শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসীর দাবীতে যে আন্দোলন চলছে - তা এক কথায় অভূতপূর্ব এবং নজিরবিহীন। কোন নেতা ছাড়া শুধুমাত্র একদল তরুনের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে প্রায় গোটা জাতি। এই যে ফাঁসীর দাবী - তা শুধু ফাঁসীর দাবীর মধ্যে সীমাবন্ধ নেই - এইটা একটা আদর্শিক সংগ্রামে রূপ নিয়েছে। একদিকে ৭১ এর পরাজিত শক্তি - যারা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে তার আড়ালে একদল পরাজিত মানুষকে রক্ষা করার জন্যে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে - যাকে ঘিরে ধরে একটা দল কাজ করছে - যারা মুখে ধর্মের কথা বললেও কার্যত শুধুমাত্র সন্ত্রাসী রাজনীতির কৌশলে এরা এগুচ্ছে।
অন্যদিকে আছে মুক্তপ্রান তরুন সমাজ - যারা স্বপ্ন দেখাচ্ছে একটা নতুন বাংলাদেশের। আমরা যারা প্রবাসে থাকি - আমাদের জন্যে এই বিষয়টা বুঝতে অনেক সুবিধা হয় যে - যারা মুখে ধর্মের নাম করে রাজনীতি করে আর নিজেদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে রেখে পশ্চিমা শিক্ষা শিক্ষিত করে - তারা আসলে কতটুকু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকে আসল কর্মসূচী বিবেচনা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সাধারন মানুষের মতোই প্রবাসীরাও দেশের প্রচলিত রাজনীতি সম্পর্কে নানান অসন্তোষ পোষন করেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই কার্যত রাজনৈতিক পাশা খেলা চলেছে - এর মধ্যে গনতন্ত্র বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে নানান ভাবে - সামরিক শাসক এসে রাজনীতিতে বেচাকেনার বানিজ্য শুরু করে রাজনীতিকদের নৈতিক মান মাটিতে নামিয়ে এনেছে। রাজনীতি সম্পর্কে এই নেতিবাচক চিত্র সৃষ্টির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি নিজেদের কৌশলী খেলোয়াড় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এরা প্রচলিত রাজনৈতিক আদর্শহীনতা আর দূর্নীতির পাশাপাশি এমন একটা ধারনা সৃষ্টি করেছে যে তারা হলো সৎ বিকল্প। কিন্তু যদি একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখ যাবে - এরা সৎ লোকের আড়ালে একদল সুবিধাবাদী বিলাসী জীবন যাপনকারী লোক যারা শুধুমাত্র নিজেদের মতাদর্শের বাইরের মানুষকে এরা মানুষ হিসাবে গন্য করে না। বিগত কয়েক দিন ধরে তারা যে হিংস্রতা প্রদর্শন করছে - তা থেকে অবশ্যই আমাদের বুঝা উচিত - যদি কখনও এরা ক্ষমতাশীন হয় তবে এরা ভিন্নমতের মানুষদের উপর কি নির্যাতন টেনে আনবে। যার বিছুটা প্রমান আমরা পেয়েছিলাম ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনে চিত্র থেকে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে একটা সুদৃঢ় অবস্থানের দিকে যাচ্ছে - এই কথা অনস্বীকার্য - তেমনি শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি একটা দেশের মানুষের জীবন যাপনের জন্যে যথেষ্ঠ নয়। সেখানে চাই ন্যয় বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা আর মানুষের জীবন যাপনের মতামতের স্বাধীনতা। এই সবই সম্ভব একটা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। আমাদের মনে রাখা দরকার - গনতন্ত্র হলো একটা উদার ব্যবস্থা - যেখানে মত প্রকাশে স্বাধীনতার সুবাদে অনেক আগাছা গজিয়ে উঠে। আগাছাগুলো এক সময় মুল শস্যকে ঢেকে ফেলে। গনতন্ত্রকে সবল রাখার জন্যে আগাছা পরিষ্কার করা জরুরী। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কারনে বাংলাদেশে গত চল্লিশ বছরে জামাত/শিবির নামক মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি আগাছার মতো বেড়ে উঠেছে এবং দূর্নীতিগ্রস্থ সুবিধাবাদী মুল রাজনৈতিক দলগুলো আগাছাকে শস্য হিসাবে বিবেচনা করছে - কিন্তু তরুন সমাজ যেহেতু নির্ভিক প্রান - তারা আগাছা চিনতে ভুল করেনি - তাই সত্য কথাটাই উচ্চারন করছে - আগাছা পরিষ্কার করো। সেই লক্ষ্য মুল উৎপাটন জরুরী। তাই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়ে একটা চরম অবস্থানে গেছে তরুনরা - যাতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ এই অপরাধীদের আর সুযোগ না দিতে পারে। তারপর আগাছা পরিষ্কারের জন্যে মৌলবাদী সন্ত্রাসী দল হিসাবে জামাত/শিবিরের রাজনীতি বন্ধ করা এবং তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষনা করেছে। বাংলাদেশের নতুন একটা সম্ভাবনার ইংগিত দিচ্ছে এই তরুন সমাজ। একটা ন্যায় বিচার ভিত্তিক দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রাথমিক ধাপ হিসাবে তরুনদের এই আন্দোলনে আমাদের সকলের সমর্থন জানানোর বিকল্প নেই। কারন প্রচলিত রাজনৈতিক দলের বিকল্প হিসাবে সামরিক/ঘোমটা টানা সমারিক শাসন দেখেছি আমরা - সেগুলো দূর্নীতিকে আরো গভীরে প্রোথিত করেছে। তরুনদের মাঠে নেমে যাওয়াকে অভিনন্দন জানানো এবং প্রবাস থেকে তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নতুনের পথে একটা অগ্রযাত্রায় শরিক হওয়ার গৌরব অর্জন কে না করতে চাইবে!
আরো যে কারনে এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেওয়া জরুরী তা হলো - এইটা আমাদের ইতিহাসের দাবী। যদি একটু ভাল করে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বর্তমান আর্থ সামাজিক অবস্থা তুলনা করি তাহলে পাকিস্তানের চরম হতাশাজনক চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটা সম্ভাবনাময় দেশ হিসাবেই দেখছে বিশ্ব। আর এই পার্থক্যের কারন হলো আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করে পাকিস্তানের জন্ম থেকে শুরু করে ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর আয়ুব বিরোধী গনআন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯২ এর গনআদালতের পর আজকের এই শাহবাগের গনজাগরন সবই একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত - তা হলো জনতার জাগরন। একজন নেতা বা আপোষকামী একদল নেতার আলোচনা বা চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশের কোন অর্জণ নেই - সবগুলো অর্জণই হয়েছে রাস্তায় - মাঠের আন্দোলনে। এমনকি বিগত ১/১১ সরকারের সময়ও একটা আন্দোলনের কারনেই তারা দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিয়েছে এবং সামরিক শাসনের চিরতরে কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে মানুষ নিজেদের দেশের দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে দেয়নি - সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে রাস্তায় নেমেছে - ইতিহাসের গতিপথ নিজেরাই নির্ধারন করে নিয়েছে। শাহবাগের তরুনরাও একই কাজ করছে। একটা মুক্ত সমাজ তৈরীতে তরুনদের এই জাগরনকে সমর্থণ দিয়ে বাংলাদেশকে একটা সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আমাদের প্রবাস থেকে সমর্থন জানানো উচিত বলে মনে করছি।
