আপনারা যারা পোস্টডক করছেন, পিএইচডি শেষ করেছেন কিংবা শেষের পথে, অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফ্যাকাল্টি পজিশন খুঁজতেছেন – সহজ কথায় বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা করা যাঁদের উদ্দেশ্য, আমার এই লেখাটি তাঁদের জন্য! পৃথিবীর একেক দেশের শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন, যদিও মৌলিক কিছু অভিন্নতা আছে। আজকের লেখাটি শুধুমাত্র আমেরিকার জন্য প্রযোজ্য, কেননা এই লেখায় সাম্প্রতিক সময়ে আমার আমেরিকান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলভাবে 'সহকারী অধ্যাপক' নিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট ভিসা পাওয়ার অভিজ্ঞতার গল্প ধাপে ধাপে বিস্তারিত তুলে ধরব। কাহিনীটি একান্তই আমার নিজের,আশা করি এর ফলে আপনাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে এবং সেভাবে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।
প্রথমত, বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য থাকতে হবে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো শুধুমাত্র স্নাতক (বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট ইত্যাদি) কিংবা স্নাতকোত্তর (ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ইত্যাদি) পর্যায়ের ফলাফল দিয়েই শিক্ষক/প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয় না। আপনাকে স্নাতক থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে স্নাতকোত্তর, পিএইচডি এবং পোস্টডক পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে কথা বলার স্টাইল থেকে শুরু করে লেখাপড়ার অদম্যতা, মেধা, একাডেমিক স্মার্টনেস, ফলাফল, পাবলিকেশন, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। ইহা প্রায় ১০-১৫ বছরের সামগ্রিক এক অর্জনের সমতুল্য ।
মনে রাখবেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে এই লেখাটি সর্বজনীন পরিস্থিতিকেই তুলে ধরবে। আমেরিকাতে শিক্ষকতার ধাপসমূহ হল – সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, এবং অধ্যাপক। আপনি নবীন পিএইচডি/পোস্টডক গবেষক হলে সহকারী অধ্যাপক হিসাবেই শুরু করবেন বা সংশ্লিষ্ট চাকরি খুঁজবেন। শিক্ষতার আবার প্রকারভেদ আছে, যেমন: টেন্যুর ট্র্যাক (Tenure-Track), নন-টেন্যুর ট্র্যাক, ফিক্সড টার্ম, ভিজিটিং, সেমিস্টার ভিত্তিক, ইন্সট্রাক্টর, এবং কোর্স ভিত্তিক ইত্যাদি। এর মাঝে সবচেয়ে ভাল হল, 'টেন্যুর ট্র্যাক' – এই পজিশনে প্রায় ৫-৬ বছর সফলতার সাথে চাকরি করার পর একটি কঠোর মূল্যায়ন পরীক্ষায় সফল হলে আপনার বেতন আসবে স্টেট্ বাজেট থেকে এবং আপনার চাকরি স্থায়ী হবে। 'নন-টেন্যুর ট্র্যাক' ও খারাপ নয়, এই ক্ষেত্রে আপনি চাকরি করতে করতে বিভাগের বসদের মর্জি হলে 'টেন্যুর ট্র্যাক' পাবেন, এরপর অতিরিক্ত ৫-৬ বছর লাগবে চাকরি স্থায়ী হতে। বাকিসব পজিশন হল অস্থায়ী, খন্ডকালীন এবং বিশেষ চুক্তিভিত্তিক চাকরি। সেজন্য আমেরিকায় সচারচর সবার চোখ থাকে 'টেন্যুর ট্র্যাক' পদের দিকে, তাহলে সোনায়-সোহাগা, বিশেষ করে যারা আমেরিকার গ্রিনকার্ড বা নাগরিকত্ব পেতে চান!
আমেরিকাতে মূলত সেপ্টেম্বর-মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে প্রকাশক করা হয়, আপনি আপনার ডিসিপ্লিন/Subject ভিত্তিক ওয়েবসাইট থেকে ঐ জব সার্কুলারগুলো খুঁজে পেতে পারেন; এছাড়াও আপনার সাবজেক্টের পেশাদারি সংস্থার সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট থেকেও এইসব চাকরির বিজ্ঞপ্তি পেতে পারেন। নিজ নিজ সাবজেক্টের সিনিয়র কিংবা যারা সমপর্যায়ে চাকরি করছেন তাঁদের কাছ থেকেও পেতে পারেন ঐসব ওয়েবসাইটের ঠিকানা। সব সময় চোখকান খোলা রাখবেন এবং সপ্তাহে কমপক্ষে একবার সংশ্লিষ্ট সকল ওয়েবসাইট ব্রাউজ করবেন, এবং জব ইমেইল এলার্ট সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। যেমন: আমার নগর পরিকল্পনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডিসিপ্লিনের জন্য "American Association of Geographers (AAG)"-এর জব সাইটে অনেক প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়।
তাহলে আমার গল্প শুরু করা যাক – আমি ইংল্যান্ডের University Colleg London (UCL)-এ ২০১৩ সালে পিএইচডি (PhD) শুরু করি, এরপর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পিএইচডি শেষ করে একই বিভাগে পোস্টডক (Post-Doctoral) শুরু করি। পোস্টডক হল পিএইচডি পরবর্তী সময়ে প্রজেক্ট এবং গবেষণা নির্ভর অস্থায়ী একটি চাকরি, প্রজেক্ট/ফান্ডিং শেষ তো চাকরি শেষ। আমার প্রাথমিক চুক্তি ছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৩ বছরের পোস্টডক। পোস্টডকে আমার কাজ ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে গবেষণাপত্র/ আর্টিকেল প্রকাশ করা। প্রথাগতভাবে পোস্টডক সময়টাকে আমরা একটি স্থায়ী একাডেমিক চাকরি খুঁজে পাওয়ার পরিবর্তনকাল হিসাবে ব্যবহার করে থাকি। এমতাবস্থায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষক হিসাবে স্থায়ী একটি চাকরি খুঁজতে শুরু করি – মূলত ইংল্যান্ড, আমেরিকা, এবং অস্ট্রেলিয়াতে। কারণ হিসাবে বলা যায় এসব দেশে ভাষার মাধ্যম হল ইংরেজি, জীবনযাত্রার মান উন্নত, এবং স্থায়ী চাকরি থাকলে ইমিগ্রেশন/অভিবাসন প্রক্রিয়া তুলানামূলক অনেক সহজ। আর ছোটবেলায় হুমায়ুন আহমেদের "হোটেল গ্রেভার ইন" পড়ে আমেরিকান পিএইচডি/একাডেমিক লাইফ নিয়ে প্রথম জানতে পারি, হয়তবা তখন থেকেই একটা দুর্বলতা ছিল। আজকে শুধু আমেরিকা নিয়েই কথা বলব। আমেরিকার একটি ভাল দিক আছে যে, ওদের সার্কুলারগুলোতে জাতি, বয়স, ধর্ম, বর্ণ, পূর্বপুরুষ, লিঙ্গ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রতিবন্ধকতা, জেনেটিক তথ্য, যৌন অভিযোজন, বা গর্ভাবস্থা ইত্যাদি ভেদে সবাইকে সমান অধিকার দেয়া হয়; কেননা শুধুমাত্র যোগ্যতাকেই প্রধান মানদন্ড বিবেচনা করা হয়।
চাকরিতে আবেদন করার সময় প্রাসঙ্গিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত আবশ্যিক শর্তগুলি খুব ভালভাবে পড়বেন এবং মিলিয়ে নিবেন যেন আপনার ডিগ্রী (BSc, MSc, PhD), পাবলিকেশান, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা ফান্ড জোগাড় করা, এবং গবেষণা ভিত্তিক প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা ইত্যাদির সাথে শর্তগুলি মিলছে কিনা, সামগ্রিকভাবে ৭০% ভাগের মতো মিল থাকলে তবেই এপ্লাই করুন। আমেরিকাতে একটি 'টেন্যুর ট্র্যাক' চাকরির বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে বর্তমানে প্রায় ২০০+ আবেদন জমা হয়। তাই খুব বেশি প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে এপ্লাই করাটা হবে অযথা সময় নষ্ট, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই কমিটি (Search/Selection Committee) একদম খুঁজে খুঁজে যথাযথ প্রার্থীকেই শেষ পর্যন্ত নিয়োগ দিবে, এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন!
