জেগেছে বাংলাদেশ: কমে গেছে আগ্রাসী ভারতের সীমান্ত হত্যা
জুলাই ২০২৪-এর বিপ্লবের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চিত্র আমূল বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ভারতের বিএসএফ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে কথা বলছে। এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ও ভারতের আগ্রাসী সীমান্তনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থানেরই প্রতিফলন।
কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে এমন দৃঢ়তা কল্পনাতীত ছিল। সে সময় নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশলের কারণে বিজিবি যেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বই ভুলে গিয়েছিল। ভারত বাংলাদেশকে তার করদরাজ্য হিসেবেই দেখত—এমনকি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দুদেশের সম্পর্ককে "স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক" বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল একপাক্ষিক আনুগত্য, যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ বলি দেওয়া হতো। জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী নেতাদের ভারতে আশ্রয় নেওয়াই এর প্রমাণ।
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ও আওয়ামী লীগের নীরবতা
বিএসএফের গুলিতে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা নিয়মিত হলেও আওয়ামী সরকার কখনও ভারতকে দায়ী করেনি। উদাহরণ স্বরূপ:
- ২০২০ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে তিন বাংলাদেশি নিহত হলে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দোষ দিয়েছিলেন বাংলাদেশি নাগরিকদের, বিএসএফকে নয়।
- ২০১৫ সালে এক সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান) বলেছিলেন, "গরু চোরাচালান বন্ধ করতে হবে।"
- ২০১২ সালে বেনাপোলে বিএসএফের গুলিতে এক গরু ব্যবসায়ী নিহত হলে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছিল। জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, "সরকারের এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।"
বিপ্লব-পরবর্তী পরিবর্তন
জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট বলেছেন, "সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রধান বাধা।" তাঁর এই বক্তব্য আওয়ামী আমলের দাসত্বপূর্ণ মানসিকতা থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসাকেই নির্দেশ করে।
অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান
ভারতের সঙ্গে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান বা চীনের সীমান্তে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে না। বিশেষ করে ১৯৬২ সালের পর চীন-ভারত সীমান্তে কোনো গুলিবর্ষণই হয়নি। অথচ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে গত ১০ বছরে ৫০৫ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে (হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য)। এটি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন।
কেন এই বৈষম্য?
পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কম, কারণ পাকিস্তান "প্রতিঘাতে জবাব" দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক শক্তি দুর্বল নয়—বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ৩৭তম। সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের আনুগত্য, যা সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল।
সীমান্তের জটিলতা ও ভারতের 'বিগ ব্রাদার' আচরণ
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম। ব্রিটিশরা এখানে এলোমেলো সীমানা রেখা টেনে দিয়েছে—একই বাড়ির রান্নাঘর ভারতে, শোয়ার ঘর বাংলাদেশে! স্বাভাবিক যাতায়াতকে বিএসএফ "অনুপ্রবেশ" বলে গুলি চালায়, অথচ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের জামাই আদরে ফেরত পাঠানো হয়।
চীনা বিশ্লেষকরা ভারতের আচরণকে "ত্রিমূর্তি নীতি" বলে ব্যাখ্যা করেন:
- নেকড়ে: ক্ষুদ্র দেশগুলোর (বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান) প্রতি আচরণ।
- শৃগাল: মাঝারি শক্তির দেশ (পাকিস্তান) প্রতি।
- মেষ: বৃহৎ শক্তি (চীন) প্রতি।
মূলকথা, জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের সীমান্তনীতি আত্মমর্যাদাশীল হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই দৃঢ়তাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া, যাতে সীমান্ত আর মৃত্যুফাঁদ না হয়ে শান্তি ও সহযোগিতার সেতু হয়। বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে "শক্তির ভারসাম্য" বজায় রেখে কূটনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে আর কখনও বিএসএফের বুলেট আমাদের নাগরিকদের জীবন কেড়ে নিতে না পারে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৯:১৭