আচ্ছা, কি হলো তারপর?
তারপর, ... তারপর দিগন্তে চোখ রেখে তারা দু’জন ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো পাশাপাশি।
ব্যাস? তোমার গল্প শেষ?
না। তারপর থেকেই তো গল্প শুরু।
তাহলে এতক্ষণ কি বললে?
এতক্ষণ?... এতক্ষণ তো অগণন মানুষের ভীড়ে হেঁটে যাওয়া আগন্তককে সবকিছু থেকে ছিঁড়েছেনে দুটো লক্ষী চোখের মধ্যে এনে বন্দী করলাম। এবার সেখানে ভবিষ্যৎ নির্মান করবো।
তাই?
হ্যাঁ, তাই।
আচ্ছা, মেয়েটার কি হবে? ও কি আবার ওর বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাবে?
না। মোটেই না। এবার ভীষণ কঠিন জীবনে নিয়ে যাবো তাকে আমি। একেবারে টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেবো দুর্গন্ধময় দারিদ্রে।
এতোটা নিষ্ঠুর হবে তুমি?
হ্যাঁ। গল্পের প্রয়োজনেই আমাকে তা করতে হবে।
তাহলে কেন ওদের দুজনকে দুই পৃথিবী থেকে টেনে এনে এক করলে? বেশ তো ছিলে ওরা।
না। ওরা বেশ ছিলো না। ওরা অসুখী ছিলো। ওদের স্বচ্ছলতা ছিলো কিন্তু পূর্ণতা ছিলো না। এখন ওরা পূর্ণ হয়েছে। দেখো, কী ভয়াবহ বাঁধনে ওদের বেঁধে দিয়েছি যে পরিবার-পরিজন-বন্ধু-বান্ধব সবকিছু ছেড়ে কেমন পালিয়ে এসেছে এই সমুদ্রের তীরে। এর নাম কি জানো?
জানি, প্রেম।
না। ঠিক হলো না। এর নাম নির্ভরতা। এর নাম বিশ্বাস। অথবা এর নাম বোঝাপড়া। প্রেম এখন একটা যাচ্ছেতাই শব্দ; যা মূল্য হারিয়েছে অনেক আগেই। প্রেম আর প্রতারণা একবিংশ শতাব্দীতে এসে সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। ওতে আর জ্যোতি নেই। ওতে আর জোর নেই। তারচেয়ে ‘বোঝাপড়া’ শব্দটা অনেক সুন্দর। ‘বোঝাপড়া’ শব্দটার ভেতরেই কেমন একটা বোঝাপড়া আছে।
তাই? আচ্ছা, সন্ধ্যা নেমে এলো যে! এখন কোথায় যাবে ওরা?
ঐ যে দূরে পাহাড় দেখতে পাচ্ছো, হ্যাঁ, একেবারে দক্ষিণে যেখানে আসন্ন সন্ধ্যার ম্লান আলো বৃষ্টির ফোটার মতো আছড়ে পড়ছে গাছের পাতায়, ওই যে সারি সারি গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়জুড়ে; যেখানে একঝাঁক ধূসর বক নিজেদের আড়াল করে নিলো কেবলই; ওরা যাবে তারও পেছনে মাইলখানেক দূরের রূপহীন রঙহীন উঁচুনিচু দুর্গম আদিবাসী এক গ্রামে। ওই দেখো, ওরা হাঁটতে শুরু করেছে পাহাড়টাকে লক্ষ্য করে। কিছু দেখতে পাচ্ছো?
হ্যাঁ।
কি?
ওরা হাঁটছে পাহাড়ের দিকে।
আর কিছু না?
কই না তো।
কেন? দেখছো না মেয়েটা তার ডান হাতটা ছেলেটার বাম হাতের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে। এর নাম কি জানো?
জানি, বোঝাপড়া।
না, হলো না। এর নাম সমর্পণ। নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মধ্যে, নিজেকে ঢেলে দেয়ার মধ্যে, নিজেকে মুক্ত করে দেয়ার মধ্যে একটা তৃপ্তি আছে। সমর্পিত হওয়ার এক অদ্ভুত অসাধারণ অলৌকিক আনন্দ আছে। গতিময়তা আছে। আছে নির্মল শুদ্ধতা।
তাই?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, এখানে তো কাউকেই চেনে না ওরা। ওদের কোনো বিপদ হবে না তো?
