বাংলাদেশের কীর্তিমান কিছু লেখক এবং তাঁদের লেখার সাথে পরিচিত হওয়ার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হল সংকলিত গল্পের বই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে অগ্রগন্য।একটা গল্প সংকলনের মাত্র ২০০/২৫০ পৃষ্ঠায় পরিচিত হওয়া যায় প্রায় ২০ জন খ্যাতিমান লেখকের সৃষ্টির সাথে।থ্রিলার,অনুবাদ সাহিত্য আর ওপার বাংলার সাহিত্যিকদের তীব্র আধিপত্যে বাংলাদেশের কীর্তিমান লেখক ও তাঁদের সৃষ্টিকে চিনে নেওয়ার এর থেকে মোক্ষম আর সহজ উপায় আর হয় না।বাংলাদেশের পাঠক হয়ে আমরা যদি সেটা না করতে পারি সেটা কিন্তু বেশ লজ্জারই।
‘বাংলাদেশের ছোটগল্প’ এই শিরোনামে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশ করেছে তিনটি গল্প সংকলন।প্রথম খন্ডে স্থান পেয়েছে ১৯৪০ এর আগে জন্ম নেয়া লেখকদের গল্প।আহমাদ মোস্তফা কামালের ও দীর্ঘ ভূমিকার প্রথম খন্ডে স্থান পেয়ছে মোট বিশটি গল্প। ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে পড়েছি অতুলনীয় স্বাদের প্রতিটি গল্পই।অথচ বইয়ের এগারোজন গল্পকারের নামই জানতাম না আগে।কি লজ্জা!
সুপরিচিত লেখকদের মধ্যে রয়েছেন শওকত ওসমান।জহির রায়হান,ওয়ালীউল্লাহ,আল মাহমুদ,আবু ইসহাক,আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান আজিজুল হক -এঁনারা।
ওয়ালীউল্লাহর ‘তুলসী গাছের আত্মকাহিনী’ স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়লেও দেশবিভাগের সকরুণ চিত্রটা, তুলসী গাছওয়ালা বাড়ি দখল নেওয়া মানুষ কটির মনস্তাত্বিক বিশ্লেষনটুকু ঠিক ততটা অনুধাবন করতে পারিনি তখন।এতদিন পরে সেই লাইনকটি যেন নতুন ভাবে সামনে আসে –“উঠোনের শেষে তুলসীগাছটা আবার শুকিয়ে গেছে।তার পাতায় খয়েরী রং।সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয় নি।সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়ে নি।
কেন পড়েনি সে কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়,মানুষেরই জানবার কথা”।
‘আত্মজা এবং একটি কবরী গাছ’ আমার পড়া হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্প এটি।এরকম একটি শক্তিশালী গল্প আমি আমার ক্ষুদ্র পাঠক জীবনে আর পড়েছি কিনা মনে করতে পারি না।
জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটাও আমাদের সময় স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ছিল।জহির রায়হানের গল্প বলার ঢংটাই এমন যে গল্পের সেই মুক্তিযোদ্ধার মলাট বাঁধানো খাতার লাইনগুলো সিনেমা হয়ে চোখের সামনে চলে আসে। “……যে যেদিকে পারছে ছুটছে।কাঁচকি মাছের মত চারপাশে ছিটকে যাচ্ছে সবাই।
হেলিকপ্টার মাথার উপরে নেমে এল।
তারপর মনে হল একসঙ্গে অনেকগুলো বাজ পড়ল………কিছু দেখতে পাচ্ছি না।অনেক শব্দের তান্ডব।মেশিনগানের শব্দ।বাচ্চাদের কান্না।মানুষের আর্তনাদ।কাতরোক্তি।কয়েকটা কুকুরেরে চিৎকার।মেশিনগানের শব্দ।মানুষের বিলাপ।একটা কিশোরের কন্ঠস্বর বা’জান।বা’জান………”।
ভূমিকাতেই আহমাদ মোস্তফা কামাল জহির রায়হানের গল্প তার মতামত দিয়েছেন-‘তার গল্প যেন চলচিত্রের চিত্রনাট্য।একেকটি শব্দ দিয়েই একেকটি চিত্র নির্মান করেন তিনি’।
এছাড়াও এ বইয়ে আছে শকত ওসমানের ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দী’,শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’,আলাউদ্দিন আল আজাদের বৃষ্টি,সৈয়দ শামসুল হকের ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’ জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর ‘পুনুরুদ্ধার’ আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’র মত সুপাঠ্য কিছু গল্প ।
সর্বোপরি বেশ ভাল লাগছে বইটা।নতুন করে ছোটগল্পের প্রেমে পড়লাম আবার।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৯