ওয়ারীতে আমাদের ছোট বেলা কেটেছে । উঁচু ছাদের বাড়ি । ভারী বীম থেকে ওজনদার চারপাখার সিলিং পাখা ঝুলত। আমরা কল্পনা করতাম জমিদার বাড়ি। পরে জেনেছিলাম ইংরেজ আমলের অফিস-কাচারি। আমার দাদা নিলামে কিনেছিল সেটা। ঝামা পাথরের সিঁড়ি চিকন গলির মত এক তলা থেকে দোতলায় উঠে গেছে। যেতে যেতে একদম ছাদে। ঢেঁকি শাক নির্ভয়ে উঁকি দিত ফাটলের ভেতর। কেউ তোয়াক্কা করতো না। মাটির মালসায় ফুল চাষ করতেন মা। বাড়িটা প্রায় ভেঙেই পড়ছিল। জানলার কপাট লাগতো না। সকালে শিশির গড়িয়ে আসতো, বন্ধ কপাটে সূর্য ঢুকে যেত। আমরা ছিলাম একান্নবর্তী পরিবার। আর খুব সুখী।
আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকশত গজ দুরে একই রকম একটা বাড়ি ছিল। সবাই বলত যমজ বাড়ি। নবীন কাকা বলতেন মালিক মাড়োয়ারি। মারোয়ারিরা লোক ভাল না, ঝগড়াটে আর জেদি। বাবাও ওখানে যেতে মানা করতেন। বাড়ি ঘিরে রহস্যের গল্প শুনতাম। লতাগুল্ম জড়িয়ে থেকে থেকে সেটা হল পোড়োবাড়ি।
একদিন বিক্রি করে মাড়োয়ারি মালিক অন্যত্র চলে গেল। নতুন মালিক এসে পরিত্যক্ত বাড়িটা গুঁড়িয়ে দিল। বাউণ্ডারী দেয়াল ভেঙে গাছ কেটে চারতলা এক দালান তুলল। এত আধুনিক দালান এ তল্লাটে কেউ আগে দেখে নি। পুরনো বাড়ির ভেতর তাকে বেমানান লাগত। নতুন বাড়ির ছায়ায় আমাদের জীর্ণ বাড়িটা আরও ম্লান হয়ে গেল।
দু' বাড়ির মাঝে এক চিলতে খেলার জায়গা ছিল। সেখানে কষ্টে সৃষ্টে রোদ জুটতো। বিকেলে চার পাঁচটা বালক টেনিস বল ছোঁড়া ছুঁড়ি খেলতো । আমি দুধভাত বলে বল কুড়োনোর দায়িত্ব পেতাম। দিনের মধ্যে কুড়ি তিরিশবার বল সেই বাড়ির নিচতলায় পড়ত। ভাড়াটিয়া মহিলাটি সদয় ছিলেন। কখনোই বিরক্ত হতে না। বারান্দায় একজন বয়স্ক মানুষ বসে থাকত যাকে আমার ভয় লাগত। বারান্দায় খাঁচায় একটা টিয়া পাখিটা আমি ঢুকতেই ডাকতো সুজু সুজু। টলটলে চোখ , পান লাল তার ঠোঁট। আমি বিস্মিত হতাম যেন ও আমাকেই ডাকছে।
টিয়া পাখির ঠোঁট সব একই রকম । তবে নয়না ছাড়া অন্য টিয়া তেমন দেখি নি। ক্লাস সিক্সে পড়ি। পছন্দ আর ভালবাসা দুটোই এক। সবচেয়ে পছন্দ করতাম ডাক টিকেট । টিকেটের একটা খাতাটা এখনো শেলফে আছে। "হেলভেশিয়া" দেশের টিকেট দুর্লভ। "ম্যাগিয়ার-পোস্তা" আর "রোমানা" দেশের স্ট্যাম্প খুঁজেছি হন্যে হয়ে। সহপাঠী একটা মেয়ে ছিল, নাম সিমন্তী। তার টিকেট গুলো সেলোফিনের ভেতর সুন্দর করে ঢুকানো থাকতো। খাতাটা দেখে লোভ হতো । সিমন্তী বড় হয়ে সুন্দরী হয়েছিল। তবে এখনো মনে হয় ওর স্ট্যাম্পের খাতাটা ওর চেয়ে বেশী আকর্ষণীয় ছিল।
সেভেনে উঠে পোষা জন্তুর সখ পেয়ে বসে। একটা বিড়াল পুষতে শুরু করি। মুন্না খেলনা গাড়ি জমাতো। ও আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। এখনো ওর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব। এত মিলে গড়মিল বিড়াল পোষা। বলতো ছি! পুষলে পুষবি গরু ছাগল। যেগুলো খাওয়া যায়। বিড়াল কেন? অবশ্য ওর পছন্দ ছিল পাখি। পাখি গান শোনায়। কিন্তু বিড়ালের মত পাখি তো আর বিনে পয়সায় যোগাড় করা যায় না।