চাকরি খোঁজার শুরুতে, আমি কয়েক মাসের মাঝে ইংল্যান্ডে বসে প্রায় ১৫-২০ টা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আবেদন জমা দেই। এখন শুধুমাত্র "Western Washington University (WWU)" নিয়েই কথা বলব, কেননা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় এক বছরের চুলচেরা প্রক্রিয়া শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার চাকরি হয়। আমি ওদের অনলাইন প্লাটফর্মে মিড-জানুয়ারি ২০১৮ সালে আবেদন করি। আবেদনের সময় জমা দিতে হয় – একাডেমিক জীবন বৃত্তান্ত/CV, কাভার লেটার, আলাদা আলাদা করে শিক্ষকতা (teaching), গবেষণা (research), এবং বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি (diversity & inclusion) বিবৃতি, সকল ডিগ্রির সনদ এবং মার্কশিট, ১-২ টা প্রকাশিত আর্টিকেলের পিডিএফ ফাইল, এবং ৩-৪ জন প্রফেসরের বিস্তারিত (নাম, ইমেইল, ও ফোন নম্বর) যারা আপনাকে রেফারেন্স দিবে। এইসব কাজগপত্রের উপর ভিত্তি করেই আপনাকে সংক্ষিপ্ত তালিকা ভুক্ত (short list) করা হবে; তাই এই ডকুমেন্টগুলো অনেক সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে লিখতে হবে।
আমার চাকরির টাইটেল ছিল – "Assistant Professor (tenure-track) in Geospatial Analysis, Social Justice, and Climate Change"; তো অনালাইনে সব কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রায় এর মাস পর একটা ইমেইল পেলাম যে আমাকে আটজন প্রার্থীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (long list)। বলে রাখা ভাল, আমার এই পজিশনের বিপরীতে মোট ২০৮ টি আবেদন জমা হয়েছিল। ইহাও একটি বড় অর্জন! এরপর আমার রেফারেন্সের তিনজন অধ্যাপকের কাছ থেকে সুপারিশপত্র, অরিজিনাল পিএইচডি সনদ ইত্যাদি চেয়ে পাঠালো; সবাই নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে একে একে ইমেইলে সুপারিশ পাঠালেন। এর এক মাস পর ইমেইল পেলাম যে আমাকে সহ আরো দুজনকে সংক্ষিপ্ত তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে, এবং আমাকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ২ দিন ব্যাপী অন-ক্যাম্পাস সাক্ষাত্কারের জন্য ডাকা হয়েছে। ইহা একটি খুবই খুশির খবর এবং জীবনে প্রথম এমন ডাক পেলাম আমেরিকায়! ওরা আমার রিটার্ন ফ্লাইট টিকেট, হোটেলে থাকা, এবং খাওয়াসহ সকল খচর বহন করবে। আগেই আমার একটি ইউএস ভিসা (কসফারেন্স ক্যাটাগরি) ছিল তাই নতুন করে এপ্লাই করতে হয় নাই। ক্যাম্পাসে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে আমাকে ওরা বিস্তারিত পাঠায় – কি কি প্রেজেন্ট করতে হবে, কার কার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে, এবং অন্যান্য বিষয়।
Western Washington University (WWU) ওয়াশিংটন স্টেটের বেলিংহাম নামক একটি ছোট্র শহরে অবস্থিত (সিয়াটল থেকে দেড় ঘন্টার ড্রাইভ), খুবই মনোরম পরিবেশ, শহুরে কোলাহল নাই, এক পাশে পাহাড় আর আরেক পাশে সমুদ্র, কানাডার বর্ডার (ভ্যাঙ্কুভার) থেকেও খুব কাছে, গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়ানোর জন্য একটি পর্যটন এলাকা। লন্ডন থেকে সরাসরি ফ্লাইটে সিয়াটল এসে মাইক্রোসফটে কর্মরত আমার এক স্কুল এবং বুয়েট জীবনের বন্ধুর বাসায় ৩ রাত থাকলাম প্রথমে, উদ্দেশ্য ছিল একটু বিশ্রাম করা, জেট ল্যাগ কাটানো এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া। এরপর চতুর্থ দিন সকালে বাস নিয়ে রওনা দিলাম বেলিংহামে, আমাকে বাসস্টপে WWU-এর একজন প্রফেসর অভ্যর্থনা জানালেন, এবং উনার গাড়িতে করে হোটেলে নিয়ে গেলেন। মনে রাখবেন এই ধাপ থেকেই আমার ইন্টারভিউ শুরু হয়ে গেছে, এরা সকল কিছু খেলায় করবে – আমি কিভাবে কথা বলি, আমি কতটা ফ্রেন্ডলি, আমি ওদের সাথে ঠিকভাবে মিশতে পারবো কিনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে আমার ডিসিপ্লিনে দক্ষতাও যাচাই করবে! এসব নিত্যকার্যসূচি আগে থেকেই আমাকে পাঠানো হয়েছে যে মোট ৩ দিন আমাকে কি করতে হবে।
হোটেলে চেন-ইন করার পর উনি চলে গেলেন। আমি ফেয়ারহ্যাভেন নামক একটি এলাকায় ছিলাম, পাশেই সমুদ্রের অতি নয়নভিরাম সৌন্দর্য। বিকালে বের হয়ে আশপাশ একটু ঘুরলাম। এরপর রাতে ডিনারের জন্য অন্য দুইজন প্রফেসর আসলেন (আমি জেন্ডার উল্লেখ করব না, নারী এবং পুরুষ মিলিয়ে ছিলেন সবক্ষেত্রে), আমাকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন, একসাথে ডিনার করলাম, প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় অতিবাহিত করলাম। উনারা নিজেদের পরিচয় দিলেন, কে কি করেন বললেন, গবেষণা এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এরপর আমাকে নিয়ে প্রশ্ন শুরু হল, সিরিয়াস কিছু না, কিন্তু খাওয়া আর গল্পের ছলে পরস্পরকে জানার চেষ্টা। ডিনার শেষে আমাকে হোটেলে ড্রপ করে দিলেন। হোটেলে গিয়ে আমি গোসল করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম, আগামীকাল খুবই কঠিন একটি দিন, রুটিনটা ভালো করে দেখে নিলাম, কখন কার সাথে মিটিং, এবং প্রেজেনটেশন কখন ইত্যাদি। পরিচিত বুয়েটিয়ান কিছু ভাইয়া আর আপুকে কল দিয়ে গল্প শুরু করলাম এবং মনে সাহস নিলাম। রাতে ঠিকমতো ঘুম আসলো না চিন্তায়, ভোরে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্যুটপ্যান্ট পরে রুমে বসে থাকলাম। একটু ভয় করতেছে, মনে মনে নিজেকে স্বান্তনা দিলাম যে – হারানোর তো কিছু নাই, আর কিছু না হোক অন্তত অন্যের পয়সায় এক সপ্তাহ আমেরিকা ঘুরার সুযোগ হলো।