"রানঝানা" সিনেমাটার কথা অনেকের ফেইসবুকের স্ট্যাটাসে দেখেছি। নায়কটাকে দেখে খুব ইম্প্রেসিভ লাগেনি দেখে দেখা হয়নি। এইবার ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া আসার সময় আর কোন দেখার মত সিনেমা না পেয়ে রানঝানা দেখতে শুরু করি। প্রথমে একটু বোরিং আর বিরক্ত লাগছিল কিন্তু শেষ হওয়ার পর প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
যাই হোক কথা আসলে রানঝানা নিয়ে নয়। কথা আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে। অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অনেকেরই আশা কোন তৃতীয় শক্তি যাদু মন্ত্রবলে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। ভারতের "আম আদমী পার্টি" এর মত দেশের মানুষ ভোটের জোয়াড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নতুন তৃতীয় শক্তিকে। আমিও হয়ত মনে মনে তাই ভাবি বা চাই।
কিন্তু কেন জানি মনে হয় আমাদের নিজেদের মৌলিক পরিবর্তন না হলে এই আশা শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। কয়েকদিন আগে এক আড্ডায় ডেভনেট এর সাব্বির ভাই আমাদের রাজনৈতিক রাজা উজির মারার আসরে হঠাত বলে উঠলেন - "... আমরা হচ্ছি সেই ১% মানুষ যারা মনে করি যে আমরা জনসাধারনকে রিপ্রেজেন্ট করি..."। কথাটা খুব সত্যি বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। আর তাই তৃতীয় শক্তির কথা যখন আমাদের মত মানুষের মুখে শুনি, ঠিক ভরসা হয় না।
আবারও সেই রানঝানায় ফিরে যাই, ইউনিভার্সিটির ডাকসাইটে ছাত্ররা যখন কথা বলায় ব্যাস্ত তখন সাধারন রাস্তার ছেলেটাই জনমানুষের সাথে কানেক্ট করে বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে গেছে সবাইকে। ঘটনাটা সিনেমায় হলেও কেন যেন মনে হয় - যে খেলা যেরকম তা সেভাবেই খলতে হয়। আমাদের এখনকার নেতাদের আমরা যত গালিই দেই না কেন, তারা সবাই মাঠ থেকেই উঠে এসেছেন। নব্বইয়ের খালেদা জিয়া বা হাসিনা যেভাবে রাস্তায় থেকে মানুষের কাছে ছিলেন, তাদের ছেলেরা কিন্তু জনমানুষের ততটা কাছে আসেননি কখনও।
কেন জানি বারবার ইংরেজ সেনাপতির কথাটা মনে পড়ে, সিরাজউদ্দৌলাকে পরাস্ত করে যখন তারা রাজধানীর দিকে যাচ্ছিলেন তখন রাস্তার পাশে দাড়ানো অসংখ্য মানুষ দাড়ানো ছিল। সেনাপতি পরে নিজের জীবনীতে লিখেছিলেন - "রাস্তায় দাড়ানো মানুষগুলোর প্রত্যেকে যদি একটা ইটও ছুড়ে মারত, ইংরেজ বাহিনি ধুলিস্বাত হয়ে যেত"। তখনকার সেই মানুষদের দুইশ বছর লেগেছিল নিজেদের ভিতর থেকে গান্ধি, সুভাস, জিন্নাহ তৈরী করতে। কিন্তু না তৈরী করে, রাজনৈতিক রাস্তায় না হেটে কিন্তু হয়নি।
আজকে আমরা যদি চাই যে আমাদের দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা আসবে, আমাদের আগে রাজনীতির মূল ধারায় আসতে হবে। ছোট থেকেই শুরু করতে হবে। আমার মনে হয় না কোন শর্টকাট আছে। ভারতের জনসাধারন তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তৃতীয় শক্তির স্বপ্নই শুধুই দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরে সেই শক্তি থেকে তৈরী রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করেছে, বড় করেছে। এরপর এইবার প্রথমবারের মত দেশের সর্বসাধারন তাদের কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করছে। পরবর্তিতে হয়ত একদিন তারা দেশও চালাবে। আমি নিশ্চিত যে কোন হঠাত আসা অভ্যুথানের মত তাদের উথ্থান হয়নি (শুরু হতে পারে)। ধীরে ধীরে তারা সাধারন মানুষের কাছে গিয়ে তাদের ভিতর থেকে উঠে এসেছেন।
একদিন আমাদের শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াও কিন্ত তাই ছিলেন। তখন মানুষ তাদের অন্তর থেকে ভালবেসে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। ক্ষমতায় এসে তারা কি করেছেন তা ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু ক্ষমতায় আসার রাস্তা কিন্তু সব সময়ই এক। এর ব্যাতিক্রম বিভিন্ন সময় হয়েছে বটে, কিন্তু স্থায়িত্ব পায়নি।
আমরা যদি চাই, আমাদেরও তাই করতে হবে। নিজেদের সুশীল বলে আর সবার থেকে আলাদা করে, আন্তর্জাতিক লবিং দিয়ে ব্যাবসা হতে পারে, কিন্তু দেশ মনে হয় চালানো যাবে না। দেশ চালাতে হলে সাহসী হতে হবে, মাঠে আসতে হবে, সাধারন মানুষের সাথে রাস্তায় দাড়াতে হবে। সব থেকে বড় কথা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আর বাংলাদেশকে ভালবাসতে হবে। নিজেকে গর্বিত এবং সৎ বাংলাদেশী হতে হবে। আমি জানি না আর কোন উপায় আছে কি না।