভারে মাথা নোয়ানো ডালে। গাছ গুলো কৃপণ ছিলো, পকেট ভরে আস্ত আস্ত ফুল খুব কমই দিতো তারা, টুকরো টুকরো পাঁপড়ি আর বিচ্ছিন্ন পাতা ঝরে ঝরে পড়তো মুনীরের মুখের ওপর। ওরাও মুনীরকে নিয়ে খেলতো, কিন্তু তা সত্বেও তার সাথে গাছগুলোর সখ্য হতে দেরী হয় নি, কারণ প্রতিদিন ফুল পকেটে নিয়ে সামনে দাঁড়াবার ওর স্পৃহাটাকে বুঝে নিতে শুরু করেছিলো ওরা, আর এমন ভালোবাসাবাসির জন্য রোজ রোজ ফুল ফুটিয়ে যেতে পারার মধ্যেও আনন্দ আছে।
গলিটা প্রায় নগ্ন এখন। একসারিতে এগিয়ে যাওয়া জারুল গাছগুলো যে এইখানেই ছিলো, তার সাক্ষ্য দিতে দুটো ন্যাড়া মতো গাছ সন্ত্রস্ত হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে, কিন্তু মাঝ বর্ষার এই রাতেও ওদের সম্বল একটা মাত্র গোছায় কয়েকটা বিদীর্ণ ফুল।
তবুও এই গলিটার মুখে দাঁড়িয়ে মুনীর সেই সময়টায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ছুটে বেড়াচ্ছে, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাধবীলতার ফুল একটা একটা করে মুঠোয় গাঁথছে, ঢলঢল হাসিতে এলিয়ে পড়ছে, অভিমানে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে, একটা আবছায়া অবয়ব, আর অসংখ্য অসংখ্য প্রতিবিম্ব।
সময় কি থেমে গেছে এই গলি তে??
এটা বাস্তব নয়, মুনীরের চেয়ে ভালো তা কে বুঝবে?? তবু এই গলির ভেতর কারও জমাট বাঁধা অস্তিত্ব মুনীরের ভেতরটা নিরেট জমিয়ে দিয়েছে, একটুখানি শ্বাস ভেতরে পাঠাবার জায়গাও নেই।
জেবা !
মুনীর এক পা আগে বাড়লো, গলির ভেতরে ঢুকে পড়লো তার শরীর। ওর সমস্ত অস্তিত্ব যেন অন্য এক মাত্রায় প্রবেশ করলো, পেছনের পৃথিবীটা রয়ে গেছে আলাদা কোন এক মাত্রায়, আর মুনীর দাঁড়িয়ে আছে অপার্থিব এক ত্রিমাত্রিক জগতে। এই জগতে ওর সব আছে। ষোল বছরের হাস্যোজ্জল খলবলে মুনীর বার বার তেইশ বছরের অন্ধকারে আকন্ঠ নিমজ্জিত মুনীর কে পার হয়ে যাচ্ছে, আর ষোল বছরের বালকের বাঁ পাশটা খালি নয়, সৌম্য, শ্যামল একটা অবয়ব জড়িয়ে রেখেছে তার বাহু, বছরের প্রথম বৃষ্টির মতো প্রাণবন্ত হাসি দুজনের মুখে। পরস্পরকে ধরে রাখবার জন্যই যেন এই বালক - বালিকা জন্মেছে।
নিজের বাঁ পাশটা অসাড় হয়ে আসলো ওর, পঙ্গু মনে হচ্ছে নিজেকে।
মুনীর আরেক পা আগে বাড়লো।
অগণিত ঈষদচ্ছ অবয়বে চারপাশ যেন একটা অপার্থিব ত্রিমাত্রিক সমাবেশ। বাঁ দিকে, কিছুটা দূরে, চঞ্চল, দীঘল বালক ঘোরে কাঁপছে, শরীরে বর্ষার উথাল পাথাল জ্বর, সৌম্য বালিকা বুকের ধুকপুকানি ওষুধে সারিয়ে দিচ্ছে তাকে।
এক জোড়া ছায়ার মাথায় খটখটে রোদ, বালিকার চিবুকে গড়ায় তৃষিত চুমুকের থেকে স্খলিত জলের বিন্দু, বালকের চোখে খেলে যায় কৌতুক ।বালক নিঃশ্বাসের দূত পাঠায় বালিকার গলায়, হঠাত বর্ষণে ভিজে একশা হওয়া শালিকের মতো বিহ্বল বালিকা কাঁপে।
এই গলির প্রতিটা নির্জন কোণ, থামের আড়াল, দেয়ালের ভাঁজ, বালকের দুষ্টুমিতে প্রশ্রয় দেয়, কখনো আলগোছে চোখ ছুঁয়ে দেয় বালক, কখনো আনকোরা প্রেমের আচমকা আবদারে লীন হয় দু’জন।
বালিকার কপট উষ্মা কন্ঠে ঝরে - ডাকাত একটা !
