somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

আমিই সাইফুল
আমি একজন ইউরোপ প্রবাসী, জীবনের ঝড়-ঝাপটায় পাক খেয়ে গড়ে ওঠা আজকের এই আমি। ব্লগে তুলে ধরি মনের গভীরে লুকানো আবেগের রং, যা সোশ্যাল মিডিয়ার চটকদার আলোয় মেলে না। আমি অনুভূতির এক ফেরিওয়ালা, শব্দে বুনে যাই জীবনের অলিখিত গল্প…

গল্প: শেষ রাতের সুর

২৭ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাফি সাহেবের বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। ঢাকার অদূরে, গাজীপুরের একটি ছোট্ট গ্রামে তাঁর বাড়ি। শেষ রাতে তিনি আজও কান খাড়া করে শুয়ে থাকেন। কে গায়? কোথা থেকে যেন একটা অদ্ভুত সুর ভেসে আসে। দূরের কোনো ধানক্ষেতে, কিংবা পদ্মার ওপারে কেউ যেন গান গেয়ে তাঁকে ডাকছে। গ্রামের চারপাশে এখন আর তেমন ফাঁকা মাঠ নেই, শহরের ছোঁয়া লেগেছে অনেকটাই। তবু সেই সুর, সেই অস্পষ্ট গানের আওয়াজ তাঁকে বিভ্রান্ত করে। প্রথম প্রথম মনে হতো স্বপ্ন। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরও যখন সেই সুর কানে বাজে, তখন মনে হয়—স্বপ্ন নয়, সত্যি। কে গায়? কে তাঁকে ডাকে?


আজও শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টর্চটা জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলেন—ঠিক চারটা। শেষ রাত। জানালা খোলা থাকে সবসময়। বাইরে গ্রামের রাস্তার ম্লান হলুদ আলো জ্বলে। রাত কত গভীর, তা বোঝা যায় না। শুধু চারপাশের নিস্তব্ধতা আর হাওয়ার মৃদু শব্দ থেকে আন্দাজ করা যায়—রাত এখনও গভীরে, না শেষের দিকে। জানালা দিয়ে তাকালে বিশাল আকাশ দেখা যায়। কিছু নক্ষত্র ঝিকমিক করে। যে আকাশ তাঁর জন্মের সময়ও ছিল, শেষ রাতেও আছে।


কে গায়? গানটা কি তাঁর মনের ভেতর থেকে উঠে আসে? নাকি বাইরে কেউ সত্যি গাইছে? রাফি সাহেব নিজের মধ্যে যেন একটা উদাস সুর খুঁজে পান। জানালার পাশে দাঁড়ালে গ্রামের কিছু গাছপালা চোখে পড়ে। সামনে পাকা রাস্তা। রাস্তার ওপাশে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে কেউ দাঁড়িয়ে গাইছে না তো? না, সেখানে কেউ নেই। গানের শব্দ স্পষ্ট নয়, কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। যেন কেউ বলছে—এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারে যাত্রা শুরু হয়েছে।
বয়স বাড়লে মানুষের এমনই হয়। রাফি সাহেবের মনে ভয় জাগে। কেন এই যাত্রা? কেন এই অন্ধকার? শেষ রাতে গ্রামের বাড়িগুলোতে একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়। পাখা চালানোর দরকার পড়ে না। ঘুম ভাঙলে তিনি পাখা বন্ধ করে দেন। পাখার শব্দে মনে হয় তিনি বিভ্রমে ভুগছেন। পাখা বন্ধ করলে যেন প্রকৃতির গোপন সত্য ধরা পড়বে। কিন্তু তবু সেই প্রশ্ন—কে গায়? কোথায় গায়? গানের অস্পষ্টতায় তিনি হতচকিত হয়ে পড়েন। তখন নিজেকেই বলেন, হয়তো কেউ তাঁকে সতর্ক করছে—একাকিত্বে এত বিচলিত হওয়ার কী আছে? সারাজীবন পরিশ্রম করেছ, এখন তোমার ছুটি। কেউ আর তোমার অপেক্ষায় নেই।
বুকটা তাঁর এত খালি কখনো হয়নি। তানিয়ার মৃত্যুর সময়েও না। তানিয়া, তাঁর স্ত্রী, যিনি তাঁর জীবনের সঙ্গী ছিলেন চল্লিশ বছরেরও বেশি। তানিয়া চলে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি শক্ত থেকেছিলেন। কিন্তু এখন সেই শক্তিও যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে। বিছানার পাশ থেকে চশমাটা তুলে পরলেন। চোখে ভালো দেখতে পান না। চশমা না পরলে বোঝা যায় না কতটা অকার্যকর হয়ে পড়েছেন তিনি। চশমা পরলে মনে হয়, তিনি এখনও অক্ষম নন।