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নতুন দুইজন প্রফেসর এলেন, আমাকে নিয়ে গেলেন একটি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করতে। একই কেচ্ছা-কাহিনী, তাদের কর্মকান্ড এবং আমার একাডেমিক জীবনবৃত্তান্ত। এরপর ঠিক সকাল নয়টায় আমাকে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। বাইরে দেখি আমার ছবিসম্বলিত একাধিক লিফলেট দেয়ালে সাঁটানো আছে, কেননা পরের দিন আমার পাবলিক প্রেজেন্টেশন, সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো, কি ভয়ঙ্কর! যাহোক, বিভাগের কমনরুমে নিয়ে আমাকে বসানো হলো, একের পর এক বিভাগীয় শিক্ষকেরা আসতে লাগলেন, সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন এবং নিজের গবেষণার বিষয় নিয়ে কথা বললেন, আমাকেও দুই-একটা করে প্রশ্ন করলেন, দৃঢ়তার সাথে সবাইকে মোকাবিলা করলাম। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো বিভাগীয় ডিনের অফিসে; ডিন মহোদয় অনেক কথা বললেন, একটানা আধাঘন্টা। এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো পূর্ণাঙ্গ কমিটি সাক্ষাত্কারের জন্য, গিয়ে দেখি একটি বোর্ড রুমে প্রায় ৫-৭ জন প্রফেসর বসে আছেন। পরিচিতি পর্ব শেষ হওয়ার পর একটানা একঘন্টা চললো উনাদের একের পর এক প্রশ্ন আর আমিও উত্তর দিতে থাকলাম। লাঞ্চ টাইমে নিয়ে যাওয়া হল এক ঝাঁক নবীন স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে, তাদের সাথে দুপুরের খাবারের ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা চলবে। ব্যুফে লাঞ্চ দেয়া আছে, বেশ কয়েকটি আইটেম ছিল, রুমের ভিতর আবার দুইজন প্রফেসর বসে আছেন আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। আমাকে ছাত্রছাত্রীদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একাডেমিক গল্প করতে হবে, প্রায় ৩০ জন আমাকে ঘিরে বসে আছে, আমি প্রচন্ড বিব্রত এবং চিন্তিত, এহেন বিপদে কখনো পড়িনাই। একটি কথা না বললেই নয়, ওদের অনেকেই বাংলাদেশ কোথায় অবস্থিত তাও জানে না। শুরু হলো প্রশ্ন আর গল্প; ওরা আমাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলো (শুনে মনে হল কিছুটা নির্দেশনা আগে থেকেই দেয়া আছে); আমিও ওদের ক্লাসের ভালমন্দ, কোর্স, ভবিষ্যত, শখ ইত্যাদি যা মনে আসলো প্রশ্ন করলাম, আর মনে মনে দোয়া করতেছিলাম যে কখন এই সেশান শেষ হবে!
অবশেষে আমাকে বিশ্রাম দেয়া হলো, একটা রুমে একা বসে থাকলাম, একটু পর আমাকে একটি এক ঘন্টার ক্লাস নিতে হবে, টপিক হলো – জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এর প্রভাবে মাইগ্রেশন, আমি বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করবো। ক্লাসে গিয়ে দেখি প্রায় ৫০ জন স্টুডেন্টস এবং ৩-৪ জন প্রফেসর বসে আছে, ভিডিও রেকর্ডও করা হবে। পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন আগেই রেডি করা ছিল, ইহা হতে হবে একটি ইন্টারেক্টিভ ক্লাস, উপস্থিত সবাইকেই অন্তর্ভুক্ত করে কিছু একটা করতে হবে, যাতে করে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়। প্রথমে ২০ মিনিট লেকচার দিলাম, এরপর পুরা ক্লাসকে চারভাগে ভাগ করে প্রত্যেক গ্ৰুপকে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট দিলাম, সময় ২০ মিনিট, এর মাঝে প্রতি গ্ৰুপে ৫ মিনিট করে সময় দিলাম, আলোচনা করলাম তাদের ভাবনা এবং আমার প্রতিক্রিয়া, এরপর প্রতি গ্ৰুপকে ৩ মিনিট করে প্রেজেন্টেশন দিতে বললাম, সবশেষে আমি ৫ মিনিটে উপসংহার টানলাম, ক্লাস শেষ। খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি টাস্ক ছিল।
এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে (উনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি), উনার সাথে আধাঘন্টা মিটিং। উনি আমাকে একটু স্বস্তি দিলেন, বললেন – "তুমি অনেক বিদ্ধস্ত, তোমাকে আমি কোনো প্রশ্ন করবো না, বরং আমাকে তুমি প্রশ্ন করো?"; সত্যকথা বলতে কি এ আরেক মহাঝামেলা, আপনি তো আর যা খুশি খাজুরা আলাপ করতে পারবেন না, আবার প্রশ্নগুলাও হতে হবে যথাযথ, ইহাও এক ধরণের পরীক্ষা। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে, আমার বিভাগ নিয়ে, উন্নত গবেষণার সম্ভাবনা নিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এবং আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করলাম।
উনার সাথে দেখা শেষ হলে, একজন প্রফেসর এসে আমাকে সমগ্র ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন, এই ডিপার্টমেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে শুরু করে কোথায় কি আছে, কোন বিল্ডিং কি, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি, স্পোর্টস ফ্যাসিলিটি, পার্কিং ইত্যাদি সব দেখালেন। এরপর আরেকজন প্রফেসর আমাকে উনার গাড়িতে করে হোটেলে দিয়ে আসলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকালে বাইরে ঘুরাঘুরি করলাম, এরপর সন্ধ্যায় দুইজন প্রফেসর আমাকে ডিনারে নিয়ে গেলেন, আবারো একই ধরণের একাডেমিক আড্ডা আর খাওয়া শেষে রাত আটটার দিকে হোটেলে ড্রপ; মনে আছে আমি ডিনারে ভালমতো খেতে পারি নাই, কেননা খাবার আইটেম আমার পছন্দের ছিল না, তবুও কোনোরকম মানসম্মান বাঁচাতে খাওয়ার অভিনয় করেছি। হোটেলে এসেই উবার ইটস-এ পছন্দের খাবার অর্ডার করে খেলাম। বলে রাখা ভালো, ওরা প্রত্যেকবারই আমি কি খাবার খাবো এবং কোন রেস্টুরেন্টে যাবো জিজ্ঞাসা করেছে, কিন্তু লোকাল খাবার নিয়ে ধারণা না থাকায় আমার সিলেকশনে একটু হযবরল হয়ে গেছে। যাহোক, খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিলাম, আবারো ভাইয়া-আপুদের সাথে গল্প শুরু করলাম, উনারা আমাকে সর্বতোভাবে অনেক মেন্টাল সাপোর্ট দিলেন। আজকে রাতেও ঠিকমতো ঘুম হলো না, কেননা আগামীকাল হলো আমার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার দিন!
