আব্বু আমাকে রেলস্টেশনের ওয়েটিংরুমের বেঞ্চে বসিয়ে রেখে গেলেন ট্রেনের টিকেট কাটতে। যাব সিলেট, আমার মামার বাড়িতে আমি আর আব্বু। অনেকদিন পর মামা বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। ফিলিং সো এক্সাইটেড!!
সাদা ছড়িটা ভাজ করে পাশে রাখলাম। হ্যা, আমি একজন জন্মান্ধ। এই পৃথিবীর রুপ-রস কিছুই নিজ চোখে দেখা হয়নি আমার। আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা যান, আর আমি হই অন্ধ। আমার বাবা এরপর আর বিয়ে করেননি। আমাকে অনেক কস্ট করে এতদুর এনেছেন বাবা। অন্ধ হলেও জীবনযুদ্ধে হার মানিনি আমি। ব্রেইল পদ্ধতিতে এবার এসএসসি পাশ করেছি আমি।
আমার চোখ দুটি ঠিক করানোর জন্য বাবা সাধ্যমত অনেক চেস্টাই করেছেন, অনেক ডাক্তারের কাছে ছুটে গেছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। কারন আমার চিকিৎসা একটাই, তা হল কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন! কিন্তু অনেক চেস্টা করেও আমার জন্য একজোড়া কর্ণিয়া জোগাড় করা যায়নি, এদেশের মানুষ যে মৃত্যুর পরও নিজের চোখ জোড়া হারাতে রাজি নয়!!!
আমার পাশে বসা কেউ একজন হেসে উঠলেন হঠাৎ করে। শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘুরালাম আমি।
--কি ব্যাপার, হাসছেন কেন?
..................................................................
আমি আতিক। একটি ওষুধ কোম্পানিতে জব করি। সিলেট যাব অফিসের কাজে। ট্রেন আসবে আরো আধা ঘন্টা পরে। টাইম পাস করার জন্য বুকস্টল থেকে “১০০১ টি হাসির কৌতুক” নামক বইটি কিনে ওয়েটিংরুমের বেঞ্চে বসে পড়ছিলাম। কিছুক্ষন পর এক ভদ্রলোক একটি ছেলেকে আমার পাশে বসিয়ে রেখে গেলেন। ছেলেটির বয়স ১৬-১৭ হবে।
বইটি বেশ ভালই। ভাল ভাল কৌতুক আছে। এরমধ্যে একটি পড়ে এত হাসি পেল যে একটু শব্দ করেই হেসে ফেল্লাম আমি............
আমার পাশে বসা ছেলেটি আমার উদ্দেশ্যে কিছু বল্লো বোধহয়। ফিরে চাইলাম ওর দিকে এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ছেলেটি অন্ধ! এর আগে বুঝতে পারিনি আমি। আহারে বেচারা!
--সরি, আমাকে কিছু বল্লে?
--আপনি হাসছিলেন কেন?
--ওহ আচ্ছা, কৌতুকের বই পড়ছি আমি। একটা কৌতুক পড়ে হাসি পেল।
হাসিমুখে জবাব দিলাম।
--কি কৌতুক? আমাকে বলবেন প্লিজ!
--সিউর। এক লোক দেখল যে তার এক বন্ধু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। তখন সে তাকে জিজ্ঞেস করল যে কি ব্যাপার, তুই খোড়াচ্ছিস কেন? তখন তার বন্ধু জবাব দিল, “আমার দাঁতে খুব ব্যথা করছে তাই খোড়াচ্ছি!!গাধা কোথাকার!"
--হাহাহহাহাহাহাহাহাহহাহাহাহাহাহাহা......
ছেলেটি প্রান খুলে হাসছে। এত প্রান খুলে কাউকে হাসতে দেখিনি অনেকদিন!! মনটাই ভাল হয়ে গেল!
কিছুক্ষন পর ছেলেটি আবার ফিরে চাইল আমার দিকে,
--আপনার যখন কাজ হয়ে যাবে তখন কি আমাকে দেবেন প্লিজ?
অবাক হলাম আমি! কি চাইছে ও? বইটা?!
--কি, বইটা?
--নাহ.........আপনার চোখ দুটো!
কি কারনে যেন আমার দৃস্টি হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল! চোখে কোন ময়লা গেল নাকি? নাকি চোখে পানি চলে এলো!!
------------------------------------------------
আপনি চাইলে মৃত্যুর পরও আপনার চোখ দুটি বেচে থাকতে পারে অন্য কারো চোখ হয়ে। দয়া করে মরনোত্তর চক্ষুদান করুন। আপনার-আমার সামান্য ইচ্ছাই যথেষ্ঠ। চোখ দান করার বিষয়ে কোনো ধর্মেই বারণ নেই। কর্নিয়া সংগ্রহের পর বাহ্যিক চেহারা অপরিবর্তিত থাকবে। শুধু কর্নিয়া সংগ্রহ করে ফাঁকা স্থানে একটি আই ক্যাপ বসিয়ে দেওয়া হয়, যা অপরিবর্তিত চেহারা নিশ্চিত করে। মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্য সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে যোগাযোগ করুন।
আমার মৃত্যুর পর যে জিনিস আমার বা আমার পরিবারের কোন কাজে লাগছে না সে জিনিসটা কি এমন কাউকে দিয়ে দেয়া যায় না যেটির জন্য সে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে? ওয়েটিংরুমের বেঞ্চে বসে থাকা ওই ছেলেটির মত হাজার হাজার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অপেক্ষা করে আছে, আমাদের এই সামান্য ইচ্ছাটুকুর কারনে ফিরে পাবে নিজেদের চোখ, দেখতে পাবে এই অপরুপ পৃথিবীকে আপনার চোখ দিয়েই!!!
এই শ্রীলংকান বিজ্ঞাপনটি অবলম্বনে রচিত
(অনেক আগে প্রথম আলো ব্লগে এই গল্পটি দিয়েছিলাম প্রথম, ওখানে দেয়া আমার প্রথম ও শেষ পোস্ট। ওখানকার ব্লগ আইডি,পাসওয়ার্ড, মেইল আইডি সব ভুলে গেছি,তাই আর পরে ঢুকতে পারি নাই! আজকে মনে হল গল্পটি এখানে শেয়ার করি।)