রাস্তার পাশে রাস্তার সাথে প্রায় একই সমতলে একটা ছোট মাঠ তারপরই ছিল বাড়িটা । শনের বেড়া আর টিনের চালের ঘর ।রাতের বেলা স্বামী বাড়িতে ছিল না, বউটা কোলের শিশু আর বালক সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল পরম নিশিন্তে । শেষ রাতের দিকে আগাম ঘোষনা বা গলা খাঁকরি না দিয়ে নিতান্তই বেহায়ার মত ট্রাকটা সোজা সেঁধিয়ে গেল ঘরের মধ্যে ।ড্রাইভার মদ খেয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি ট্রাকেরই ব্রেকফেল হয়েছিল এ কথা নিশ্চিত করে জানার জন্য পলায়নরত ড্রাইভারকে ধাওয়া করে জিজ্ঞাসাবাদ করার মত কাউকে পাওয়া গেল না সে মুহূর্তে । আগেই বলেছি কর্তা বাড়ি ছিল না ।
পরদিন সকালে সকালে যখন আমি ঘটনাস্থলে আরো অনেকের সাথে চ্চু-চ্চু শব্দ তুলে ঘন ঘন মাথা নেড়ে একটা শোকাবহ আবহ তৈরী করছিলাম এবং প্রায় নিশ্চিত ছিলাম আমার চ্চু-চ্চু শব্দটাই আর সকলের সকলের চেয়ে ভাল হচ্ছে কেননা আমি একজন কন্ঠশিল্পী এবং আমার একটি ব্যান্ডদলও আছে-তখন আমার বন্ধুটি যার নাম কিনা ‘ক’ এবং যে কিনা কোন একবার গণিত অলিম্পিয়াডে দ্বিতীয় হয়ে একটা মেডেল পেয়েছিল এবং পরিচিত, অল্প-পরিচিত সবাইকে সেটা জানানো সে অবশ্য কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছে সে হটাৎ ট্রাকের গায়ে ‘সমগ্র বাংলাদেশ ; সাত টন’ লেখাটার দিকে তর্জনী তুলে দেখিয়ে বাতাসে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষন আঁকিবুকি করে মাথাটা বেসামালভাবে নড়িয়ে বলল- উঁহু কোনভাবেই পসিবল না, সাত টন সমান সাতহাজার কেজি তাইলে তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দিলে একেকজনের ভাগে পড়ে দুই হাজার তিনশত তেত্রিশ দশমিক তিন টন, দশমিকের পরের তিনের উপর পৌনঃপুনিক বসবে।
একদম ঠিক, একদম পসিবল না না শোয়েজনেগার কিংভা ভিন ডিজলও পারত না এত ওয়েট নিতে। তিনজনই সাথে সাথে একদম ভচকায় গেছে ‘ক’ এর পিঠ চাপড়িয়ে দিয়ে সহমত প্রকাশ করল আমার খেলোয়াড় বন্ধু ‘খ’ ।
বিপত্তিটা তখনই হল । কি দরকার ছিল শালা ‘ক’ এর অঙ্ক করতে যাওয়ার আর ‘খ’ এর ‘ভচকায় গেছে’ টাইপ কাতুকুতু উদ্রেককারী শব্দচয়ন করবার? তাতে যে এতক্ষনের বেশ আয়ত্ত করে আনা চ্চু-চ্চু নিমেষের তরে ফিক শব্দাংশে বদলে গিয়ে সামনের কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে গেল ! এবং সেটা যে অবশ্যই হাসি ছিল না তা প্রমানের জন্য চ্চু-চ্চু শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর করার আগেই আমাদের পাড়ার বুদ্ধিজীবী ‘গ’ ভাই যিনি থিয়েটার করেন, সভা করেন, সমাজ সেবা করেন, থুথু ছিটিয়ে গমগমে স্ব্ররে নজরুল আবৃত্তি করেন, যার দেখনসই বাবড়ি চুল এবং মীনা-রাজুর স্কুলব্যাগের মত দেখতে একটা পাটের তৈরী নকশাদার ব্যাগ আছে এবং বুদ্ধিজীবিদের শুধু একটি নামেই চলে না এই সিদ্ধ নিয়মে আমরা তার অনুপুস্থিতে তার নাম একটা হ্রস্য-উ কার(ু) যোগে উচ্চারণ করি তিনি ধাঁই