বাংলাদেশের ত্রিশটির বেশি উপজাতির বসবাস। তারা প্রধানত রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, বরগুনা এ অঞ্চলগুলোতে বসবাস করছে। বাংলাদেশে ২০-৩০ লক্ষ উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। উপজাতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে ওরাওঁ, খাসিয়া, গারো, চাকমা, মগ, মনিপুরী, মুণ্ডা ও সাঁওতালি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাচারি, কুকি, তিপরা, মালপাহাড়ী, মিকির, শাদ্রি, হাজং ইত্যাদিও রয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের চাবাগান এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক উপজাতীয় ওরাওঁ ভাষায় কথা বলে। ওরাওঁ ভাষাভাষীদের সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে রংপুরে এবং সবচেয়ে কম অবস্থান রয়েছে সিলেট অঞ্চলে। এ অঞ্চলগুলোতে কিছু সংখ্যক সিন্টেং ও লালং উপজাতীয়ও বসবাস করে যারা তাদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে।
পার্বত্য গারোভাষা বা ‘আচিক কতা’ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তের পার্বত্য গারো অঞ্চলে প্রচলিত। এছাড়া রংপুর, সুনামগঞ্জ, ঢাকা জেলার শ্রীপুর এ অঞ্চলগুলোতেও কিছু সংখ্যক গারো ভাষাভাষী উপজাতীয় বসবাস রয়েছে। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে তিন লক্ষাধিক উপজাতীয় চাকমা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের দু লক্ষাধিক উপজাতীয় মগ ভাষায় কথা বলে। মগ ভাষার আদি স্থান আরাকান অঞ্চল। সিলেটের শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে মনিপুরী ভাষার প্রচলন হয়। এক সময় ঢাকার তেজগাঁও, দুর্গাপুর, কুমিল্লার কসবা এ অঞ্চলগুলোতেও এ ভাষার প্রচলন ছিল। বর্তমানে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার পঞ্চাশ হাজার উপজাতীয় মনিপুরী ভাষায় কথা বলে।
বাংলাদেশে মুণ্ডা ভাষাভাষী উপজাতীয় রয়েছে ১৫-২০ হাজার। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সাঁওতাল ভাষাভাষীর অবস্থান সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের উত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি হাজং ও কিছুসংখ্যক কাচারি উপজাতীয় বসবাস তারা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কুকি, তিপরা ও মগ ভাষাভাষীরা সবচেয়ে পুরাতন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় দুহাজার মুরং ও রিয়াং উপজাতীয় তিপরা ভাষায় কথা বলে। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়েও এক সময় প্রচুর তিপরা ভাষাভাষী উপজাতীয় বসবাস করত। বাংলাদেশে প্রায় নয় হাজার উপজাতীয় মালপাহাড়ী ভাষায় কথা বলে। সিলেটের কিছু সংখ্যক উপজাতীয় লোকের মাতৃভাষা মিকির। এছাড়া মালো, মাহাতো, গঞ্জু, কোলকামার ও কিছু ওরাওঁ উপজাতীয় মিলে প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি লোক শাদ্রি ভাষায় কথা বলে।
বাংলাদেশে বেশ কিছু উপজাতি নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে এখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের তিপরাদের অনেকে বাংলায় কথা বলে। এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও দেখা যায় হাড়ি, পাতোর, কোচ, রাজবংশী ও বেদেরাও এখন বাংলা বলে। সব মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষেরও বেশি উপজাতীয় স্বচ্ছন্দে বাংলায় কথা বলে। বাগদি, বিন্দি ইত্যাদি নিচু শ্রেণীর লোকেরা তাদের যেসব নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে তা প্রায় বাংলার কাছাকাছি।
উপজাতীয় ভাষাগুলির আদর্শ রূপের অভাব, শিক্ষার্থী স্বল্পতা সহ বিভিন্ন কারণে কোন উপজাতীয় ভাষাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। দু’একটি উপজাতীয় ভাষা ছাড়া কোন উপজাতীয় ভাষারই লিখিত রূপ নেই। শুধুমাত্র চাকমা ও মগ ভাষারই নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। শিক্ষিত উপজাতীয়রা বাংলাক্ষরে নিজেদের ভাষায় চিঠি লিখে আদানপ্রদান করে।
উপজাতীয় ভাষাগুলি ছড়া, রূপকথা, উপকথা এবং তাদের অতীত যাযাবর জীবনের ইতিহাসের মিশ্রণে লোকসাহিত্য নির্ভর যা অক্ষরজ্ঞানহীন উপজাতীয়দের স্মৃতি ও শ্রুতির উপর নির্ভর করে রচিত। উপজাতীয় গানগুলি খুবই বৈচিত্র্যময়। মৈমনসিংহ গীতিকার মত পালাগান মগ, চাকমা, খাসিয়া, গারো ইত্যাদি প্রচুর ভাষায় পাওয়া যায়। উপজাতীয় ও বাংলা উপাখ্যানে যথেষ্ট মিল রয়েছে। কোন কোন গারো কাহিনী ও মৈমনসিংহ গীতিকার পালা প্রায় একই রকম। হিমালয় পাদদেশের দু’একটি পাহাড়িয়া ভাষার পালাগান বাংলা লোকসাহিত্যে প্রচলিত, যার ভাষা প্রথম যুগের বাংলা বলে অনুমান করা হয়। বাংলা ও উপজাতীয় ছড়া বিষয়, ছন্দ ও শব্দসম্ভারে একই। ওরাওঁ ও বাংলা ধাঁধা আকৃতি-প্রকৃতি ও শব্দ-ছন্দে খুবই কাছাকাছি। ওরাওঁ ও বাংলা ঘুমপাড়ানি গানেও অদ্ভুত মিল রয়েছে।
(অসমাপ্ত)
সূত্র: বাংলা পিডিয়া, আলি নওয়াজ