পাঁজরের জলে বিদ্যুৎ ঠোঁট
স্পর্শ করেছি,
ভুলবে তুমি কি দিয়ে??
সামনে একটা ছায়া অন্যটার কন্ঠা স্পর্শ করলো । অন্যজন বিহ্বল হয়ে দুবাহুতে শেকল পড়ালো ।
দুজনের শব্দ- নিঃশব্দ আর নিঃশ্বাসে মুখর গলিটা। তেইশ বছরের মুনীর পলক ফেলতে ভুলে যায়।
ষোল বছর বয়সে যেখানে কণ্ঠমণির জন্মদিয়ে পৌরুষ নিজের আগমন ঘোষণা করে, সেইখানে মুখ রেখে বালিকা ফিসফিস করে বলে – ভালোবাসি। ষোল বছরের বালক সদ্য অধিকার করা পৌরুষের অহম ভুলে যায়, চোখের কোণ আর্দ্র হয়ে আসে তার। বালিকা আবার ফিস ফিস করে ওঠে – মুনীর, তোকে ভালোবাসি।
তেইশ বছরের বালকের কণ্ঠমণিটা রুখে দেয় জীবনবায়ু চলাচলের দ্বার, গলা ধরে আসে বড়ো।
যুগল নদীর স্রোত যেখানে জড়ায়,
মিশ খায় না,
তবুও ছুঁয়ে ছুঁয়ে উথাল পাথাল,
তার নাম লোকে
রেখেছে চুম্বন।
ফিসফিস করে বলে উঠলো একজন। সম্মুখে দুটো ছায়া, হীরের মতোন জ্বলজ্বল করছে দু জোড়া ঠোঁট, বিদ্যুৎ চমকে উঠলো সেগুলোতে। মুনীর তাকাতে পারলো না আর। চোখ নামিয়ে নিলো। সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে স্পর্শ করলো ডান হাতের মধ্যমায় অবহেলায় লেগে থাকা ঠান্ডা স্বর্ণের টুকরো টা। পিছলে যেতে শুরু করলো সেটা ওর আঙুলের ত্বকের উপর দিয়ে, ঘুরতে শুরু করলো দু আঙুলের মসৃণ চালনায়।
আরেক জোড়া ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবার, বালিকার চোখে অগ্নি, মুঠোয় বন্দি বালকের দুটো আঙুল, বড় হয়ে ওঠবার নিষিদ্ধ আকর্ষণের প্রমাণ সেখানে; চামড়ায় গেঁথে গেছে ভাগাভাগি করে খাওয়া প্রথম সিগারেটের শেষ সুখটান। আঙুল দুটো ছেড়ে দিলো বালিকা – মুনীর, তোর যে কটা নিঃশ্বাসে আজ থেকে ঐ বিষ থাকবে, আমার প্রতিটা আঙুল থেকেও সে কয় ফোঁটা রক্ত ঝরবে। রাজি আছিস?