বাড়ির সবার রঙের বাতিক ছিল। নীলিমা দিদির প্রিয় ময়ূরকণ্ঠী । । মাসীর বিছানার চাদর থেকে বালিশ সব পীতরঙ। আমি টিয়ের ঠোঁটের মত লাল রঙের ভক্ত। মেলার লাটিম বা জামা, সবই আমার লাল । আমরা হয়তো বংশ পরম্পরায় বর্ণান্ধ ছিলাম।
নয়নার পাখায় একটা কাটা দাগ ছিল। ডান পাখার পালক ভাঙা ভাঙা। সাদা বিচ্ছিরি লোম বের হয়ে আছে । তবু তাকে পছন্দ হয়েছিল। সবাই টিয়া টিয়া ডাকত। আমি তার বলতাম নয়না।
পরীক্ষার জন্য খেলা কমে গিয়েছিল। সে বাড়িতে যাওয়া হয় নি বহুদিন। একদিন কি মনে হল, বল কুড়ানোর ছলে সেই পাখিটা দেখতে গেলাম। ঢুকতেই বারান্দায় টিয়াটা আমাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে ডাকছিল।
বারান্দার সেই লোকটা ছাড়া বাড়িতে কেউ ছিল না। লোকটার মন ভাল। আমায় ভেতরের ঘলে ডাকলেন। হেসে বললেন একটু বস, পূজোর লাড়ু খাও। সেইদিনই প্রথম তাকে হাসতে দেখলাম। কলকাতার টানা উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলেন, খোকা, টিয়াটা কি তোমার খুব পছন্দ?
কি বলব। বললাম হু
নেবে?
হুমম, আমি বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। তিনি হয়তো মজা করছেন। বড়দের মজা বোঝা কঠিন। অন্যের জিনিস নিতেও হয় না।
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। মা বকবেন। তিনি আবারও হাসলেন। পরদিন সকালে খাঁচাটা হাতে করে এনে মাকে বললেন, দিদি, আমরা চলে যাচ্ছি বর্ধমান। টিয়ার খাঁচাটা আপনার ছেলেকে দিয়ে দিলাম।
***
পাখিরা কি মানুষের কথা বোঝে? না হলে সে কি করে বুঝতো আমার স্কুল শেষ হয় দুটোয়। হাত মুখ ধুয়ে কাছে যেতেই সে খাঁচার আঁকড়ে ধরে ডাকা ডাকি করত। লুকিয়ে প্রতিদিনই ওর জন্য কিছু ছোলা নিয়ে যেতাম। অভাবে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা।
নিজের পেটে ভাত নেই পাখির পেটে বালাম চাল - খোটা দিতেন মেজ কাকী।
মেজ কাকীর ত্যাড়া কথা বলার অভ্যেস। তবে মুখে এসব বললেও আমার মতই টিয়ার যত্ন নিতেন।
একমাত্র মা বিরক্ত থাকতেন । তিনি শুচিবাই গ্রস্ত মানুষ। পাখিতে দুর্গন্ধ হয়, সেটা তার কড়া অভিযোগ। সেজন্য পাখিটাকে বাড়ির বাইরে খাঁচায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
নয়নাকে আমি অনেকগুলো শব্দ শিখিয়েছিলাম। আমারটা বলতে সে নিজের নামটা বলত। নয়না নয়না। আমি তাকে ডাকলে আমার পাশটায় ছুটে আসতো।
**
সাত আট মাস পরের কথা। বৃত্তির কোচিং থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়েছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। জানি না।
সন্ধ্যা রাতে মা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। ঝড় উঠেছে। উঠে বস। কালবৈশাখী ঝড়।
আমি ঘুমের ভেতরই চোখ না খুলে বলেছিলাম, মা, আমার পাখিটা কই?
-বাইরে।
-কেন মা? ঝড়ে কি হবে তার?
-আনতে মনে ছিল না রে, এখন তো অনেক হাওয়া।
আমি বললাম, দরজাটা খোলো।
-না এখন অনেক ঝড়
-না না, নয়না মরে যাবে
ভাঙা বাড়ি মচমচ করছিল। একটা গাছ ভেঙে পড়ল।
ঝড় থামল এক ঘণ্টা পর
দরজা খোলা হল। একটা খাঁচা উপড়ে পড়ে আছে মাটিতে। তার উপর বাতাবী ভেঙে পড়া ডাল। মৃত একটা টিয়া
বাড়ির সবাই এল। দেখল একটা কিশোর অঝোরে কাঁদছে নয়না নয়না। নয়না ডাকলে পাখিটা জবাব দিত। আর দেবে না।
থাম তো - মেজদাদা বকা দিয়েছিল। বড় হচ্ছিস না? এইটে পড়িস তো ফ্যাচকাঁদুনে ক্যান? এর চেয়ে ভাল পাখি কিনে দেব।
ঠিক তখুনি শব্দ হল। আর একটি টিয়া ডেকে উঠল ভেতর থেকে।
আমি খাঁচা খুলে দিলাম। একটা ভেজা পাখি বের হয়ে এলো। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে আমার হাতে এসে বসল। তীক্ষ্ণ ঠোঁটে কামড়ে দিল আমার কব্জি। যেন অভিযোগ করছিল তাকে কেন মেরে ফেলছিলাম। কাঁপছিল। বন্দী করে ঝড়ের মুখে ফেলে দেয়া খুব অন্যায়।
***
আমি টিয়াটাকে দানা পানি বাড়িয়ে দিলাম। ও সেরে উঠল। মা বলল, যা, পাখিটা ছেড়ে দে। মুন্না ফিচকি হেসে বলল, বেচে দে না ওটা। চকে দোকান আছে ওরা পোষা পাখি কেনে। ও টাকায় পিনুর দোকানে বিরানী খাই।
-ওটা আমার খুব পছন্দের, ওকে বেচে পয়সা নিতে আমার বয়েই গেছে। তবে একে ছেড়ে দেব ভাবছি
-কেন? ছাড়বি কেন? এত্ত দিন খাওয়ালি যে? মুন্না কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল
আমি একটা পোস্টার দেখেছিলাম আসার সময়
If you love someone set it free..
if it comes back to you its yours
আমি নয়নাকে ভালবাসি।
-ইস্সিরে ভালবাসা, মুন্না হেসে আকুল।
নয়নার ডানার পালকে ক্ষত হয়েছিল। ঝড়ের পর থেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল সে। একটু করে যখন সেরে উঠেছে এক বিকেলে তাকে উড়িয়ে দিলাম। অবাক হলাম। সে যেতে চাইছে না। পাশেই বসে থাকল। আমি তাড়ালাম। সে উড়ে গিয়ে বসল শিমুলের গাছে। তারপর আর দেখি নি।
সে দিন খুব আনন্দ হল। আবার কষ্টও হল। ভালবাসলে কষ্ট তো হবেই।
***
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত। ছোটবেলার অনেক সামান্য ঘটনা ভোলা যায় না। টিয়া পাখিটাকে ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। আমি ভাবতাম পাখিটা আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু সে আর আসে নি। অবশ্য পাখি ফিরে আসবে এমন ভাবনাও হাস্যকর। আমরা বাসা বিক্রি করে গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশনে চলে এলাম। পাখিটা যদি কোনদিন ওয়ারীর বাসায় যায়ও তবে আমাকে পাবে না।
***
গত বছরের কথা। দাদা কলেজ পাস করার পর একটা ঘড়ি কিনে দেবার পয়সা দিয়েছিল। ইসলামপুর মার্কেটে তিন তলায় ঘড়ি আর ইলেকট্রনিক্স বিক্রি হয়। ছিটকাপড়ের দোকান পার হয়ে মুন্নাকে নিয়ে ঘড়ির দোকানে উঠছি এমন সময় পাইকারি এক দোকানের সামনে একটা পাখি চোখে পড়ল। টিয়া পাখি। পরিচিত মনে হওয়ায় বললাম, মুন্না, একটু থাম।
কাছে গিয়ে দেখলাম ওটা অবিকল নয়নার মত। পালকের একপাশ লোম ওঠানো। ডানায় কাটা দাগ। খয়েরী রঙ করা ভারী লোহার তারের খাঁচায় সঙ্গে আর কয়েকটা পাখির সঙ্গে । এক মনে ঠুকরে ঠুকরে দানা পানি খাচ্ছে। স্বাস্থ্যটা বেশ ভাল হয়েছে।
আমি ডাকলাম, নয়না, নয়না
তরুণ দোকান মালিক সকৌতুকে বলল, এইটা ময়না না! টিয়া।
পাখিটা শুনতে পেল না। অনেক খাবার রাখা পাত্রে, সে এ নিবিষ্টে ঠুকরে খেতে লাগল। তাকালোও না।
আমি আবারও ডাকলাম, নয়না, নয়না। বহুবার ডাকার পার নয়না আমাকে চিনতে পারল না।
মুন্না হাত ধরে টানল, পাগলামি রাখ। এবার চল।
আমি ফিরে চললাম। শুধু দেখলাম ভাল খাবারে আলো ঝলমল দোকান সাজিয়ে টিয়া পাখিটা বেশ ভালই আছে।
--
ড্রাফট ১.৩ / সরল গল্প