এখানে কিছু বাস্তবতার কথা বলা জরুরী। বর্তমান আন্দোলনকে অনেকেই বিভ্রান্তির জালে আটকাতে চাচ্ছেন। তাদের প্রচারনা মধ্যে আছে এই আন্দোলন ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক বামরা এই আন্দোলন করছে। তাদের জন্যে একটা কথাই যথেষ্ঠ - ন্যয় বিচারের অধিকার এই পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যেই সমান ভাবে প্রযোজ্য। ৭১ সালে সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত হয়েছে - সুতরাং তাদের বিচারের দাবীটা সবচেয়ে জোরালে হবেই। আর জামাতে ইসলাম মানে ইসলাম না - এই আন্দোলনের ফলে জামাতে ইসলামী মুখোশটা খুলে ফেললে মানুষ অবাক হয়ে তাদের হায়েনার চেহারাটা দেখতে পাবে। ইতোমধ্যে বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পোড়ানো থেকে পুলিশের উপর আক্রমন আর কোন অন্য পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই ব্যস্ত জনবহুল রাস্তায় মিছিলের নামে যানবাহনের ভাংগচুর আর অগ্নিসংযোগ থেকে আমরা ওদের প্রকৃত চেহারাও কিছুটা দেখতে পাচ্ছি বটে।
অন্যদিকে কিছু কথা বিভ্রান্তির সৃষ্টি কররার জন্যে প্রচার করা হচ্ছে - এই বিচার নিরপেক্ষ না - আন্তর্জাতিক মানের না ইত্যাদি - যারা এই দাবী করে তাদের কাছে বিশ্বের যে কোন একটা উন্নমানের যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদাহরন চাওয়া যেতে পারে। প্রসংগক্রমে বলা দরকার - যখন ২য় বিশ্বযুদ্ধের নাজী অপরাধীদের বিচারের জন্যে আইন তৈরী হচ্ছিলো - তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলছিলেন - আমি ওদের জন্যে একটা বুলেটও খরচ করতে চাই না। মানে অপরাধীদের জ্যন্ত করব দেওয়া ইচ্ছা করছিলেন চার্চিল। জর্জ ওয়াশিংটন যুদ্ধাপরাধীদের উত্তপ্ত আলকাতরায় চুবিয়ে মারতে বলেছিলেন। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষতো শুধু বিচারই চাইছে - যে বিচারের আপীল করাও সুযোগ রাখা হয়েছে। যারা বিচারের আন্তর্জাতিক মানের কথা বলছে - তারা যদিও ইসলামের নামে রাজনীতি করে - কিন্তু সৌদি আরবের বিচারকে তারা উদাহরন হিসাবে আনছে না - কারন সেখানে কিসাসের বিধান আছে - সেই বিচারের একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধ দাবী করতে পারে বিচারাধীনদের পংগু করে দেওয়ার - সেই ভয়টা ওদের আছে বলেই মৃত্যুদন্ড নাই এমন দেশের মানুষকে বিচারের বিষয় উত্তেজিত করছে ওরা।
দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতির কানাগলিতে আটকে থাকা ন্যয় বিচারের দাবীটা যখন আলোর মুখ দেখছে - আমাদের উচিত সেই ন্যয় বিচারকে মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলনে শরিক হওয়া। ক্ষমা আর ভীরুতার মতো দূর্বলতা যে আমাদের পেয়ে না বসে। কারন কোন কোন অপরাধ আছে যা ক্ষমা করাও অপরাধ - তারা ক্ষমার যোগ্য নয়। শেষ করি রবি ঠাকুরে একটা কথা দিয়ে -
ক্ষমা যেখা ক্ষীণ দূর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়গসম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
( ন্যায় দন্ড, রবি ঠাকুর)
আমরা তো ক্ষমা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ক্ষমা চায়নি - আমাদের ক্ষমার ইচ্ছাকে ওরা দূর্বলতা বিবেচনা করে শক্তি অর্জন করে আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের অর্জনকে ধ্বংস করতে। যে অর্জনের জন্যে আমাদের এক নদী রক্ত প্রবাহিত হয়েছে - ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম উৎসর্গ করতে হয়েছে। এখন আর দূর্বলতা ভীরুতা নয় - আসুন কঠিন হই - পরাজিত শক্তির কফিনে শেষ পেড়েকটা ঠুকে দেই। সুযোগ করে দেই নতুন প্রজন্মকে একটা ন্যয় ভিত্তিক বাংলাদেশ তৈরী কাজে তাদের সন্মিলিত জাগরনকে।
@আবু সাঈদ জিয়াউদ্দিন
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৪৪