দ্বিতীয় দিনও শুরু হলো ব্রেকফাস্ট দিয়ে, যথারীতি প্রফেসররা আসলেন, রেস্টুরেন্ট, খাওয়া, গল্প, তারপর বিভাগে আমার আগমন। কমন রুমে বেশ কয়েকজন প্রফেসর আসলেন, আলোচনা হলো। এরপর একঘন্টা GIS লেকচার, স্লাইড আগেই রেডি ছিল, লেকচার রেকর্ড করা হলো, ক্লাসে অন্য প্রফেসররাও ছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নবাণ, এরপর ক্লাস শেষ। এরপর একটানা কয়েকজনের সাথে তাদের অফিস রুমে গিয়ে দেখা করলাম, যেমন – গবেষণা এবং প্রকাশনা বিষয়ক অফিসার – আমাকে কিভাবে প্রজেক্ট ফান্ডের জন্য এপ্লাই করতে হবে, কিভাবে ওপেন-একসেস পাবলিকেশান ফি আমাকে দিবে, কিভাবে অভ্যন্তরীন ফান্ড পাওয়া যাবে, কিভাবে কনফারেন্স বা ফিল্ডওয়ার্ক ফান্ড পাওয়া যাবে ইত্যাদি নিয়ে দিকনির্দেশনা দিলেন। এরপর স্টেট্ অফিসার; তারপর শিক্ষক ইউনিয়নের কর্মকর্তা – আমাকে আমার অধিকার এবং পেনশন নিয়ে জ্ঞান দিলেন।
দুপুরে আবারো ছাত্রছাত্রীদের সাথে ইনফরমাল লাঞ্চ, একই স্টাইল, সবাই মিলে আমাকে মূল্যায়ন করলো, আমিও গল্প করলাম আর হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করলাম। একটা জবর কাহিনী ঘটল। একজন কলকাতার অনেক সিনিয়র প্রফেসরের সাথে দেখা হল, বয়স ৭৫–৮০ হবে। উনি এই বিভাগে প্রায় ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন, প্রায় ১০ বছর হয়েছে রিটায়ার্ড কিন্তু এখনো প্রতিদিন ক্লাস নিতে আসেন, এতটাই ভালবাসা উনার এই বিভাগের জন্য, এই বিভাগও উনাকে অনেক সম্মান করেন, উনার রুম এখনো বহাল তবিয়তে বরাদ্দ আছে, আর উনাকে নিয়মিত ক্লাসও দেয়া হয়। উনি আমাকে দেখে একেবারে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন, এবং এসে আমার সাথে বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন; উনার সহকর্মীরা খুব অবাক হয়ে বললেন যে – "তোমাকে এই প্রথম ডিপার্টমেন্টে বাংলায় কথা বলতে শুনলাম"! কলকাতার ভদ্রলোক আমাকে উনার রুমে নিয়ে প্রায় ২০ মিনিট প্রাণখুলে অনেক গল্প করলেন, ছাড়তেই চান না, শেষে একজন এসে আমাকে নিয়ে গেলো।
এরপর মিটিং হলো বৈচিত্র্য এবং নিয়োগ বিশেষজ্ঞ অফিসারের সাথে; তারপর বিভাগীয় প্রধান – ভদ্রমহিলা অনেক মজার মানুষ, অনেক নন-একাডেমিক গল্প করলেন; এবং বাকি কিছু বিভাগীয় প্রফেসরের সাথে। এরপর বিকাল চারটায় শুরু হলো আমার পাবলিক প্রেজেন্টেশন। ইহা অনুষদের ডিন থেকে শুরু করে বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের প্রায় সকল প্রফেসর, অন্যান্য বিভাগের কিছু প্রফেসর, স্টুডেন্টস এবং আগ্রহী সকলের জন্য উন্মুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ লেকচার। আমি প্রায় ৫০ মিনিট একটানা বক্তৃতা দিলাম, বিষয়বস্তু ছিল – আমার পড়ালেখা, পাবলিকেশন, আমার গবেষণার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা, আমার চাকুরী এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে আমার কাজের প্রভাব, আমি উনাদের কি কি কোর্স পড়াতে পারবো, কি কি নতুন কোর্স অফার করতে পারবো, আমাকে নিয়োগ দিলে কিভাবে এই ডিপার্টমেন্ট উপকৃত হবে, স্টুডেন্টদের নিয়ে পরিকল্পনা, এবং সর্বোপরি কেন আমাকে ওরা নিয়োগ দিবে তার কারণ দর্শানো ইত্যাদি। এরপর প্রায় ১৫ মিনিট প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শেষে আমার প্রেজেন্টেশনের সমাপ্তি ঘটল। এই দুইদিন যে কি ধরণের মানসিক ধকলের মধ্যে দিয়ে গেছি তা আর বলে শেষ করা যাবে না!