করে সামনে এসে মুখ বেঁকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে প্রমিত উচ্চারণে গর্জন করল- দাঁত কেলিয়ে হাসছিস যে বড়, ফূর্তি চলছে নাকি এখানে! ব্যাপারটা এমন আতর্কিতে ঘটল যে আমি ‘গ’ ভাইয়ের থুথুর হাত থেকে নিস্তার পেলাম না এবং চ্চু-চ্চু শব্দের অন্যান্য স্রষ্টাদের মনযোগ বিচ্যুত হলে তাদের কুঁচকানো ভুরু সমেত কটাক্ষ আর ‘গ’ ভাইয়ের থুথু থেকে বাঁচতে কেটে পড়লাম ঘটনাস্থল থেকে ।যদিও পুলিশ তখনও আসে নি অর্থাৎ লোভনীয় পর্বটাই মিস করতে হবে। অজান্তেই মুখ দিয়ে যে চ্চু-চ্চু শব্দাংশ বেরিয়ে এল সেটা দীর্ঘক্ষনের অভ্যস্ততায় নাকি ঘটনাস্থলের শেষদৃশ্যে অনুপুস্থিত থাকার বেদনায় তা ঠিক বোঝা গেল না ।অতি ধুরন্ধর আমার গণিতবিদ ‘ক’ বন্ধুটি সাপের মত এঁকেবেঁকে ‘গ’ ভাইয়ের দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকে ঘটস্থলের পরিধির মধ্যেই থেকে গেল । শেষ দৃশ্য মিস করার মত চীজ সে না ।
যাই হোক বিকেলবেলা ক্লাবঘরে শেষ দৃষ্যের রোমহর্ষক বর্ণনা ‘গ’ ভাই আমাদের শোনালেন, হ্যাঁ হ্যাঁ রোমহর্ষকই সেটা। থকথকে রক্ত মাংসপিন্ড থেকে আলাদা করে- যদিও তখন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না কোন মাংসপিন্ডটার মালিকানা কার- চাটাই দিয়ে লাশ বাধতে গিয়ে দেখা গেল ভচকানো কোলের শিশুটা চাটাই গলে নিচে পড়ে যাচ্ছে অতএব ভচকানো কোলের শিশু ভচকানো মায়ের কোলে ফেলে একসাথে করে দিয়ে টাইট করে বাঁধা হল । ইদানীং ‘গ’ ভাইয়ের কাছ থেকে কবিতা বিষয়ক জ্ঞান নিতে শুরু করেছি কারণ তাতে মেয়েদের পটানো খানিকটা সহজ হয় এবং যুৎমতো কিছু কবিতার শব্দগুলো এদিক ওদিক করে নিয়ে সেটাকে বেশ গান বানিয়ে নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গাওয়া যায় গীটার সহযোগে ।আমার মধ্যকার সদ্য স্ফুটিত কাব্যপ্রতিভা শিশু ও মায়ের শেষ দৃশ্যের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া কে কল্পনা করে স্ব্তস্ফুর্তভাবে কবিতার কেবলমাত্র প্রথম লাইনটা তৈরী করছে আর তখনই আমার গণিতবিদ বন্ধু ‘ক’ বেরসিকের মত বলে উঠল ভাই বালক ছেলেটার চাটাইয়ে মাংস বেশি চলে গিয়েছিল আপনি খেয়াল করেছেন? আঙুলের গাঁটে হিসাব করে সে বলল-অন্তত সাত থেকে আট পাউণ্ড মাংস বেশি পড়েছে ছেলেটার চাটাইয়ে, অবশ্য পুলিশেরাই বা ক্যমনে জানবে বালক ছেলেটা হৃষ্ট-পুষ্ট না রোগা ছিল? আর আমার খেলোয়ার বন্ধু ‘খ’ অখন্ড মনযোগে বিস্ফোরিত চোখ আর তিরতির করে কাঁপতে থাকা নাকের পাটা নিয়ে এমনভাবে তাকিয়ে সব শুনছিল যেন ‘ফাইনাল ডেস্টিনেশন’ কিংবা ‘স’ টাইপ কোন মুভি দেখছে সে। লেহ্য কোন বস্তু চুষে চলেছে এমনভাবে মুখ নাড়িয়ে, চোখ আরো বড় করে সে জানতে চায় লাশগুলোকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে এখন কাটাকাটি করবে তাইনা? তার অজ্ঞতাই আমরা সবাই বিরক্ত হই এবং প্রকাশ করি- লাশকে লাশকাটা ঘরে না নিয়ে তাজমহলে নিবে নাকি ‘খ’-তে খাচ্চর কোথাকার !
যাই হোক লাশকাটা ঘরের কথায় আমার একটা কবিতা মনে পড়ে ।‘গ’ ভাইকে বলি রবীন্দ্রনাথের লাশকাটা ঘর নিয়ে একটা সুন্দর কবিতা আছে-বলেই বেশ আবেগ টাবেগ দিয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করেছি-শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে………।
থাম থাম ওটা রবীন্দ্রনাথ নয় রে গাধা জীবনানন্দের কবিতা , তুই কবি কবিতা দুটোকেই অপমান করছিস, কিচ্ছু হবে না তোকে দিয়ে ‘গ’ ভাই ধমকে থামিয়ে দেয় । শিষ্যত্ব বুঝি চলে যায় এই ভয়ে ‘গ’ ভাইকে তৈলাক্ত করবার প্রচেষ্টায় ও থুথু ছিটিয়ে জ্ঞানদানের সুযোগ করে দিয়ে আমি তেলেতেলে কন্ঠে তোষামদ করে বলি-তা ভাই আপনার মত কি আর অতশত জানি বুঝি ! তবে কবিতার অপমানটা হল কোথায় ঠিক বুঝলাম না ?
এজন্যই বলি তোতা পাখির মত কবিতা শুধু আউড়ে গেলে চলবে না অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থটাও বুঝতে হবে রে পাগলা ।জীবনান্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা রোমান্টিকতাপূর্ণ এক মহিমান্বিত আত্মহত্যার কবিতা; বিপন্ন বিস্ময়ের কবিতা। এরকম রাতেরবেলা ট্রাকের নিচে পড়ে পট করে মরে যাওয়ায় কোন রোমান্টিসিজম নেই বুঝলি গাধা- ‘গ’ ভাই বুঝিয়ে দেন।
পট করে মরে যাওয়া-শব্দগুলোতেও কাতুকুতু উদ্রেককারী কিছু ব্যাপার আছে তবে এই বেলা আমার ভাগ্য ভাল হওয়ায় ফিক করে হাসিটা আসার আগেই ক্ষোয়াক-ক্ষোয়াক শব্দদে ‘গ’ ভাই মুখভরা থুথু গিলে ফেলে পাঞ্জাবির অস্তিন গুটিয়ে আবৃত্তি শুরু করল-
“শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।
বধু শূয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল;
পেম ছিল, আশা ছিল – জোছনায় – তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল – লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার …………
……………………………………………………………”
টেবিলে কনুই রেখে মাথার চুল টেনে ধরে বিপন্ন বিস্ময়ের ব্যাপারটা যখন বুঝতে চেষ্টা করছি তখন পূর্বোক্ত ঘটানাস্থল থেকে পুরুষ কন্ঠে তীব্র বিলাপের শব্দ ভেসে আসল -বাড়ির কর্তাটি ফিরে এল মনে হয় এতক্ষনে।
ঘটানাটি ঘটেছিল ফাল্গুন মাসে। শীত চলে এসেছে। বাড়ির কর্তাটিকে সেদিনের পর আর কোনদিন দেখিনি এদিকে ।পৌষের এক বিকেলে ভাঙ্গা বাড়ির অবশিষ্টাংশ সরিয়ে সেখানে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটা হল। কারণ এখান থেকে ‘ঐশীদের’ বাড়ির বেলকনিটা স্পষ্ট দেখা যায়। কখনো সখনো ঐশী সেই বেলকনি থেকে নেমে সশরীরে তার ছোট ভাই ও বড় বোন সহযোগে এদিকে চলে আসত হাঁটতে হাঁটতে ‘খ’ তার বাইসেপ আরো খনিকটা ফুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ফেদার পিটাতে থাকে এবং তার ঘন ঘন লীভ ইট, লীভ ইট চিৎকারে আশেপাশের কয়েকমাইল প্রবলভাবে প্রকম্পিত হয় , ‘ক’ ঐশীর ছোটভাইকে ফিবোনোক্কি সিরিজ এবং পাই রহস্য সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দান করে । ‘গ’ ভাই সুযোগ পেলেই ঐশীর বড়বোনকে ‘বনলতা সেন’ কবিতা শোনায় । ‘ক’ কসম কেটে আমাদের বলেছে একদিন সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গেলে ‘গ’ ভাই নাকি টুক করে নাকি একবার চুমুও খেয়েছিল ঐশীর বোনকে ।
পূর্বোল্লেখ্য ঘটনাস্থলটির নাম আমরা দিয়েছি- বনলতা সেনের নাটোর।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৪:২৭