মিরপুর ,কাফরুল , ধানমন্ডি , মোহাম্মদপুর,আজিমপুর,পরিবাগের কিছু বাসায় গত শুক্রবার ভোর একটু আগেই হয়েছিলো! খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে জামা কাপড় পরে, ক্যামেরা/ব্যাগ গুছিয়ে তারা অপেক্ষা করছিলো কিছু তরুণ! নীলচে রঙের মাইক্রোবাসে করে তারা আজ যাবে কোথাও!
কোথায় বেড়াতে?
ছুটি কাটাতে?
বনভোজনে?
নাহ!
তাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো বগুড়ার এক দুর্গম গ্রামের একটি স্কুলের তিনশ'র বেশি ছাত্র ছাত্রীদের সাথে সময় কাটানো ,কিছু শেখানো ...অবাক হয়েছেন? আসুন সেই তরুণদের স্বপ্ন যাত্রার কথা শুনি ।
গত শুক্রবার কমিউনিটি অ্যাকশন এর ১১ তরুণ বগুড়ার পথে রওনা হয় ৬ টার আগে । তরুণ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী সোহায়লা রিদওয়ান । তাঁর
সাথে ছিলেন নানা বয়সের নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের তরুণদল! চলুন তাঁদের চিনে নেই
সুপ্তি (MBA)
মৌরিন (CSE,MIST)
বাপ্পি ( CSE, BUET)
তারিন (Arch ,BUET)
তাওসীফ (EEE,NSU)
জুবায়ের (ETE,NSU)
পুজা (Biotechnology ,NSU)
জাফরি ( এ লেভেল পড়ছে)
তানজিম (মাত্র এ লেভেল পাস করেছে, মাষ্টারমাইন্ড থেকে)
জারির (কলেজের ছাত্র! রাইফেলস পাবলিক কলেজে পড়ছে ও )
স্বপন পারের ডাক শোনা এই দলটি যার ডাকে সাড়া দিয়েছিল তিনি হচ্ছেন
ডাঃ ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ । বগুড়ার ধুনটের ছেলে তিনি । অনেক বড় ডাক্তার হয়েও নিজের গ্রামকে কখনো ভোলেন নি তিনি । নিজের গ্রামে
আরও এমন ডাক্তার, প্রকৌশলী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে একটি স্কুল গড়ে
তুলেছেন । নিজের পকেট থেকে ,পরিচিতদের সাথে নিয়ে তিনি
গড়ে তুলেছেন এই স্কুলটি যেটা ঠিক প্রচলিত স্কুলের মত নয়, শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম এখানে চলছে ।
সাহায্য চেয়েছিলেন কমিউনিটি অ্যাকশন এর । কাজ করতে ব্যাকুল কমিউনিটি অ্যাকশন সাথে সাথেই সাড়া দেয় । ৪ জন অ্যাকশনিয়ার
চলে যায় গত এপ্রিলে স্কুল পর্যবেক্ষণে । স্কুলের নানা বিষয়াদি নিয়ে তারা রিপোর্ট করে ঢাকায় । সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কমিউনিটি অ্যাকশন এর মধ্যে নানা আলোচনা হয় কীভাবে স্কুলটিকে সাহায্য করা যায় ।
তার কিছুদিন পর পুরো প্রস্তুতি সহকারে অ্যাকশনিয়াররা
ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি কুইজ পরীক্ষার আয়োজন করে ।
সেই কুইজ পরীক্ষার লক্ষ্য ছিলো ছাত্র ছাত্রীদের অবস্থা যাচাই করা,
প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা , পড়ায় আগ্রহী করে তোলা ।
কুইজ পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ছাত্র ছাত্রীদের পুরষ্কার ও
দেয়া হয় ।
তারপর শুরু হয় কমিউনিটি অ্যাকশন এর মেগা ইভেন্ট এর প্রস্তুতি পর্ব!
নিম্মি,শুভ,তারিক,ফয়সাল, স্বর্না সহ আরও একঝাঁক অ্যাকশনিয়ার এই প্রস্তুতি পর্বে সোৎসাহে কাজ করে । বাচ্চাদের ইংরেজিতে আগ্রহী এবং শক্তিশালী করার জন্য স্পেলিং বী প্রতিযোগিতার প্ল্যান করা হয় । একদল লিস্ট তৈরি করে । সেই লিস্ট পাঠিয়ে দেয়া হয় বগুড়ায় । বাচ্চাদের জন্য ঔষধ যোগাড় করা হয়, প্রতিযোগিতায় সেরাদের দেবার জন্য পুরষ্কার কেনা হয় , স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য ভিটামিন সহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য যোগাড় করা হয় , সেই তথ্য সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য চলে অনেক গবেষণা! শুধু শেখানো নয় আনন্দ দেয়াটাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষ্য । এবং সেই সাথে চলে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ কর্মশালার প্রস্তুতি!!