মুনীরের স্পর্ধা হয় নি সেই মল্লযুদ্ধে নামার, জেবার মেলে দেয়া কোমল হাতের তালুতে চুমু খেয়ে মনে মনে সে উচ্চারণ করেছিলো – ধারালো ইস্পাত নয়, তোর আঙুল আমি স্বর্ণে বাঁধিয়ে দেবো জেবা, আর কখনো হবে না এমন।
মুচকি হাসল মুনীর। পকেট থেকে বেরিয়ে এলো ধোঁয়া ভরা শলাকা, অভ্যস্ত হাতের নিপুণ দক্ষতায় খশ করে জ্বলে উঠলো আগুন। সেই আগুনের টানেই আশপাশে এগিয়ে আসা কিছুটা অক্সিজেন টেনে নিলো ওর প্রায় পাথর ফুসফুস।ধোঁয়ার দমকে চোখের সামনে আড়াল তুলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। ধুসর পর্দা দিয়ে সামনের সচল ছায়া গুলোকে আবছা না করে দিলে সামনের এই পথটুকু পেরোনো হবে না তার।
গলির শেষ মাথাটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। নীল ক্যাপ পড়া কিশোর মুনীর দাঁড়িয়ে সেখানে। এক হাত পকেটে ঢোকানো, চারকোণা ছোট্ট একটা আংটির বাক্স সর্বশক্তি দিয়ে মুঠো করে ধরে আছে সে হাতটা। দৃষ্টি দোতলার জানালায় , ধকধক করে জ্বলছে অবিশ্বাসী দু চোখ।
দুটো ব্যস্ত মানুষকে দেখা যাচ্ছে জানালায়। হ্যাঁ, ব্যস্তই বটে। পরস্পরকে নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত দুজনে। সমুদ্র মন্থন করছে দুটো সরীসৃপ ! একটা জেবার মুখ, কিন্তু অন্যটা ... !
দুটো ফুসফুসকে পাথরের মনে হতে লাগলো মুনীরের, বুকের হাড়ের যেখানটায় জেবা মুখ রাখতো, ঘৃণায়, বিবমিষায়, আক্রোশে, এক আঁচড়ে সেখান থেকে নখের নিচে জায়গা করে নিলো প্রেমিকের দলা দলা উষ্ণ ত্বক। বিশ্বাস ভাঙবার যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ নিয়ে মুনীরের সামনে কাঁচা মাটিতে দুহাঁটু ভেঙে বসে পড়লো তার ষোল বছরের ত্রিমাত্রিক স্বত্বা।
----------------------------------------------------------------------
মধ্যরাত। মুনীর তার জায়গায়, শহরের এই অঞ্চলে যে দালানটা বাকি সব কয়টা দালানের মাথা নুইয়ে দিয়েছে লজ্জায়, সেইটার শিখরে।
চাঁদ হতাশ হয়ে ক্ষয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু মুনীরের নজর সে দিকে নেই। চিবুক ঠেকিয়ে রেখেছে বুকের সাথে, মাথা ঝুলে পড়েছে, কাঁধের সমান্তরালে চলে এসেছে কপাল। দৃষ্টি স্থির, বহু নিচে ফুটপাতের লাল টালিগুলোকে লক্ষ্যভেদ করছে। সমস্ত শরীর শক্ত, টানটান করে রেখেছে, ফুসফুসে নিঃশ্বাস ঢোকাতে কষ্ট হচ্ছে তার, দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে যাচ্ছে সে -
যে কোনো রাতে
আমি যে কোনো খদ্দের,
যে কোনো কোমরের ভাঁজে
খুঁজি যে কোনো আনন্দ।
যে কোনো চাঁদ
আমাকে যখনই ডাকে,
আমার যে কোনো গেরস্ত মন
খোলস ছেড়ে মুহূর্তে হয়
যে কোনো ভবঘুরে।
যে কোনো পেয়ালায়
বিদেশী স্বচ্ছ অথবা
সস্তা ঘোলা আঁশটে আঁশটে -
যে কোনো তরল,
আমি বুভুক্ষুর মতো
চেটে চেটে খাই।
যে কোনো রুপসী
আমার দিকে
যে কোনো চোখে তাকায়,
আমি যে কোনো ইঙ্গিতকে
আহবান ধরে নিই।
যে কোনো কুকুর,
আমার পায়ে পায়ে হাঁটে,
আমি যে কোনো ভাবে কেনা রুটি
তার সাথে সমান টুকরো করতে গিয়ে
কাড়াকাড়ি করে জিতি,
যে কোনো উপায়ে।
আমার যে কোনো প্রেমিকার
যে কোনো চুম্বনে
আমি খুঁজে পাই
যে কোনো মাংসের স্বাদ।
শুধু তোমার কাছেই আমি
"যে কোনো মানুষ",
যে কোনো দিন মরে যাবার আগে
একবার "তোমার মানুষ" হতে
জাগে প্রচণ্ড, প্রচণ্ড সাধ ।
মুনীরের ফোন বাজছে। পকেটে হাত চালালো সে, নেই। শব্দ পেছন থেকে আসছে। চাঁদের জোয়ারের দিকে নির্দ্বিধায় পিঠ ফিরিয়ে দিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের চিলেকোঠার দরজা গলে ঢুকে পড়লো মুনীর।
ছোট একটা খাট, নীল রঙের একটা এলোমেলো যুদ্ধ বিদ্ধস্ত চাদর। তার চেয়েও এলো মেলো একটা ক্লান্ত, ঘুমন্ত শরীর উপুড় হয়ে আছে সেটার ওপর, প্রায় নগ্ন মসৃণ পিঠ ঢেকে আছে ছড়িয়ে যাওয়া কোঁকড়া একরাশ চুলে, মুখের ওপরেও এসে পড়েছে। দুটো হাত বালিশের দুপাশে ফেলে রাখা, ডান হাতের পাশে জ্বলে নিভে চলেছে মুনীরের ফোন।
হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিতে গেলো মুনীর। মেয়েটার কবজির সাথে দুটো আঙুল ঠেকে গেলো। বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিলো সে। ধাক্কাটা জোরে লেগেছিলো, মেয়েটা চোখ খুললো। আড়ষ্ট হাতে মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে সে মুচকি হাসলো।
মুনীরের চেহারায় সে হাসির প্রতিউত্তর দেখা গেলো না। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেই বরফের মতো শীতল কন্ঠে সে বললো – আপনি এখন যেতে পারেন। আপনার পাওনা আগেই মিটিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই ঘরে, কিছুক্ষন আগে, এই মেয়েটি মুনীরের শরীর থেকে জেবার সমস্ত স্পর্শ মুছে দিয়েছে। জেবাকে প্রতিটা রোমকূপে নিয়ে বেঁচে থাকতে আর পারছিলো না ও, ওর নিঃশ্বাসে জেবার নিঃশ্বাসের ঘ্রাণ ছিলো, সেটা আর নেই, এই মেয়েটির অচেনা গন্ধ সেখানে এখন।
জেবার স্পর্শের জন্য তৃষিত মুনীর, জেবার আঁচলে গেরস্ত বউ খেলে আসা মুনীর, জেবার ভালোবাসার জন্যে সন্ন্যাস নিয়ে ফেলা মুনীর, শুধু জেবা কে মুছে দেবার চেষ্টায় আজ তৃষ্ণা মিটিয়ে এসেছে যেকোনো জলে।
চলবে
আমি ইচ্ছে করে লেখি না, মাঝে মাঝে কেউ একজন আমার মাঝে চলে এসে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। নিজেকে ভাঙার চেষ্টা করেছি এই গল্পে, অথবা নিজেকে জোড়া দেবার। এই গল্পটা ঝর্ণার মতো বাইরে এসেছে, পুকুরের মত পুরোটার নকশা করে লিখতে বসিনি। গল্পের পরবর্তিতে কি হতে পারে, আমি নিজেও জানিনা। ইচ্ছে হলে চোখ রাখবেন পরের পর্বের জন্য।
আমি মুনীর - পর্ব এক
আমি মুনীর - পর্ব দুই
আমি মুনীর - পর্ব তিন