বিকালে একজন প্রফেসর আমাকে হোটেলে ড্রপ করলেন, এরপর আমি ফর্মাল ড্রেস চেঞ্জ করে জিন্স আর প্যান্ট পরিধান করে বাইরে ঘুরতে বের হলাম, যেন দম ছেড়ে বাঁচলাম। উনি আমাকে সমুদ্র পাড়ে হাঁটতে নিয়ে গেলেন, অনেক গল্প করলেন, বললেন যে এই শহরে একটি মসজিদ আছে, ছোট একটি মুসলিম কম্যুনিটি আছে ইত্যাদি। শুনে খুব অবাক হলাম, সাদাদের সাথে আমি সচরাচর রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে কথা বলি না; এরপর উনি আমাকে বললেন যে – "আমার ভোট তোমার পক্ষেই যাবে"! আরো অবাক হলাম, খুশিও হলাম – যাক কমপক্ষে একটা ভোট আমি পাচ্ছি। বলে রাখি, এই দুই দিনে আমার সকল কর্মকান্ড মূল্যায়ন করা হবে এবং আমার প্রেজেন্টেশনের সকল ভিডিও ওদের সিস্টেমে আপলোড করা থাকবে, এরপর বাকি দুইজন প্রার্থী (তারা কারা কখনোই জানতে পারি নাই) এবং আমার সকল কিছু একসাথে বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শিক্ষক এবং নির্বাচক একটি করে ভোট দিবেন তার পছন্দের প্রার্থীকে, যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে তাঁকেই শেষ পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হবে। খুবই কঠিন এক নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রায় গোটা ২৫ জন ভোট দিবেন, এর মাঝে একটি নিশ্চিত ভোট পেলাম, বাকিটা আল্লাহ ভরসা!
রাতে বিদায়ী ডিনারের আয়োজন করা হল, প্রায় দশজন প্রফেসর এবং দুইজন স্টুডেন্ট ছিলেন; সবাই মিলে একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম। অনেক গল্প আর আড্ডা হলো, এরপর রাত প্রায় ৯ টায় হোটেলে ফিরে আসলাম। সকল ফর্মালিটি শেষ হল। রাতে পরিচিতদের সাথে ফোনে আড্ডা দিলাম, এবং দুইরাত পর আজকে একটু ঘুমাতে পারলাম। সকালে হোটেলেই নাস্তা করলাম, ব্যাগ গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে চেক-আউট করলাম। এরপর সিলেকশান কমিটির চেয়ারম্যান আমাকে নিয়ে উনার গাড়িতে করে পুরা শহর এবং এর আশপাশ ঘুরালেন। কোথায় কোন বাড়ির দাম কত এইসব তথ্য দিলেন; আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, একি বলে – বাড়ি আমি কিভাবে আর কবে কিনবো? উনি বললেন স্থায়ীভাবে থাকতে গেলে এইগুলা জানতে হবে। এরপর আমাকে ইউনিভার্সিটির কাছে হাঁটা দূরত্বে কোন ফ্ল্যাট বা বাসায় থাকলে ভাল এবং ভাড়া কেমন হবে এইসব নিয়ে ধারণা দিলেন। এই শহরে কি কি সুবিধা আছে বললেন – পাহাড়ে হাইকিং; সমুদ্রে বোটিং, ক্যানিয়োনিং, রাফটিং, মাছ ধরা, দর্শনীয় স্থান, আমেরিকার বিশেষত্ব থেকে শুরু করে কিভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় ইত্যাদি নিয়ে গল্প করলেন। মজা করে বললেন, তুমি যদি চাকরিটা পেয়ে যাও তবে তোমাকে আমি নিজে কায়াকিং শিখাবো। আমাকে সমুদ্রের অপর পাড়ে নিয়ে গেলেন, এখানেই উনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সবশেষে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং আমার সবচেয়ে কৌতুহলের জায়গায় নিয়ে গেলেন, আর তা হল – রেডইন্ডিয়ান আদিবাসীদের জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকায়। এখানে অন্তত চারটি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে – Lummi, Nooksack, Samish, and Semiahmoo; প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ওদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন এবং আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের উপর সাদাদের অত্যাচারের গল্প তুলে ধরলেন। আসলে এই সমগ্র এলাকাটিই একসময় আদিবাসীদের অধীনে ছিল, পরে সাদারা তা জোরপূর্বক যুদ্ধ এবং অত্যাচারের মাধ্যমে দখল করে, ইহা সমগ্র আমেরিকার জন্যই প্রযোজ্য। সারাজীবন রেডইন্ডিয়ানদের কাহিনী আমি গল্পে পড়েছি (একটি বই আমার খুবই প্রিয় – Bury My Heart at Wounded Knee) কিংবা মুভিতে দেখেছি; কিন্তু আজ স্বচক্ষে তাঁদের সংরক্ষিত এলাকা ঘুরে দেখলাম; আমি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম, মনে হলো চাকরি হোক বা না হোক আমার এই ভ্রমণ আজ সার্থক! এরপর উনি আমাকে বাসস্টপে নিয়ে গিয়ে বিদায় দিলেন, গন্তব্য এবার সিয়াটল; ওখান থেকে সরাসরি লন্ডনের ফ্লাইট ধরলাম পরের দিন; শেষ হল আমার আমেরিকান ফ্যাকাল্টি ইন্টারভিউ!
লন্ডনে ফিরে আসার প্রায় এক মাস পর সিলেকশান কমিটির চেয়ারম্যান হঠাৎ একদিন আমার মোবাইলে কল দিলেন, উনি খুবই প্রফুল্ল কণ্ঠে আমাকে সুখবরটি দিলেন, বললেন – "কমিটি এবং ফ্যাকাল্টি তোমাকেই প্রথম হিসাবে মনোনীত করেছে"! সত্য কথা বলতে কি, জীবনে বহু বছর ধরে এমন একটি সুসংবাদ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি; আমরা যারা পিএইচডি আর পোস্টডক করি তাদের কাছে পার্মানেন্ট একটি একাডেমিক জব যেন সোনার হরিণ। আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমি আমেরিকাতে চাকরি পেয়ে গেলাম, যেখানে কোনোদিনও মার্কিন মুল্লুকে পা রাখবো তা চিন্তাও করি নাই, কখনো টোফেল বা জিআরই দেই নাই, ইউএস কোনো ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি-এর জন্য এপ্লাইও করি নাই, আর আজ ঐ দেশেই আমার সহকারী-অধ্যাপকের চাকরি হয়ে গেল? এক অলৌকিক ঘটনা!
এরপর আমাকে ড্রাফট কন্ট্রাক্ট পাঠানো হল, কতিপয় প্রফেসর এবং ডিনের সাথে কয়েকবার স্কাইপি মিটিং করে কন্ট্রাক্ট ফাইনাল করলাম, কন্ট্রাক্টে কবে থেকে চাকরি শুরু হবে, আমার বেতন কতো হবে (আমেরিকাতে ৯ মাসের বেতন দেয়া হয়, ৩ মাস গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকে, এ সময়ে আপনি সামার কোর্স কিংবা গবেষণা করতে পারেন; অথবা পূর্ণাঙ্গ ছুটিও কাটাতে পারেন), আমাকে বছরে কয়টা কোর্স নিতে হবে, আমার গ্রীষ্মকালীন গবেষণা ভাতা কি হবে, আমার স্থানান্তর খরচ, স্টার্টআপ গবেষণা ফান্ড কতো হবে, আমাকে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, বই, এবং অন্যান্য সামগ্রী কিনতে কি ফান্ড দেয়া হবে, কিভাবে আমার চাকরি টেনিউরড বা স্থায়ী হবে, আমার স্বাস্থ্য বীমা, এবং আমার টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট কি হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত লিখিত থাকে। এরপর আমি এবং ফ্যাকাল্টি ডিন একমত হলে চুক্তি সম্পাদিত হয়। আমাকে কুরিয়ার করে হার্ডকপি কন্ট্রাক্ট (বিভাগীয় প্রধান, অনুষদের ডিন, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্বাক্ষর করেন) লন্ডনে পাঠানো হয়, এরপর আমি স্বাক্ষর করে তাদেরকে কুরিয়ার করে দেই, এভাবে প্রস্তাবপত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।
এই চুক্তি সম্পাদিত হতে জুন মাস শেষ, এরপর আরেকটি কঠিন ধাপ হলো আমেরিকার ওয়ার্ক-পারমিট পাওয়া। আমাদের ক্ষেত্রে 'J1' বা 'H1B' ক্যাটাগরিতে এপ্লাই করতে হবে। অবশ্যই 'H1B' ক্যাটাগরিতে যাবেন, 'J1' পরিহার করবেন সম্ভব হলে। আমি খুব বিস্তারিত লিখবো না, কেননা ব্লগটি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। 'H1B' ক্যাটাগরিতে আপনার ফুলটাইম কাজের অনুমতি থাকবে, প্রথমে ৩ বছরের ভিসা পাবেন, এরপর আরোও তিন বছর পাবেন, মোট ৬ বছর, এর মাঝে আপনার বিশ্ববিদ্যালয় আপনার জন্য গ্রিনকার্ডের আবেদন করবে যা আপনি এক থেকে দেড় বছরের মাঝে পেয়ে যাবেন, গ্রিনকার্ড পাওয়ার ৫ বছর পর আমেরিকান নাগরিকত্বের জন্য এপ্লাই করতে পারবেন, এভাবে আপনি মার্কিন মুল্লুকে স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে পারবেন। এছাড়াও আপনি আগেভাগেই National Interest Waiver (NIW) ক্যাটাগরিতে গ্রিনকার্ডের জন্য এপ্লাই করতে পারেন। মনে রাখবেন, 'H1B' ক্যাটাগরিতে আপনার স্ত্রী/ওয়াইফের কাজের অনুমতি নাই, উনি শুধু পড়ালেখা করতে পারবেন, কোন ধরণের স্টাইপেন্ড বা শিক্ষা সহকারীতা বিষয়ক ভাতা/বেতন নিতে পারবেন না। আপনার ওয়াইফ চাইলে 'F1' বা স্টুডেন্ট ভিসাতে চলে যেতে পারেন কোন ডিগ্রি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে, তাহলে ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারবেন। পরবর্তীতে আপনি যদি গ্রিনকার্ড পেয়ে যান তবে দুইজনেই কাজের অনুমতি পাবেন। 'H1B' পাওয়ার পর গ্রিনকার্ড পাওয়াই হবে আপনার অন্যতম লক্ষ্য।
বর্তমানের অভিবাসন-বিরোধী মার্কিন রাজনীতির ডামাডোলে 'H1B' ভিসা পাওয়া খুবই দুস্কর, একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হলো সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম। আমি শেষ পর্যন্ত এই ভিসা পাবো কিনা তা নিয়ে আমার চেয়ে ডিন এবং সিলেকশান কমিটির চেয়ারম্যান আরও বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অভিবাসন আইনজীবী আছেন (এটর্নি জেনারেল বলা হয়); আমাকে একটি লম্বা ফর্ম পূরণ করতে হলো, সকল কাগজপত্র জমা দিতে হল (পাসপোর্ট, বিবাহ সনদ, সকল ডিগ্রীর সনদ, আমার সিভি ইত্যাদি, আর বাকি সব আপনার কাছে আছে)। এরপর এটর্নি জেনারেল আবেদন করলেন, উনাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে সমগ্র আমেরিকাতে আমার চেয়ে ভালমানের কিংবা সমতুল্য প্রার্থী ওরা খুঁজে পাই নাই, তাই আমাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং বিদেশ থেকে একজনকে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে আনা হবে। প্রমাণ হিসাবে এটর্নি জেনারেল সিলেকশান কমিটির মূল্যায়ন এবং সকল ক্যান্ডিডেটের সকল প্রমাণাদি দাখিল করেন। আমার একাডেমিক ক্যারিয়ার অসাধারণ কিনা এই বিবেচনায় ভিসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবেন দ্য US Citizenship & Immigration Services (USCIS) – উনারা চাইলে আমার ভিসা প্রত্যাখ্যানও করে দিতে পারে, অনেক নজির আছে। সবকিছু জমা দেয়ার পর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সুখবরটি আসে যে আমার 'I-129' পিটিশন প্রথম তিন বছরের জন্য অনুমোদিত হয়েছে, এরপর লন্ডনে আমেরিকার হাইকমিশনে ভিসার জন্য এপ্লাই করি, এর এক সপ্তাহ পর (ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ) আমার বাংলাদেশী পাসপোর্ট 'H1B' ভিসা দ্বারা সীলযুক্ত হলো, আলহামদুলিল্লাহ! আমার ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় UCL-এ চাকরি ছাড়ার জন্য তিন মাসের আগাম নোটিশ দিতে হয় (এটা ওদেরকে আগেই বলা ছিল), তাই আমেরিকায় চাকরিতে আমার যোগদানের তারিখ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে!