চাইল্ড সাইকোলজির বই থেকে শুরু করে ইন্টারনেট ঘেঁটে ,টিচিং মেথড, লিডারশীপ, ম্যানেজমেন্ট সহ বিভিন্ন বিষয় এর উপর পড়াশোনা করে প্রস্তুত হতে থাকেন অ্যাকশনিয়ারগণ!
ফিরে আসি সেই অদ্ভুদ নীল আকাশের সকালটিতে । ব্রাজিলের
খেলা মিস হবে জেনেও আমরা ব্রাজিল ভক্তরা (এবং ব্রাজিল বিদ্বেষীরা )
সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম! আমরা ৬ টার দিকে রওনা শুরু করে
পৌছাই ১২ টার কিছু পরে সেই দুর্গম গ্রামে । ডিজিটাল বাংলাদেশ
এর ছোঁয়া যেখানে এখনো পড়ে নি । ইলেকট্রিসিটিই নেই ... ...
৩৫০+ ছাত্রছাত্রী আমাদের যাওয়ার আগেই পৌছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো!
রাস্তার ক্লান্তিকর ভ্রমণের কষ্ট আমরা সবাই ভুলে গেলাম ঔৎসুক ছাত্র ছাত্রীদের দেখে ।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন গ্রামের বিশিষ্ট মানুষজন ।
সোহায়লা আপু তাঁদেরকে ব্যাখ্যা করলেন আমরা কেন এসেছি , কী করতে চাই ।
আজকে ছোট কালকে মোরা বড় হব ঠিক
জ্ঞানের আলোয় আমরা আলো করব চতুর্দিক ।
শ্লোগান এর ব্যানার নিয়ে আমরা কাজ শুরু করে দিলান ।
ছাত্র ছাত্রীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন রুমে নিয়ে শুরু হল মজাদার স্পেলিং বী কন্টেস্ট! ছাত্র ছাত্রীরা এমনটি এর আগে করে নি ।
ওদের আগ্রহ উত্তেজনা ছিলো দেখার মত! একটি শব্দের
বানান পারলেই একটি পুরষ্কার! ওদেরকে স্পেলিং বিষয়ে টিপস দেয়া হয়েছিল সাথে সাথে ইংরেজির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয় ।
অন্যদিকে চলতে থাকে শিক্ষকদের নিয়ে ওয়ার্কশপ ।
কীভাবে ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো উচিত, গ্রুপ স্টাডির উপকারিতা,
প্রশ্নের গুরুত্ব, ফিডব্যাক নেয়া , দুর্বলতা যাচাই সহ বিভিন্ন বিষয় শিক্ষকদের শেখানো হয় । তাদের চিন্তার পরিবর্তন আনতে ব্যাপক ভাবে ব্রেইনস্টর্মিং করানো হয়, এসাইন্মেন্ট দেয়া হয়।
তারা অতঃপর বিশ্বাস করতে থাকেন,এখানে তারা শুধু পড়াতে আসবেন না আর, আসবেন একজন অভিভাবক হয়ে, একজন বন্ধু হয়ে
এই বাচ্চাগুলো তাদেরি সন্তান, সর্বোচ্চ যত্নে তাদের মানুষ বানাতে হবে! আর একজন শিক্ষিত কৃষক আর একজন শিক্ষিত ডাক্তারের
মধ্যে কোন পার্থক্য নেই! সবাই এদেশের সম্মানিত নাগরিক!
জুমা'র নামাজ এবং দুপুরের খাওয়া শেষে আবার শুরু হয় পড়াশোনা এবং মজা !
এবারে সিনিয়র গ্রুপকে নিয়ে আমি মজার গণিত ক্লাস করাতে শুরু করি ।
গণিতের প্রতি এদের আগ্রহী করে তোলাই ছিলো মূল লক্ষ্য । কী যে অদ্ভুদ একাগ্র মনোযোগ এদের!
বাকিরা আরও মজার কাজ করে!
তাওসীফ বিশ্বের মানচিত্র আর অন্যান্য তথ্যাবলী নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে শুরু করে ।
তারিন সহজ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকানো শেখায় এবং এর ভেতরে কোথায় কোন নদী,বিভাগ আছে সে সব দেখায় ।
সুপ্তি,মৌরিন ভিটামিন এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই সব বস্তুর ছবি আঁকায় ।
বাকিরা এদেরকে সাহায্য করে । আঁকা শেষে মজার রঙ করা শুরু হয়!