অবশ্যই হবে। ওই পাহাড়ে উঠতে উঠতেই আমি কলমের একটানে রাত্রি নামিয়ে আনবো। অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে ডালপালার খোঁচায় রক্তাক্ত হবে ওদের শরীর। পা পিছলে যাবে বার বার। আঙ্গুলের ফাঁকে জমে যাবে ক্লান্তির বড়ো বড়ো গর্ত। এভাবেই একসময় ওরা পৌঁছুবে উপত্যাকায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত পা হারিয়ে ফেলবে চলৎশক্তি। তখন রাতের আকাশটাকেও আমি ঢেকে দেবো গাঢ় অন্ধকারে। কোনো চাঁদ রাখবো না মাথার উপরে। থাকবে না কোনো তারাও। একেবারে ঘুটঘুটে নিকষ অন্ধকারে ঢেকে দেবো পাহাড়টাকে।
প্লিজ, এমন কোরো না তুমি? ছেলে মেয়ে দুটোকে কষ্ট দিও না?
তুমি অন্ধ, তাই একে কষ্ট বলছো। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, ওরা পাশাপাশি বসে আছে পাহাড়ের উপত্যাকায়। কিছু শুকনো ডালপালা গুছিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়েছে ছেলেটা। ব্যাগ থেকে বের করেছে একটা টিফিন-বক্স। মেয়েটা বসে আছে ওর কোল ঘেঁষে। একটু একটু করে রুটি ছিড়ে মেয়েটির মুখে পুরে দিচ্ছে ছেলেটি । মায়াবী চোখ নিয়ে মেয়েটি তাকিয়ে আছে ছেলেটির মুখের দিকে। দেখো দেখো, ছেলেটার কোলে মাথা রেখে কেমন নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লো মেয়েটা। জানো, কি এর নাম?
জানি, সমর্পণ।
না। ঠিক হলো না। এর নাম আশ্রয়। মানুষের এমন আশ্রয় যখন দুর্লভ হলো পৃথিবীতে, তখনই তারা ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে বড়ো বড়ো প্রাসাদ তৈরি করতে শুরু করল আশ্রয়ের আশায়। এখন যা ইতিহাসে সভ্যতা নাম নিয়ে মানুষকে ব্যঙ্গ করে চলেছে প্রতিদিন।
আচ্ছা, এখন কি হবে? কাঠের আগুন তো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। ওদেরকে তুমি কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো না স্বচ্ছল জীবন?
কেন দেবো? ওরা এখনই সবচেয়ে ভালো আছে। ওদের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন এখন। ওই দ্যাখো, মেয়েটাকে জড়িয়ে লতাগুল্মের উপরে কেমন ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা। আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে কাঠের সোনালি আগুন। তবু ওদের মনে কোনো ভয় নেই। শঙ্কা নেই। দ্বিধা নেই। নেই কোনো অপ্রাপ্তির অন্তর্জ্বালা।
আমার ভীষণ ভয় লাগছে। যদি সাপে কাটে ওদেরকে? হিংস্র পশু আক্রমণ করে বসে? প্লিজ, তুমি ওদের কোনো সংকটে ফেলো না?
দ্যাখো, ভোর হয়ে আসছে। নরম নরম মেঘ ভেসে চলেছে পাহাড়টার দিকে। ছেলেটা আর মেয়েটা কেমন নিষ্পাপ ঘুমে ডুবে আছে। দুজনে মিলে মিশে একেবারে এক হয়ে গেছে। ওই দেখো, ঘুম ভেঙে গেলো ছেলেটার। ও এখন তাকিয়ে আছে নিদ্রামগ্ন কামিনীর শুভ্র মুখের দিকে। দ্যাখো, মেয়েটার মুখের ওপরে কতগুলো চঞ্চল চুল এসে ঢেকে দিয়েছে একটি চোখ। দেখো, মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিলো ছেলেটা। ঘুম ভেঙে গেছে ওর। এই পাহাড়ের নির্জন নিস্তব্ধ অরণ্যে দুটি শুভ্র সতেজ কুসুমের মতো লাগছে ওদেরকে। পাহাড়টা এতোদিনে ধন্য হলো।
এখন কোথায় যাবে ওরা?
