হুমায়ূন আহমেদ বহুবার তার সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন । এমনটা করে কেউ পারেনা, বলেনা । নাটকে কেউ ক্ষুধার কথা লিখেনা, লিখেনা অশ্রু বা পঙ্গুত্বের কথা । মানুষ হয়তো চোখের জল ফেলার জন্য নাটক সিনেমা দেখবে এটা ভাবনার বাইরে। চারপাশে এত ক্ষুধা, অভাব, সংগ্রাম, কিন্তু সেটা লেখক, নাট্যকারের কাহিনীতে অনুপস্থিত । আমাদের বিনোদন গুলো আমাদের মানুষ করেনা, বিবককে নাড়া দেয়না। নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসাই তো পৃথিবীর আর সব না।
আপনি ২০ পর্বের একটা সিরিয়াল বানাতে পারেন । একজন সাংবাদিক যিনি বহু অন্যায় ও অবিচারের সাক্ষী । ঘরে ফিরে রাতের ঘুমে সেই অবিচারে ক্লিষ্ট মুখ গুলো দেখেন, তাড়িত হন । এটা ক্রাইম সিরিয়াল নয়। এটা মানুষের দুর্ঘটনা আর পঙ্গুত্বের কাহিনী, স্বামী হারা মায়ের ভিক্ষে করে ক্ষুধার্ত চার সন্তানকে খাওয়ানোর মুহূর্ত, মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে যাওয়া দরিদ্র-নিরাপরাধ মানুষের জন্য আইনি লড়াই, মসজিদের মুয়াজ্জিনের ছেলের সবজি বেচে বোর্ড স্ট্যান্ড করার গল্প, কিংবা মা-বাবার আদর ছাড়া বড় হওয়া এতিম ছেলের
বিশ্ব জয়ের সংগ্রাম ।
আমাদের মন তাতে শ্রান্ত হবে, শুদ্ধ হবে। বিবেক যদি না নড়ে সে বিনোদনের কী প্রয়োজন?
আপনি ঢাকায় থাকেন । সিলেটের রাজন কিংবা ময়মনসিংহের পদদলিত মানুষদের না জানলেও আপনার চলে। ঢাকায় অভাব নেই, বাকি বাংলায় অভাব আছে, মঙ্গা আছে, ক্ষুধা আছে।আপনার চালের প্রয়োজনেই তারা সবজি বেচে বা ধান বুনে নায্য দাম না পেয়ে সর্বসান্ত হয়।
মাদ্রাসাতে সারিসারি করে বসা নিষ্পাপ এতিমের মুখ গুলো এখনও ভাসে। কূপিবাতির আলোতে কোরআন পড়ে আলু ভর্তা, তরকারি, ভাত। আপনার উচ্চ আধুনিক শিক্ষা এই এতিমদের ঠায় দেয়নি । তাদের দুনিয়া বলতে কিছু নাই, পুরোটাই পরকালের জীবন। মা-বাবার আদর বঞ্চিত শিশুরা যখন রিক্সা চালায়, কায়িক শ্রম দেয় তখন আপনার রংধনু মার্কা রঙিন মানবতাবোধ কোথায় থাকে?
রাজনের বাবা সাংবাদিক নন যে তার সন্তানের বিচারে নিয়ে পত্রিকাতে ঝড় তুলবেন । মুক্তিযোদ্ধা শামীম ওসমানের কিছু যায় আসবেনা ত্বকী হত্যাকান্ডে, ত্বকীর বাবা চিৎকার করার পরিণতি উল্টো তার জেল-জরিমানাই হলো। পা হারা লিমন কিছুটা ভাগ্যবান, কিন্তু ক্ষমতাসীন ও তার দোসরবাহিনী রেহাই দেয়নি। রাজনের অসমাপ্ত জীবনের জন্যই আমাকে স্বর্গে বিশ্বাস করতেই হবে, রাজনের নিষ্পাপ আত্মার সদগতির জন্যই স্বর্গের অস্তিত্ব থাকতে হবে।
হুমায়ূন আহমেদের সেই বোতল বন্দী দৈত্যের বাচ্চাটা মানুষের বাচ্চাকে ভালোবেসেছিল, মানুষের বাচ্চার ক্ষুধা-অভাবে তার সাথেই ভিক্ষে করতে নেমেছিল দৈত্য বাচ্চাটি। যা পয়সা পেত, মানুষের বাচ্চাটাকে দিয়ে দিতো। দৈত্যের বাচ্চা দেখে মানুষ তাকে ভিক্ষে দিতোনা, তাও সে ভিক্ষে করতো । বাচ্চা দৈত্যের বাবা-মা তাকে তুলে নিয়ে যাবার আগে, দৈত্য বাচ্চার চোখের জল শিশুদের নাড়া দিয়েছিল।
হূমায়ূনের মত করে আর কেউ লিখেনা, নিজের লেখা লিখে-পড়ে আর কেউ কাঁদেনা ।
ধূলি মাখা সবজি বিক্রেতা ১২ বছরের রাজনের কী স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল? তারা বাবা-মার কথা? নাকি তার ধূলিমাখা রক্ত-অশ্রু-ক্ষুদপিপাসা ছাপিয়ে ছিল শুধুই খুনিদের উল্লাস ?