এ এক দীর্ঘ এবং কঠিন পথপরিক্রমা, অনেক হিসাব করে প্রতিটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে, একটি ধাপে হোঁচট খেলে একদম খাদে পতিত হবেন। আর মনে রাখবেন, ইতিহাস এবং মানুষ শুধুমাত্র আপনার সফলতার গল্পটিই শুনতে চায়; তাই সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলতে হবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে খাপ খাইয়ে চলতে। নিজের এই অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের জন্য সামান্য কিছু পরামর্শ থাকবে, এগুলাকে কৌশল হিসাবেও মনে রাখতে পারেন:
[১] প্রথম কথা হল, আপনার সামগ্রিক একাডেমিক প্রোফাইল হতে হবে অতি-প্রাসঙ্গিক এবং অতি-উত্কৃষ্ট (exceptionally outstanding)। প্রায় ২০০ জনের মধ্যে আপনার CV ওদের চোখে পড়তে হবে, যা হতে হবে ওদের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী শতভাগ মানানসই।
[২] আপনার একাডেমিক CV, কাভার লেটার; শিক্ষকতা, গবেষণা, এবং বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি বিবৃতিসমূহ খুবই উন্নত মানের হতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড A4 পেইজে Arial ফন্ট ১২, সিঙ্গেল স্পেসিং এবং পেইজ নম্বর দিবেন, সিভি ৪-৬ পৃষ্ঠা হতে পারে, বাকিসব ১-২ পৃষ্ঠা সর্বোচ্চ। গ্রামার এবং সঠিক ইংরেজি নিশ্চিত করুন, দরকার হলে আপনার পিএইচডি প্রফেসর কিংবা এলুমনি যারা আমেরিকায় শিক্ষকতা করছেন তাঁদের সহায়তা নিন, গুগল করলেও অনেক তথ্য ও নমুনা পাবেন। দয়া করে লেখা কপি-পেস্ট করবেন না এবং কোন অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিবেন না, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সহজ এবং সাবলীল ভাষায় লিখুন।
[৩] আপনার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সিজিপিএ নিয়ে কেউ একদমই চিন্তিত নয় (রেজাল্ট ভাল হলে ভাল), ডিগ্রী গুলা শুধু প্রাসঙ্গিক হতে হবে। কিন্তু আপনার পিএইচডি থিসিসের টপিক এবং সমসাময়িক একাডেমিক কর্মকান্ড অনেক জরুরি। যেমন: পোস্টডকে বা কোন রিসার্চ প্রজেক্টে কি নিয়ে কাজ করছেন ইত্যাদি। আপনার কোনো একাডেমিক কর্মকান্ডের জন্য স্কলারশিপ, গবেষণা অনুদান, বা এওয়ার্ড পেয়ে থাকলে উল্লেখ করুন।
[৪] আপনাকে উন্নতমানের জার্নাল আর্টিকেল পাবলিশ করতে হবে। ইন্টারভিউয়ের দিন আমার ১৬ টি [SCI (Science Citation Index) + SCIE (Science Citation Index Expanded)] জার্নাল প্রকাশিত ছিল এবং সাইটেশন ছিল ৪০০+ (ইহা ব্যক্তি ও ডিসিপ্লিন-ভিত্তিক কম বা বেশি হতে পারে)। Google Scholar, ResearchGate, Scopus, এবং ORCID-এ অবশ্যই অনলাইন পাবলিক প্রোফাইল রাখবেন, চাইলে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটও খুলতে পারেন, নিজের কাজের প্রচারণার আলবৎ দরকার আছে। এর বাইরে আরও একাডেমিক প্রকাশনা থাকতে পারে, যেমন: বই, বুক-চ্যাপ্টার, কনফারেন্স পেপার, টেকনিক্যাল রিপোর্ট ইত্যাদি।
[৫] একাধিক কনফারেন্স পেপার উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করুন, পৃথিবীর এবং আপনার ডিসিপ্লিন-স্পেসিফিক শ্রেষ্ঠগুণসম্পন্ন কনফারেন্সে যেতে হবে। কিছু গবেষণামূলক প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর প্রতিযোগিতামূলক প্রজেক্ট ফান্ডিং অর্জন করার অভিজ্ঞতা থাকলে ভাল। জার্নাল আর্টিকেল রিভিউয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে উল্লেখ করুন।
[৬] শিক্ষকতার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকা জরুরী। আপনি যেখানে পিএইচডি করছেন, সেখানে টিচিং এসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতে পারলে সবচেয়ে উত্তম। পোস্টডক থাকা অবস্থায় কয়েকটি কোর্স নেয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়াও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেও তা গৃহীত হবে। যেখানেই শিক্ষকতা করেন না কেন, স্টুডেন্টস এভালুয়েশন/মূল্যায়ন ফর্ম সংগ্রহে রেখে দিবেন, এইগুলা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব মূল্যায়ন করে। কোনো অনলাইন বা প্রফেশনাল কোর্স করিয়ে থাকলেও উল্লেখ করতে পারেন, সার্টিফিকেট সংগ্রহে রাখুন।
[৭] আপনাকে কমপক্ষে ৪-৫ জন নামিদামি প্রফেসরের সাথে অলটাইম সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, উনারা ভবিষ্যতে আপনাকে সুপারিশপত্র (recommendation letter) দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন। মনে রাখবেন, স্নাতক থেকে মাস্টার্সে ভর্তির জন্য যেমন আপনার আন্ডারগ্রাডুয়েট শিক্ষকদের সুপারিশ লাগবে, তেমনি মাস্টার্স থেকে পিএইচডিতে, পিএইচডি থেকে পোস্টডক, পোস্টডক থেকে প্রভাষক, আর প্রভাষক থেকে অধ্যাপক কিংবা চাকরি পরিবর্তন করলে, সকল ক্ষেত্রেই আপনার আগের কর্মক্ষেত্রের প্রফেসরদের সুপারিশ লাগবে। ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, তাই সবার সাথেই সব সময় অতি-সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করবেন। আমার ক্ষেত্রে তিনটি সুপারিশপত্র লেগেছিল, চাকরি পাওয়ার জন্য এইসব পত্রে প্রশংসনীয় লেখা দরকার আছে। নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার প্রফেসররা আপনার প্রশংসা আর সমাদর করবেন এবং আপনাকে এই চাকরি পাওয়ার জন্য কমিটির কাছে বিশেষভাবে সুপারিশ করবেন, অন্যথায় শর্ট-লিস্টেড হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
[৮] অন-ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ একটি কঠিন বাস্তবতা। আপনাকে প্রথমে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে, ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, সর্দি ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকুন। কেননা আপনাকে প্রায় ১০০ জনের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে হবে। আপনার অপরিসীম মানসিক শক্তি থাকতে হবে, স্নায়ুচাপজনিত পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার সাহস এবং শক্তি দুইটিই থাকতে হবে। সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকবেন, খুব ভদ্র, অমায়িক এবং মার্জিতভাবে একাডেমিক কথা বলবেন। যুদ্ধ, রাজনীতি, ধর্ম, মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়, অহেতুক সমালোচনা, অনথিভুক্ত অভিবাসী/অবৈধ অভিবাসন, আমেরিকান দাস প্রথা কিংবা রেডইন্ডিয়ান গণহত্যা ইত্যাদি বিতর্কিত ঝামেলা সমূহ এড়িয়ে চলুন।
[৯] সঠিকভাবে অনর্গল ইংরেজি বলা এবং ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ লেখার অভ্যাস করুন, শ্রবণ ক্ষমতাও ভাল থাকতে হবে, অনেক চর্চা করতে হবে, অনেক! সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করুন এবং গল্প জুড়ে দিন, তাদেরকেও কথা বলার সুযোগ দিন। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনবেন, কারো কথার মাঝে নিজে কথা বলবেন না। কারো সমালোচনা করবেন না, কিছু জিনিস (কালচারাল শক), আচরণ বা কথা ভাল না লাগবে চুপ থাকুন, হজম করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। মনে রাখবেন – "যে চুপ থাকল, সে মুক্তি পেল"!
[১০] আপনার নিত্যকার্যসূচি আগে থেকেই পাঠানো হয়েছে, তাই মিটিংয়ের পূর্বে অনলাইনে সবার প্রোফাইল এবং সিভি আগেভাগেই পড়ে নিবেন। এতে করে কথা বলতে সুবিধা হবে। আর আপনার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিপার্টমেন্ট নিয়েও সবিস্তারে চোখ বুলিয়ে আসবেন। কি কি ডিগ্রী এবং কোর্স অফার করা হয়, কে কি পড়ান, আপনি কোনটা পড়াতে পারবেন, বিভাগের গবেষক এবং স্টুডেন্টদের প্রোফাইল (যদি অনলাইনে থাকে) ইত্যাদি। সময় পেলে ওই স্টেট এবং শহরের ইতিহাস পড়বেন, কি জন্য বিখ্যাত বা কি কি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে জানবেন।
[১১] প্রায় দু-তিনদিন আপনি অনেকের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলবেন, প্রতিটি মুহূর্তই আপনার পরীক্ষার সমতুল্য। অনেক ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সকল প্রশ্নের উত্তর আপনি জানবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই সবজান্তা মনোভাব পোষণ করা একদম ঠিক নয়। কিছু বিষয় না পারলে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, তা সম্ভব না হলে সবিনয়ে বলবেন যে এ বিষয়ে আমার ধারণা নাই। সংযতভাবে মোকাবেলা করুন, বুদ্ধিমত্তার সাথে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করুন।
[১২] সময় নিয়ে কোনো কালক্ষেপন করা যাবে না, প্রতিটি মিটিং এবং অর্পিত কাজ সঠিক সময়ে করুন। প্রতিটি প্রেজেন্টেশন একদম সময়মত শেষ করুন, কোনো অবস্থাতেই বেশি সময় নিবেন না।
[১৩] ফর্মাল পোশাক এবং জুতা পরবেন। ড্রেস কোড জেনে নিন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন, বডি স্প্রে বা পারফিউম ব্যবহার করতে পারেন। সাথে সবসময় ল্যাপটপ, নোটবুক, কলম, এবং ঘড়ি রাখবেন। আমেরিকার কালচার নিয়ে পড়ালেখা করে যাবেন, বা সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনবেন; আপনার প্রফেসর কিংবা যারা আমেরিকাতে আছে তাদের সাথে কথা বলে আমেরিকান রীতিনীতি এবং আচরণবিধি জেনে নিন। খেয়াল রাখতে হবে যেন আপনার কোন কথা কিংবা কর্মকান্ডে কেউ অপমানিত বা বিব্রত না হয়। গাম্ভীর্যতা এবং নিজের উচ্চমান বজায় রাখুন, হাসিমুখে রাশভারী থাকুন।
[১৪] ওরা পর্যবেক্ষণ করে দেখবে যে আপনার কর্মকান্ড এবং ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি আপনাকে ভবিষ্যতে একজন আমেরিকান প্রফেসর হিসাবে গড়ে তুলতে পারবে কিনা; ইহাই মূল লক্ষ্য। ক্লাসে উন্নতমানের লেকচার দেয়া, স্টুডেন্টসদের সন্তুষ্টি, পাবলিকেশন্স, প্রজেক্ট ফান্ডিং ম্যানেজ করা, ডিপার্টমেন্টে আপনার সমন্বয়সাধন, স্টুডেন্টদের সঠিক পরামর্শদান, এবং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতামূলক একাডেমিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার সক্ষমতা – এই বিষয়গুলোকেই সামগ্রিকভাবে অধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। এগুলা বিশেষ বিবেচনায় রাখুন এবং আপনার কথাবার্তা বা কর্মকান্ডে তা প্রকাশ করুন।
সর্বোপরি কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলি। উন্নত দেশের একটি স্থায়ী ফ্যাকাল্টি চাকরি পাওয়া এক মহা-পলিটিক্স! আমি নিজ চোখে এমন দেখেছি যে একটাও জার্নাল আর্টিকেল নাই এবং পিএইচডিও শেষ হয় নাই এমন একজনের নিয়োগ হয়ে গেছে; আবার অন্য একজনের ৩০০০+ সাইটেশন আছে, নেচার জার্নালে আর্টিকেল আছে, এবং ৭ বছর ধরে একই বিভাগে পোস্টডক করছে কিন্তু তার চাকরি হচ্ছে না! হ্যাঁ, ইহাই সত্য ঘটনা আর অবাক হওয়ারও কিছু নাই। ডিপার্টমেন্টে অভ্যন্তরীন অনেক পলিটিক্স থাকে এবং শিক্ষকদের মাঝেও মতের অমিল এবং ঝগড়া থাকে। অনেকের আবার আগে থেকেই পছন্দের প্রার্থী থাকে, কিন্তু জব সার্কুলার তো দিতেই হবে, তাই এইসব ইন্টারভিউ তখন হয়ে যায় শুধু লোক দেখানো একটি প্রহসন। আমার জানা মতে, উন্নত বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগে এমন ঘটনা প্রায় ৫০-৬৫% ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। অনেকে আবার ইমিগ্রেশানের ঝক্কি বহন করতে চায় না, তাই বিদেশী ক্যান্ডিডেটদের প্রতি আগ্রহ কম থাকে। সব মিলিয়ে প্রতিযোগিতার মাত্রা আরো বহুগুণে কঠিন এখন। অনেক সময় আপনার অনেক অনেক মন খারাপ হবে, মনে হবে যে এই পৃথিবীতে ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ বলে কিছু নাই, সবই তদবির আর চাটুকারিতা। কিন্তু দয়া করে ভেঙে পরবেন না, চেষ্টা চালিয়ে যান এবং ধৈর্য ধরুন। অনেক সময় কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও লাগে। এজন্য নিজেকে সকল দিক থেকেই মানানসই রাখতে হবে। সর্বোপরি, আপনার থাকতে হবে খুবই উন্নতমানের একাডেমিক প্রোফাইল আর সেই সাথে বজায় রাখতে হবে মানসিক এবং শারীরিক ভারসাম্য। স্বাগতম, এই মহাযুদ্ধের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন, আপনার জন্য রইলো প্রাণঢালা শুভেচ্ছা!
_______________________________
লেখক – বায়েস আহমেদ, PhD
ব্রুমফিল্ড স্ট্রিট, লন্ডন, ইংল্যান্ড।