প্রথম পর্ব
সব মানুষেরই কোনো না কোনো পেশা থাকে। নিজের পেশা ছাড়া তাঁরা অন্য কাজও করেন। আল্লাহতায়ালার সব নবী-রাসুল (সা.) জীবনযাত্রার জন্য কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জিনিসপত্র তৈরিসহ প্রভৃতি কাজ করেছেন। হজরত ঈসা (আ.) ছাড়া সব নবী-রাসুল (সা.) বিয়ে করেছেন। তবে নবীদের মূল দায়িত্ব ছিল তাবলিগ এবং দাওয়াত। তাবলিগ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আর দাওয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করা।
নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নবীরা যে কাজ করতেন সে কাজের দায়িত্ব পড়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর একটি বাক্য যদি আমাদের কারো জানা থাকে, তা অন্যদের পৌঁছে দিতে। রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশ পালন করা সব মুসলমানের জন্য ফরজ। তাবলিগ জামাত এ কাজটিই করছে। তাবলিগে থাকার সময় ধর্মের বাণী কোনো ব্যক্তি যতটুকু জানেন, ঠিক ততটুকু অন্যকে জানানোর অনুশীলন করেন। বস্তুত তাবলিগ থেকে ফিরে আসার পরই শুরু হয় আসল কাজ। দীনের দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব কেবল আলেম-ওলামাদের নয়। যিনি চারটি সূরা জানেন, নিজে নামাজ পড়েন_এমন ব্যক্তিও অন্যকে নামাজের দাওয়াত দিতে পারেন। নিজে নামাজে যাওয়ার সময় অন্যকে নামাজ পড়তে যাওয়ার অনুরোধ করতে কাউকে আলেম হতে হয় না।
সুন্নাহ অনুসরণে নিষ্ঠা : তাবলিগ আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাসুলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। এখানে সুন্নাহ পালনের জন্য কোনো জবরদস্তি করা যায় না। বরং নবীর জীবনচরিত নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করে তাঁর প্রতি বিশেষ মহব্বত সৃষ্টি করা হয় তাবলিগে। নির্বাচিত হাদিসগুলো প্রতিদিনই অন্তত দুই ঘণ্টা আলোচনা করা হয় তাবলিগে। যেমন মৃত্যুর সময় একমাত্র দাড়ি ছাড়া আমাদের শরীরের সংযুক্ত কোনো সুন্নাহই বহন করে রোজ হাশরে পেঁৗছাতে পারব না। অথচ এই দাড়ি সুন্নাহ মোতাবেক রাখার মতো ঈমান আমাদের অনেকের মজবুত নয়।
অরাজনৈতিক আন্দোলন : যাঁরা তাবলিগ করেন, তাঁরা তাবলিগ থেকে ফিরে এসে রাজনীতি করতে পারেন। কিন্তু তাবলিগে গিয়ে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ। তাই সব দলের অনুসারীরা তাবলিগে অংশ নেন। ফলে তাবলিগে সময় কাটাতে এসে রাজনৈতিক বিভেদে জড়িয়েছেন_এমন নজির নেই।
তাবলিগি জামাতের নেতৃত্ব : ইসলাম ধর্মে নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ফেরাউন-নমরুদের প্রকৃতি। নেতৃত্ব কামনা করা হারাম। কেউ নেতৃত্বের উপযুক্ত হলে তাঁকে নেতা হিসেবে পাওয়ার প্রচেষ্টা এবং কামনা করা অন্যদের জন্য ওয়াজিব। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দেখা গেছে, নেতৃত্ব নিয়ে তাবলিগের কোনো সংকট নেই। তাবলিগের সাফল্য নেতার ওপর নির্ভরও করে না। নেতা দুর্বল বা অসুস্থ হলেও তাবলিগের কাজে ব্যাঘাত হয় না। এটি একটি সুশৃঙ্খল আন্দোলন বিধায় অনুসারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো শাস্তি বা সমালোচনা নেই। এ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় সেবা, সম্মান এবং ভালোবাসার মাধ্যমে। সে জন্য তাবলিগে নতুনদের ইকরাম বা সম্মান করা হয় সবচেয়ে বেশি। আমিরের অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু কেউ তা লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। লঙ্ঘনকারীর অন্তরকে পরিবর্তন করা হয় আলোচনা, সম্মান ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।