এই জায়গাটা একসময় ফাঁকা ছিল। গাজীপুরের এই গ্রামে বাড়ি করার সময় সবাই তাঁকে পাগল ভেবেছিল। তানিয়াকে জমিটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বর্ষার সময় পায়ের নিচে কাদা, চারপাশে জল। তানিয়া কেঁদে ফেলেছিল—‘এ কেমন জায়গায় জমি কিনলে?’ রাফি সাহেব বলেছিলেন, ‘এত কম টাকায় ঢাকার কাছাকাছি আর কোথায় জমি পাবো?’ তানিয়া আর কিছু বলেনি। জমিটা কেনার পর মাঝে মাঝে মনে হতো, এমন শখ না জন্মালেও চলত। আয় কম ছিল, সংসার বড়। তবু মনের মধ্যে একটা জেদ ছিল। দারিদ্র্য তাঁকে সারাজীবন তাড়া করেছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ভয়—বাড়ি না হলে, চাকরি না থাকলে, অক্ষম হয়ে গেলে তিনি রাস্তায় পড়বেন। ছেলেমেয়েদের জীবনেও যদি এমন দুর্ভাগ্য আসে, তবে তিনি বাঁচবেন কী করে?
সেই ভয়ই তাঁকে শক্তি দিয়েছে। একটা জমি, একটা বাড়ি, ছাদের নিচে আশ্রয়—এসবের জন্য তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। এখন মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটল। ফাঁকা বাড়িতে একা মানুষের এই হাসি যেন নিষ্প্রাণ। কেন হাসলেন? মনে পড়ল তাঁর বড় ছেলে রুবেলের জন্মের কথা। এক বর্ষার রাতে, গ্রামের ছোট্ট হাসপাতালে। তিনি উদ্বেগে পায়চারি করছিলেন। শেষ রাতে নবজাতকের কান্না শুনেছিলেন। যেন বলছে, ‘আমি এসেছি, আমার জায়গা চাই।’ সবাই নিজের জায়গা খুঁজে পেলে সংসারে কেউ কারো থাকে না। রাফি সাহেব সবার জন্য জায়গা করে দিয়েছেন। কিন্তু এই বয়সে দেখছেন, নিজের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে।


জানালার পাশে এক গ্লাস পানি রাখা থাকে। পানি তুলতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। জীবনটা যেন পোকামাকড়ের মতো মনে হচ্ছিল। দোতলার জানালায় দাঁড়ালে গ্রামের অনেক বাড়ি দেখা যায়। এই বাড়িগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো সুখ-দুঃখ। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। একটা নিঃসঙ্গতা সবার মধ্যে কাজ করে। আকাশে মেঘের ওড়াউড়ি। এই জানালাটা তাঁর প্রিয়। তানিয়া বেঁচে থাকতে সবকিছুর খেয়াল রাখত। একটা চেয়ার পেতে বসতেন দুজনে। সকালে সূর্য ওঠা, পাখির ডাক—সব দেখতেন। তখন গ্রামের চারপাশে ধানক্ষেত ছিল। দূরে পদ্মার ওপারে একটা সাদা বাড়ি দেখা যেত। রহস্যময় লাগত সেটাকে। এখন সব বদলে গেছে। ধানক্ষেতের জায়গায় বাড়ি, রাস্তা।
কেন এসব ভাবছেন? ভাবার কিছু নেই। ছেলেমেয়েরা সবাই চলে গেছে। মেয়ে রুমার বিয়ে হয়েছে। রুবেল ঢাকায় চাকরি করে। ছোট ছেলে রাসেল ফ্ল্যাট কিনে সপরিবার চলে গেছে। নাতি রিয়াদও আর নেই। কতদিন রিয়াদ তাঁর একাকিত্বের সঙ্গী ছিল। ‘দাদু, আমি যাব না,’ বলত। রাফি সাহেব বলতেন, ‘যাও, তোমার স্কুল কাছে হবে।’ রিয়াদ বায়না ধরত, ‘আমি এখান থেকেই যেতাম।’ রাসেল বলত, ‘আপনি বুঝিয়ে বলুন। ও বোঝে না, এত দূর থেকে কত কষ্ট।’ রাফি সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ভেবো না। আমি চালিয়ে নেব।’


