নিশিকান্ত 'ডবকি' টা নিয়ে আয়। ফোনটা রেকে M ভাই (সংক্ষেপে ) আমাদের দিকে ফিরে একটু হাসলেন। আমি বুঝলাম আজকে কোন একটা আয়োজন আছে। নিশি আসবে গান করতে,তার গান আগেও শুনেছি। সে বাউল আব্দুল করিমের গানই বেশি করে। কিন্তু তার নিজের কিছু গান আছে। মানুষ নিয়ে তার সুন্দর একটা গান আমিও মনে মনে গাই। মা ,নারী নিয়ে ও আছে গান। সে দিন শুনলাম "তুমারে লাইয়া সিলেট যাইমোনে...” এই শিরোনামে একটি গান। কথা গুলো খুব আহামরি কিছু না। কিন্তু সুর দিয়ে সে একটা আমেজ তৈরী করে। আমরাও নিশির গান শুনে অভ্যস্ত।
নিশিকান্ত ডবকি হাতে কানে মাফলার পেঁচিয়ে পায়ে সাদা ক্যাডস নিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকলো। হাতে তার সেই পুরনো ডবকি। আমরা বসে আছি আই হাসপাতালের নিচ তলায়। সেক্রেটারির রুমে। আর নিশিকান্ত আছেন তারই তত্বাবধানে।
উদিচির অনুষ্ঠানে শহরের বাইরে থেকেও বেশ কয়েজন শিল্পী গান গাইতে আসে। নিশিও আসে সেই দলের সাথে। আমি নিয়মিত শ্রোতা হিসেবে এবারও উপস্থিত হই। অনেকের মাঝে তার গানও ভাল লাগে। তাকে আমারও খুব মনে ধরে। কিন্তু আমার মনে ধরলে তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ থাকে যাদের মনে ধরলে অনেক কিছু যায় আসে।
তেমনই একজন আমাদের M ভাই। অর্থবিত্ত আছে,আছে আড্ডা বাজ মন, গান শুনতেও তিনি খুব পছন্দ করেন। এই ধরনের কাজে টাকাও তিনি খরচ করেন হিসাব ছাড়া। তিনি একদিন একটা অনুষ্ঠানে নেই নিশিকে আনলেন। সে এক দুইটা গান গাইল ডবকি বাজিয়ে। জানতে পারলাম নিশির চোখে সমস্যা সে দেখতে পারেনা।
বয়স কত আর হবে উনিশ বা একুশ। এই বয়সে একজন চোখে দেখতে পারেনা। দুটি চোখেই তার সমস্যা। জরুরি অপারেশন করালে হয়তো কিছুটা উন্নতি হতে পারে। আর দেরি করলে আর কোন সম্ভাবনাও নাই। এটা তো খুব হতাশার কথা। নিশির বাবা অন্যের জমিতে কামলা দেয়। নিশিও এই এটা সেটা করে। চোখ দুটা নষ্ট হোক কিংবা চারটা নষ্ট হোক তারা তেমন কিছু করতে পারবেনা তাই মাঝে মাঝে হোমিও ডাক্তার দেখান।ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে অপারেশন করে চিকিৎসার কথা কল্পনাই করতে পারেন না।
এই নিশি এখন চক্ষু হাসপাতালে আছে। থাকেন হাসপাতালের গেস্ট হাউসে। থাকা খাওয়া চিকিৎসা সব ফ্রি। একটা চোখ অপারেশন হওয়ার পনের দিন পরে আর একটা চোখ অপারেশন হওয়ার কথা। ডাক্তারের কোন সমস্যা থাকায় দ্বিতীয়টা হবে দু দিন পরে। এই দুদিনের প্রথম দিনই আজ। তাই অনেক দিন পর নিশির গান শুনতে পেলাম।
নিশি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। M ভাই বলতেই সে গান শুরু করে দিয়েছে। তাকে যতবার দেখেছি কখনো দেখি নি বলার পরে এক মিনিটও দেরি করতে। কখনো তাকে দেখিনি বলতে আজ গলা ভাল না ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব সময় বলার সাথে সাথে গান শুরু করে। কোন সময়ের দরকার হয়না। কোন প্রস্তুতির দরকার হয়না। নিশি সব সময় প্রস্তুত। গান সে অন্যের জন্য গায় না , সে সব সময় গান গায় নিজের জন্য। গান গাইতে মানুষ এত পছন্দ করে। নিশিকে দেখার আগে চিন্তাও করতে পারতাম না। গান গাইতে এত উন্মাদনা হতে পারে,এত আগ্রহ থাকতে পারে । গানকে তারা জীবনের মতোই ভালবাসে। নিজে বাঁচলে গানকে বাঁচিয়ে রাখে।হিরক রাজার দেশের সেই গানওয়ালার কথা মনে পড়ে গেল। "যতক্ষণ প্রাণ আছে তো গান আছে" এত প্রতিকূলতার মাঝে বাউল গানকে তারা কেবল কণ্ঠের জোরে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিজেদের আত্মবিশ্বাসের জোরে। গান তাদের প্রার্থনা,গান তাদের ঈশ্বর,গান তাদের জীবন,গান তাদের সব।
২০০৮ সালে নিকুঞ্জু২ তে একদিন দুপুর বেলা। দোতরা হাতে,সাথে একটি ছোট ছেলে তার হাতে এমনই একটা ডবকি। আমি নিরীহ ভাবে একাই দাঁড়িয়ে আছি। এসে জানতে চাইল গান শুনব কিনা। আমি রাজি হলাম। গান দুই বা তিনটা গান শুনার পর তার সাথে অনেক কথা হলো। চেহারা দেখেই সংসারের অনটনের কথা বোঝা যায় তবু ,জানতে চাইলাম কেন সে গান করে? অন্য কোন পেশায় গেলে আয় বাড়তে পারে। কিন্ত লোকটি আমার কথা পছন্দ করলো না। তবু বিনয়ে বলল এই একটি জিনিসই সে পারে আর কিছু পারেনা। কষ্ট হয় সংসার চালাতে তবু গানটা ছাড়তে প্রাণে দেয় না। বাপ দাদা এই দোতরা বাজিয়ে গান গাইত। আজকে আমি এই দোতরাকে কি করে অবহেলা করি? আমি তখন সবে মাত্র চাকরিতে ঢুকেছি, মাত্র দশদিন। তবু আমার সাধ্য মতো তাকে দিলাম। এখন মনে হয় ১০০টাকা এমন কি? কিন্তু তখন এই টাকাটাই আমার কাছে অনেক কিছু ছিল।
নিশির গান শুনতে শুনতে আমাদের খিচুড়ি পরিবেশন হয়ে গেছে। গান শুনার ফাঁকে আমাদের ভুঁড়ি ভোজন ও হয়ে যায়। এই হাসপাতালে এই পর্যন্ত যতবার এসেছি কখনো না খেয়ে যাইনি। কি মজার হাসপাতাল সব সময় খাবার থাকে। হা হা হা...
নিশি লেখা পড়া জানে না। হিন্দু ঘরে জন্ম কির্তন করতে করতে গলার সুর আসে। নিশির বেলায়ও তাই হয়েছে। আর এই অঞ্চলে বাউলগান খুবই জনপ্রিয়। শাহ আব্দুল করিম,শাহ আব্দুন নূর , হাসন রাজার গান খুবই পছন্দ করে।এমন কোন অনুষ্ঠান নেই যেখানে "ঝিলমিল ঝিলমিল করে ...' এই গানটা গাওয়া হয়না। আমি বলি এটা তাদের জাতীয় আঞ্চলিক সঙ্গীত। এটা ছাড়া কোন অনুষ্ঠান এখনো দেখিনি। এই গানটা কলকাতার দোহার ব্যান্ডের গাওয়া গানটা আমার কাছে সবচেয়ে পছন্দের। এই দোহার ব্যান্ডের লোকজনের আদি নিবাস এই সিলেটে। তাই তাদের কণ্ঠে সিলেটি উচ্চারন সুন্দর ভাবে আসে।
এই অঞ্চলের বাউলদের আধিপত্যের কারণেই হয়তো নতুনরা বাউল ধারায় গান করতে পছন্দ করেন। নিশি হচ্ছে তাদেরই উত্তরসূরি। তার কণ্ঠে যখন শুনি হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ খ্রিস্টান এক মায়ের সন্তান। তখন সহজে ধরা দেয় বাউলদের সহজিয়া চিন্তা। ধর্মীয় বৈষম্য তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা চিন্তা করে আমাদের মতো জটিল ভাবে না। সহজ সরল ভাবে। সেই চেনা সুরে সে গেয়ে যায় একে একে সব গান।
আমরা অনেক কিছুই তো আশা করি। অনেক কে নিয়েই তো স্বপ্ন দেখি। নিশিকান্ত কে নিয়েও আমার,আমাদের অনেক স্বপ্ন। কিছু যত্ন,কিছু স্পর্শ পেলে হয়তো সেও হয়ে উঠতে পারে শাহ আব্দুল করিম,রাধামন,হাসন রাজা। মানুষ অপার সম্ভাবনাময়।
তার কিছু গান পরে একদিন আপলোড করে দিব।