ছাত্রছাত্রীদের রঙ করার স্টাইল দেখলে অবাক হয়ে যেতে হবে!
অনেকে তাক লাগানো ছবি এঁকে ফেলে । শেখার প্রতি
এদের যে কত আগ্রহ আছে তা না দেখলে বোঝানো যাবে না! এদের জন্য শোলার বোর্ড , পিন নেয়া হয়েছিলো । যাদের ছবি ভালো হয়েছে তাদের ছবি বোর্ডে টাঙিয়ে স্কুলের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
নিজেদের আঁকা ছবি নিজেদের স্কুলের দেয়ালে! কত্ত মজা!
সানিডেইল স্কুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, রঙ এবং পেন্সিল ডোনেট করার জন্য।
কমিউনিটি অ্যাকশন এর বই অন্বষণ প্রজেক্টের মাধ্যমে সংগৃহীত বই থেকে তিনশতাধিক বই স্কুলকে দেয়া হয় , একটি লাইব্রেরী করার জন্য।
সাথে সাথে শিক্ষক এবং সিনিয়র ছাত্রদের শেখানো হয় কীভাবে এই লাইব্রেরী মেইন্টেইন করা যায় । বই এর প্রতি ওদের আগ্রহ দেখে আমরা আশান্বিত হয়েছি ।
বই এর তালিকায় গল্প, কমিক্স থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ,নীতিকথা সবই ছিলো । ধন্যবাদ "শুধুই মুক্তিযুদ্ধ" কে,
আমাদের স্বল্প মূল্যে বীরশ্রেষ্ঠদের উপর লেখা বই গুলো দেবার জন্য!
সোহায়লা আপু বই পড়তে এবং এ থেকে জ্ঞান নিয়ে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেন ।
এরপর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পালা!
প্রতি বিভাগের ৩ জন করে পুরষ্কার দেয়া হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাধ্যমে নির্বাচিত ছাত্রছাত্রীদের । এবং ভবিষ্যতেও
এরকম আরও প্রতি্যোগিতার আয়োজন করা হবে বলে ছাত্রছাত্রীদের জানানো হয় ।
যারা পারে নি ওরা যেন নিরাশ না হয় এবং পড়া চালিয়ে যায় এই সব ও বলা হয়।
ওদের করতালিতে মুখরিত ছিল খাদুলী গ্রাম, ওদের হাসিতে হাসিতে ভরে ছিল আমাদের সবার হৃদয়!
সবশেষে ওদের জন্য ছিল একটি সারপ্রাইজ!
এর আগের বারের তোলা ছবি গুলো প্রিন্ট করে দুটি বোর্ডে টাঙিয়ে
নেয়া হয়েছিলো! নিজেদের ছবি দেখে ওদের সে কী
উৎসাহ! (এই সময়টিতে আসলেই আমাদের সবার গর্বে বুক ভরে গিয়েছিলো । )
রাত ১২ টার দিকে একেক জন তাদের বাসায় পৌছায় ।
সারা দিন এই জার্নি শেষে বাসায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে তারা । ঘুমানোর আগে
বুকে অদ্ভুদ উষ্ণতা ছিলো তাদের ।
কিছু করার, কিছু করার চেষ্টার - এক অদ্ভুদ আনন্দ ।
স্বপনপারের ডাক শোনার আনন্দ ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে আলো ছড়ানোর আনন্দ । (আলো, তা যত সামান্যই হোক না কেন!)
এটা হতে পারে একটা উদাহরণ। তাদের জন্য যারা অনেক ঊঠেছেন নিজ যোগ্যতায়, কিন্তু শিকড় ভুলে গেছেন। উদাহরণ হতে পারে তাদের জন্য, যারা পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সময় গুলোকে অনেক বেশী ভালো কাজে লাগাতে চায়। হতে পারে তাদের জন্য, যারা বিশ্বাস করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টির জন্য ভিক্ষার থালায় পয়সার শব্দের চেয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তাদের উদ্দীপনার হাসি অনেক বেশী সুমধুর! অনেক বেশী তৃপ্তির। উদাহরণ হতে পারে তাদের জন্য যারা বড় বড় কথা সহজেই বলে ফেলেন, লিখে ফেলেন অদ্ভুত দক্ষতায় কিন্তু পরিবর্তন আনার জন্য যে অগ্রগামী দলের মিছিল দরকার, সেখানে তাদের পাওয়া যায়না। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলো কত বড় বড় স্বপ্ন দেখছে, দেখে ফেলেছে, ভাবলেই আবেগে আক্রান্ত কি হন না আপনি ? আমি কিন্তু হই!
কমিউনিটি অ্যাকশন
ফেইসবুক এলবাম ছবিগুলো দেখুন ভালো লাগবে ।