ওরা চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন খুব অস্থির লেগেছিল। এখন আর কারো জন্য ভাবতে হয় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার কেউ নেই। মুক্তি। চোখে জল এল। পাখির বাসার মতো—খড়কুটো জড়ো করে বাসা, ছানার জন্য খাবার, তারপর উড়ে যাওয়া। পাখির কোনো বেদনা থাকে না। মানুষের কেন থাকে?
তখনই মনে হলো কে যেন ডাকছে—‘দাদু, আমি!’ কে? ‘আমি, তোমার ছোট আমি।’ ছোট আমি মানে কী? মনে পড়ল শৈশবের কথা। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে। দাদা-ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে ছোটাছুটি। বড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা। সবাই মিলে একটা জমজমাট সময়। বাবার শেষ জীবনটা ছিল উৎসবের মতো। মৃত্যুর সময় গ্রামের লোকজন এসেছিল। হরিনাম সংকীর্তন হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘সবার খাওয়া হয়েছে?’ যেন একটা সহজ রাস্তায় যাত্রা শুরু করেছেন।


রাফি সাহেব ঘড়িতে চাবি দিতে গিয়ে দেখলেন হাত অসাড়। ঘড়িটা বিছানায় পড়ে রইল। সারারাত যেন পানি পড়ার শব্দ শুনেছেন। মনে হলো রিয়াদ কল খুলে রেখেছে। ছুটে গেলেন। কিন্তু কেউ নেই। শেষ রাতে তিনি একা। হঠাৎ পায়ে কিছু ঠেকল। আলো জ্বাললেন। দেখলেন রিয়াদের একটা প্লাস্টিকের খেলনা—একটা ছোট্ট ঘোড়া। হাতে তুলে নিলেন। মনে হলো তিনি একা নন। খেলনাটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। চা বানালেন। চা আর খেলনা নিয়ে বসলেন।


‘রিয়াদ তোমাকে ভালোবাসে না,’ বললেন। মনে হলো খেলনাটা বলছে, ‘ভালোবাসে।’ ‘তাহলে ফেলে গেল কেন?’ ‘ওর অনেক কাজ। স্কুল, পড়া।’ রাফি সাহেব হাসলেন। পাগলামি করছেন। কিন্তু এই খেলনাই এখন তাঁর সঙ্গী। সকালে রিয়াদ দুষ্টুমি করত। চশমা লুকিয়ে দিত। রাফি সাহেব ছুটতেন। রাসেলের বউ রাগত। তিনি মজা পেতেন। ‘আমার বাড়ি, আমার নাতি,’ ভাবতেন।
শেষ রাতে তিনি খেলনাটা নিয়ে সিঁড়িতে উঠতে নামতে লাগলেন। ‘লাফিয়ে নামো, দাদু!’ যেন রিয়াদ বলছে। তিনি লাফালেন। হঠাৎ পড়ে গেলেন। সকালে কাজের লোক এসে দেখল দরজা বন্ধ। কড়া নাড়ল। কেউ খুলল না। দরজা ভাঙতেই দেখা গেল রাফি সাহেব সিঁড়িতে পড়ে আছেন। হাতে খেলনাটা। রাসেল এসে দেখল। মনে হলো—এটা কি খেলনা, না কোনো হাড়? সে চুপচাপ তুলে নিল। বাড়িতে যেন সবসময় কিছু থেকে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:০১
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঈদের কবিতাঃ গলির ধারের ছেলেটা

লিখেছেন ইসিয়াক, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৩৬

ঈদের খুশি ঈদের হাসি,করছি হিসেব কত
ভাবছি বসে আঁকছি ছবি যে যার মনের মতো ।

রঙবাহারি জামা জুতো,নানা ঢঙে চলা
অকারণে হেসে হেসে নানান কথা বলা ।

গলির ধারের সেই ছেলেটি যে সদা... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেই যে আমার নানা রঙের ঈদগুলি ......

লিখেছেন অপ্‌সরা, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪২


পেছনে ফিরে তাকালে আমি সবার প্রথমে যে ঈদটার কথা স্মরন করতে পারি সেই ঈদটায় আমি পরেছিলাম আমব্রেলা কাট নীলচে বলবল রং একটা জামা এবং জামাটা বানিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেগেছে বাংলাদেশ: কমে গেছে আগ্রাসী ভারতের সীমান্ত হত্যা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:৫৬

জেগেছে বাংলাদেশ: কমে গেছে আগ্রাসী ভারতের সীমান্ত হত্যা

জুলাই ২০২৪-এর বিপ্লবের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চিত্র আমূল বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ভারতের বিএসএফ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের সেকাল এবং একালের ঈদ

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ ভোর ৪:১৩



কানাডার আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে কিনা সেটা খুঁজতে গতকাল সন্ধ্যায় বাসার ছাদে বা খোলা মাঠে ছুটে যাইনি। শৈশবে সরু এই চাঁদটা আকাশে দেখতে পেলেই দেহকোষের সবখানে একটা আনন্দধারা বয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঈদ মোবারক!

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০৪



ঈদ মোবারক!

ঈদ উল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন! এক মাসের সংযম ও আত্মশুদ্ধির পর এসেছে খুশির ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, ভালোবাসা ও একসঙ্গে থাকার মুহূর্ত। আসুন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×