জমিনের নিচে আসমানের ওপরে : তাবলিগ একটি পরকাল বা আখিরাতমুখী আন্দোলন। দুনিয়ার এমন কোনো সাফল্য তাদের কাম্য নয়, যা পরজীবনের কোনো কাজে আসবে না। তাবলিগে যাঁরা নতুন যোগ দেন তাঁদের প্রথমই বলে দেওয়া হয়, দুনিয়ায় তাবলিগের কাজের পরিধি হলো_জমিনের নিচে এবং আসমানের ওপরে। আসমানের ওপরওয়ালার সন্তোষ হাসিল করে জমিনের নিচের জিন্দেগি অর্থাৎ মৃত্যুর পরের জিন্দেগিকে সুন্দর করাই এর মূল লক্ষ্য। এ জন্য তাবলিগে থাকার সময় কোনো অনুসারী দুনিয়ায় সাফল্যের জন্য রাজনীতি, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া পছন্দ করে না।
এর অর্থ এই নয়, তাবলিগে গেলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে। তাবলিগের দাবি হলো, বছরে অন্তত ৪০ দিন বা যত দিন কোনো ব্যক্তি তাবলিগ জামাতের সঙ্গে কাটান, তত দিন ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে থাকা এবং নিজের আত্দার সংশোধনের জন্য আল্লাহর দীনের বাহক হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরা।
তাবলিগ সাহিত্য : তাবলিগের মর্মবাণী এবং বিষয়বস্তু খুবই সহজ ও সরল। এটা বুঝতে শিক্ষিত হতে হয় না। তবে এত বিরাট আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও তাবলিগ সম্পর্কে বইপত্র তেমন দেখা যায় না। যাঁরা তাবলিগকে সারা জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের জন্য পাঠ্যপুস্তক এবং সাহিত্য হলো কোরআন, কোরআনের অনুবাদ, তাফসির ও হাদিস। সাধারণ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কোরআন-হাদিস ছাড়া ভিন্ন পাঠ্যপুস্তক আছে দুটি। শায়খুল হাদীস আল্লামা মোহাম্মদ জাকারিয়া (রহ.) রচিত তাবলিগি আমল নির্যাস, আমলের ফাযায়েল বা আমলের উপকারিতা সিরিজ। এর মধ্যে আছে ঈমানের ফজিলত, নামাজের ফজিলত, রোজার ফজিলত, কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত, বিভিন্ন আমলের ফজিলত প্রভৃতি। দ্বিতীয়টি হলো_ আরবি ভাষায় রচিত মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ কান্দলাবীর (রহ.) তিন ভলিউমের 'হাউয়াতুস সাহাবা'র অনুবাদ।
দোয়ার ওপর গুরুত্ব : তাবলিগের মুরব্বিরা সাফল্যের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করেন এবং তাঁর সাহায্য কামনা করেন। এ সাহায্য চাওয়ার পদ্ধতি রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, সালাতুল হাজাত, সালাতুল তাসবিহ পড়া, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া এবং গভীর রাতে চোখের পানি ফেলে কান্নাকাটি করা। আর এ কান্নাকাটির সর্বোত্তম স্থান হলো কাবা শরিফ এবং মদিনার মসজিদ। যাঁদের পক্ষে মক্কা-মদিনায় যাওয়া সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য দোয়ার সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ এবং সর্বোত্তম সময় হলো তাহাজ্জুদ নামাজের পরবর্তী বা পূর্ববর্তী সময়। তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের আমলের পুরস্কার একমাত্র আল্লাহতায়ালার কাছে কামনা করেন।
লেখক: এ জেড এম শামসুল আলম
সাবেক ধর্মসচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক