কয়েক মাস আগে গেলাম ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। উদ্দেশ্য- প্রভাতী শাখার আমার প্রিয় দুই শিক্ষক, গণিতের মঞ্জু স্যার এবং পরিসংখ্যানের ফিরোজ খান স্যারের সাথে দেখা করতে!
প্রথমে মঞ্জু স্যারের বাসায় গিয়ে চরমভাবে অবাক হয়ে গেলাম। স্যারের দেখি আমূল পরিবর্তন। মুখ ভর্তি লম্বা দাঁড়ি এবং সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই কি সেই মঞ্জু স্যার?? আমার তো বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না।
কথা প্রসঙ্গে স্যার বললেন যে উনি ২০১১ সাল থেকে প্রাইভেট পড়ানো ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বললাম, "কেন স্যার?" জবাবে উনি বললেন, "প্রাইভেট পড়ালে আমি কুরআন শরীফ পড়ার সময় পাই না!"
_______________________
এইবার ফিরে আসি, পূর্বের প্রসঙ্গে। কেন আমি স্যারকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হলাম?
মঞ্জু স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৯ সালে। ঐ সময় স্যার একটা কথা বলেছিলেন, "আমার কাছে যে টানা দুই বছর গণিত পড়ে, সে ‘এইচএসসি’তে দুই পেপারেই ৯০+ পেয়ে থাকে; গ্যারান্টি!"
স্যারের এই কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম এবং টানা দুই বছর উনার বাসায় গণিত পড়েছিলাম। আর উনার ঐ কথার চেয়েও ভাল ফলাফল পেয়েছিলাম!
স্যারকে আমার খুব ভাল লাগত, অসাধারণ পড়াতেন। সমগ্র ঢাকায় উনার সুনাম। ঢাকার বিভিন্ন নামি-দামি কলেজের ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর জন্য উনার আলাদা আলাদা ব্যাচ ছিল। কলেজ ছুটি হওয়ার পর থেকে রাত পর্যন্ত উনি প্রাইভেট পড়াতেন।
সবই ঠিক ছিল, কিন্তু আমি উনার একটা জিনিস খুবই অপছন্দ করতাম। আর তা হল, উনি মডেল কলেজের ক্লাসে কোন নোট দিতেন না। এমনকি ক্লাসে অংকটা খুবই ছোট করে করাতেন আর কোন সাইড নোটও দিতেন না। এর ফলে ক্লাসে অংকটার কিছুই বুঝা যেত না। ঐ একই অংক উনি প্রাইভেটে প্রায় ২ পৃষ্ঠা ধরে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে করাতেন।
অর্থাৎ একই অংক ক্লাসে কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু উনার প্রাইভেট কোচিং-এ খুব ভালভাবেই বুঝতাম। আর প্রাইভেটে উনি গণিতের খুব সুন্দর সুন্দর নোটও দিতেন। এর ফলাফল ছিল, প্রায় সকলেই তার কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হত। শুধু গুটিকতক ছেলে, যাদের সামর্থ্য ছিল না তাঁরা পড়তে পারত না।
এমতাবস্থায় স্যারকে আমি একজন ভাল গণিতের শিক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু উনার সততা ছিল আমার কাছে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ!!
_________________________
এইবার ফিরে আসি, আমার সবচেয়ে প্রিয় পরিসংখ্যানের ফিরোজ খান স্যারের প্রসঙ্গে। ফিরোজ খান স্যারকে নিয়ে আসলে লিখে শেষ করা যাবে না। উনার মত সৎ এবং ভাল মানুষ আমি মনে হয় আর দেখি নাই।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি- তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যখন শিক্ষকেরা ব্যাচে ছাত্র পাওয়ার জন্য ক্লাসে ঠিকম পড়াতেন না, বা ক্লাসে প্রাইভেট পড়ার জন্য হুমকি-ধামকি দিতেন বা ব্যবহারিক পরীক্ষায় কম নম্বর দিতেন; সেই আমলে ফিরোজ খান স্যার ছিলেন সবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা!
ফিরোজ খান স্যার ক্লাসে শুধু উনার সকল নোটই দিতেন না, বরং প্রত্যেকটি অংক ভেঙ্গে ভেঙ্গে করিয়ে দিতেন। আমাদের সময়ে উনি ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিসংখ্যানের শিক্ষক ছিলেন। উনার একটা নীতি ছিল, উনি আমাদের কলেজের প্রভাতী শাখার কোন ছাত্রকে বাসায় প্রাইভেট পড়াতেন না। এমনকি ‘এইচএসসি’ পরীক্ষার আগে, বিনামূল্যে আমাদেরকে মডেল টেস্ট দেয়ার ব্যবস্থাও করিয়েছিলেন।
স্যার ক্লাসে সকল নোট ফটোকপি করে নিয়ে আসতেন এবং আমাদের প্রত্যেককে একটি করে কপি দিতেন। কোনদিন ঐ ফটোকপির টাকাও চাননি। আমরা সবাই মিলে ফটোকপির টাকা দিতে গেলে উনি নিতেও চাইতেন না। এমন শিক্ষক আমি জীবনেও দেখি নাই। আশ্চর্য হয়ে যেতাম!
স্যার পরিসংখ্যানের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর এবং অংক ব্ল্যাক বোর্ডে বিস্তারিতভাবে করিয়ে দিতেন। উনি ৩টি ভিন্ন রঙের চক-পেন্সিল ব্যবহার করতেন। আর আমরাও খাতায় তিনটি ভিন্ন রঙের কলম ব্যবহার করে সব নোট তুলতাম। আমার খাতাটাই যেন ছিল আমার মূল পাঠ্য-বই। আজ পর্যন্ত জীবনে আমি কোন বিষয়েরই নোট এভাবে তুলি নাই।
স্যার ক্লাসে সবসময় মাথায় টুপি এবং সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিধান করে আসতেন। সত্যি বলছি স্যারকে দেখলে আমার মনে হত, এ যেন এক সাক্ষাৎ ফেরেশতা। স্যার একজন জ্ঞানী শিক্ষকই ছিলেন না, উনি যেন ছিলেন সততার মানদণ্ড। স্যারের এরমক অনেক গুণাবলি আছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না।
স্যারের কাছে থেকে শুধু পরিসংখ্যানই শিখি নাই, উনার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে একজন ভাল মানুষ হওয়া যায়। যদিও উনার ধারেকাছেও আমি যেতে পারি নাই, তবুও কেউ যদি আমাকে বলে- সততার সংজ্ঞা দাও, আমি শুধু বলব ফিরোজ খান স্যারের নাম।
______________________________________
“পরিসংখ্যান” এবং “সততা” - স্যারের দেয়া এই দুইটি অমূল্য শিক্ষা আমি আজও বহন করে চলেছি। আমার স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং ‘পিএইচডি’- সকল পর্যায়েই পরিসংখ্যানের বিস্তর প্রয়োগ ছিল/রয়েছে। যখনই পরিসংখ্যানের কোন কাজ করি, স্যারকে খুব মনে পড়ে। আর জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই যেন সততার পরীক্ষা! জানি না, কতটুকু সফল হয়েছি/হব; তবুও আমৃত্যু আমি স্যারের মত একজন সৎ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব। উনার মত ১০% সৎ হতে পারলেও, আমার জীবন ধন্য! যেখানেই থাকেন আর যেভাবেই থাকেন স্যার, ভাল থাকবেন!!
_____________________________
পরিশেষে ফিরে আসি মঞ্জু স্যারের প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলেছি, মঞ্জু স্যার আমার অনেক প্রিয় একজন শিক্ষক। অতীতে উনি কিছুটা অসৎ-পন্থা অবলম্বন করলেও, আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আজকে স্যার ন্যায়ের পথে ফিরে এসেছেন। এইটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
মুখ ভর্তি দাঁড়ি, পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, প্রাইভেট পড়ানো বাদ দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করা – এই অবস্থায় স্যারকে দেখে মনে হল; এ যেন আমি ফিরোজ খান স্যারের প্রতিবিম্ব দেখছি। অসাধারণ! স্যারের প্রতি যে সামান্য ক্ষোভ ছিল, স্যারকে ঐদিন দেখার পর সেটাও আর নেই।
আজ আমি নিজেও নিজের প্রতি অনেক খুশি। আগে বার বার ভাবতাম, কেন আমি মঞ্জু স্যারকে এতো পছন্দ করি? কোথায় মঞ্জু স্যার আর কোথায় ফিরোজ খান স্যার! কিন্তু মঞ্জু স্যারকে নতুন রুপে দেখে ঐদিনই এই প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেলাম – শুধুমাত্র মানুষের ভালবাসায় মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে!!
কথিত আছে যে, হযরত উমর (রাঃ) ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে মুক্ত তরবারী হাতে ঘর থেকে বের হন; কিন্তু পরবর্তীতে উনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের চার খলিফার এক খলিফা নিযুক্ত হন (আলহামদুলিল্লাহ্)! তাই আসুন, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে মানুষকে ভালবাসতে শিখি!!
© বায়েস আহমেদ
লন্ডন, ইংল্যান্ড
রবিবার, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২০
রাত ১ টা ৫২ মিনিট।