কেন, এখন ওরা যাবে সেই আদিবাসী গ্রামে। একটা ঘর বানাবে দুজনে মিলে। প্রাসাদ নয় লতাপাতায় আচ্ছাদিত পর্ণকুটির। খড়ে ছাওয়া একচালা। মিশে যাবে আদিবাসীদের সঙ্গে। আদিবাসী হয়ে যাবে ওরা। খুব কষ্ট হবে ওদের। কখনোবা লতাপাতা সিদ্ধ করে খেতে হবে। রোদে পুড়ে ছেলেটার উজ্জ্বল রঙ হয়ে যাবে তামাটে। প্রতিদিন ভোরে শিকারে বেরিয়ে যাবে ছেলেটা। করবে চাষবাস। নিষ্ফলা মাটিতে আনবে সাফল্যের উন্মাদনা। মেয়েটার নরম হাত তাঁত বুনতে বুনতে হয়ে যাবে রুক্ষ। শরীর যাবে বুড়িয়ে। তবুও ওরা সুখী হবে। জানো, কি বলে একে?
জানি, আশ্রয়।
না। ভুল বললে। এর নাম যৌথতা। পাপ নয়, অন্যায় নয়, গ্লানি নয়, বিষণ্ণতা নয়। এর নাম বন্ধন। এখানে কারো একা প্রভু হতে নেই। প্রভুত্বে পাপ হয় এখানে। এখানে সঙ্গী হতে হয়। দুজনে মিলে যৌথ হতে হয়। যৌথতা বন্ধনের প্রথম এবং অনিবার্য শর্ত। নাহলে বন্ধন টুটে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আচ্ছা, ওরা কি আর কোনোদিনও বাড়ি ফিরবে না? ওদের মা-বাবার কাছে? আত্মীয়-পরিজনদের কাছে?
না। ওরা আর কোনোদিনও বাড়ি ফিরবে না। অথবা কোনো একদিন হয়তো ফিরবে। কিন্তু তুমিই বলো, বাড়ি কেন ফিরবে তারা? সেখানে তো কেউ নির্ভরতা, বিশ্বাস কিংবা বোঝাপড়ার মূল্য বোঝে না। সেখানে তো কোনোদিনও আশ্রয় পাওয়া যায়নি। স্বচ্ছলতা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সমর্পনের কাছে স্বচ্ছলতা তুচ্ছ- একথা তো সেখানে কেউ বোঝেনি। যৌথতার বড়ো অভাব সেখানে। কোথায় যাবে তারা?
কিন্তু ওদেরকে এভাবে সবকিছু থেকে তুমি বঞ্চিত করে রাখবে? এতে তোমার কলমের অপমান হবে না?
আমি তো ওদেরকে মোটেই বঞ্চিত করবো না। আমি ওদেরকে নির্মান করবো। তাকিয়ে দেখো, বছর ঘুরতেই একটা ছেলে হয়েছে ওদের। ফুটফুটে। পবিত্র। পূর্ণিমার চাঁদের মতো নির্মল স্নিগ্ধ নিষ্কলুষ আলোতে ভরে গেছে ওদের জীবন। ধীরে ধীরে বড়ো হতে চলেছে ওদের উত্তোরাধিকারী। একসময় সে অনেকদিন পর যখন সবাই ওদের বিস্মৃত হবে তখন হয়তো আদিবাসী পল্লী ছেড়ে দিয়ে ওরা যাবে আরেকটি নতুন ঠিকানায়। জীবনের প্রয়োজনেই। ওদের জীবন আমি রঙে রূপে বৈচিত্র্যময় করে তুলবো।
তাই?
হুম।
তোমার গল্প তাহলে শেষ হবে কখন?
আমার গল্প তো শেষ হবে না। শেষ থেকে আমি আবার নতুন একটা ‘আরম্ভ’ করবো। বিচিত্র। ভয়াবহ। অদ্ভুত কিংবা অচিন্তনীয়। সমাজ ও সংসারের প্রতিষ্ঠিত সংস্কারগুলোকে, যা মানুষ সত্য বলে ভুল করে, সেখান থেকে তুলে আনবো গল্প। প্রেম অথবা বিচ্ছেদের। সৃষ্টি কিংবা ধ্বংসের আরেক নতুন সজীব গল্প আমি এঁকে দেবো সাদা কাগজের গায়ে কালো কালির আঁচড়ে।
আচ্ছা, হয়েছে। অনেক রাত হলো। এখন এইসব খাতা-কলম রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। কাল সকালে আবার তোমাকে শিকারে যেতে হবে। ঘরে তেমন কিছু নেই। ছেলেটাকে আজ শুধু কঁচুশাক দিয়ে ভাত খাইয়েছি। প্লিজ লক্ষীটি, গল্প রেখে ঘুমোও এখন।
(১২/০৬/২০১৪)
[গল্পটি সাহিত্য শিল্পের ত্রৈমাসিক 'প্রতিকথা'র চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত]