আরজ আলীর লেখা খন্ড খন্ড ভাবে আগে কিছুটা পড়েছিলাম। আরজ আলীর 'সত্যের সন্ধান' বইয়ের আর্টিকেলগুলো এখন আবার নিবেদিত প্রাণ ব্লগার এমএ হোসেনের কল্যানে পড়ার সুযোগ হচ্ছে এবং মূলত সে কারনেই এ পোষ্টের অবতারণা ।
তার লেখার আলোচনা শুরু করার আগে ধর্মীয় প্রশ্নের বা ধর্মীয় প্রসঙ্গের একটা প্রকৃতি বলা প্রয়োজন বোধ করছি। ধর্মীয় যেকোন প্রশ্নকে বা ধর্মীয় প্রসঙ্গকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায়। এক মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ,অন্যটি তথ্যভিত্তিক যৌক্তিক বিষয়।
আমি যদি বলি আমার নীল রঙ প্রিয়,সেটা পুরোই মনস্তাত্ত্বিক, কোনযুক্তি বা তথ্যভিত্তিক কোন কথা বলে আমার এই প্রিয়ত্ব রোধ করা যাবে না। হতে পারে এই প্রিয়ত্বের কিছু যুক্তি আছে...মাথার উপর প্রিয় আকাশটা নীল..দিগন্তজোড়া সাগরটা নীল, নীল প্রিয় ফুল অপরাজিতা...কিন্তু তাই বলে যার প্রিয় রঙ সবুজ তাকে আমি তিরস্কার করতে পারি না।কারন এটাই বৈচিত্র, এটা কারও ভুল বা সঠিক চয়েস না।
আর আমি যদি বলি আমি কোন প্রকার জ্বালানী ছাড়া একটা ইন্জিন বানিয়ে ফেলেছি (বঙ্গদেশের হট টপিক), তাহলে বুঝতে হবে থার্মোডিনামিক্সের ল্য গুলো আমার এখনো জানা নাই...তথ্যগত বা যৌক্তিক ভুল।
যাই হোক আরজ আলীর লেখাগুলোর আলোচনায় প্রয়োজন হলে প্রসঙ্গ নির্ধারনের চেষ্টা করব, তবে সবসময় দরকার হবে না। আর এমএ হোসেনের লেখাটা সহজলভ্য হওয়ায় তার লিঙ্ক ধরেই আপাতত শুরু করা যাক...
১ম ও ২য় পর্বকে ভূমিকা বলা যায়, তাই পর্ব ৩ থেকেই শুরু.. ■ এর পর আরজ আলীর বক্তব্য, এবং ► এর পরে তার উপর মন্তব্য দেয়া হল
ব্লগার এমএ হোসেনের লিঙ্ক অনুযায়ী পর্ব ৩ এর আলোচনা :
■ আমাদের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা জানিতে পারিতেছি যে, বিশ্বমানবের সহজাত বৃত্তি বা 'স্বভাবধর্ম' একটি। এ সংসারে সকলেই চায় সুখে বাঁচিয়া থাকিতে, আহার-বিহার ও বংশরক্ষা করিতে, সন্তান-সন্ততির ভিতর দিয়া অমর হইতে। মানুষের এই স্বভাবধর্মরূপ মহাব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সংসারে সৃষ্টি হইল কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সমাজ, নীতি এবং রাষ্ট্র; গড়িয়া উঠিল জ্ঞান-বিজ্ঞানময় এই দুনিয়া। মানুষ যেখানে যে কাজেই লিপ্ত থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করিলেই দেখা যাইবে যে, সে তাহার 'স্বভাবধর্ম' তথা 'স্বধর্ম' পালনে ব্রতী। এই মহাব্রত উদ্যাপনে কাহারো কোন প্ররোচনা নাই এবং এই ধর্ম পালনে মানুষের মধ্যে কোন মতানৈক্য নাই।
►এই ব্যাপারে আমি আরজ আলীর সাথে একদম একমত। তিনি স্বভাবধর্ম বলতে যেটা বুঝিয়েছেন সেটা আসলে প্রবৃত্তি বা ইন্সটিঙ্কট। অন্যভাবে বলা যায় টিকে থাকার সংগ্রাম, আরজ আলী বলেছেন এ ধর্ম পালনে মানুষের মধ্যে কোন মতানৈক্য নাই -তা হতে পারে কিন্তু এর জন্যই যত অনৈক্য-মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে এমনকি জীবজগতের সব ক্ষেত্রে। টিকে থাকার সংগ্রামই মানুষের প্রাথমিক সংগ্রাম-আরজ আলীর ভাষায় 'স্বধর্ম' পালনে ব্রতী। আমার প্রশ্ন হল সবাই যদি স্বধর্মপালনে ব্রতী হয় বা সুখে বাঁচিয়া থাকিতে চায় তবে যারা অসীম প্রতিকুলতার ভিতরে নিজেদের অস্তিত্বকে ভীষণ হুমকির মুখে ঢেলে দিয়ে ঈশ্বরের বানী প্রচার করে গেছেন তারা কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে ফেললেন না?? তাদের এই কাজকে তো অন্তত স্বধর্ম পালন বলা যায় না, আরজ আলীর ভেরি ফার্স্ট স্টেটমেন্টই তার পরবর্তী সমস্ত বক্তব্যের বিরোধী। বলতেই পারেন ধর্মকে ব্যবহার করে প্রাচীনকাল হতে মানুষ অনেক ফায়দা লুটেছে...কিন্তু এটা তার সাথে প্রাসঙ্গিক হয় না...ফায়দা লোটার ব্যাপারটা পরে এসেছে, কোন ধর্ম সেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে...নতুন একটি ধর্মমত শত বিরুদ্ধশক্তির মুখে প্রচার করতে গিয়ে প্রধান ধর্মমত গুলির প্রচারকগণ, নবীরা কী নিদারুন কষ্ট সহ্য করেছেন তা সবাই জানে। তাই এটা নিশ্চিত যে স্বধর্মের গড্ডলিকা প্রবাহে ঈশ্বরের বানী প্রচারক নবীগণ অন্তত গা ভাসাননি।
■ সাধারণত আমরা যাহাকে 'ধর্ম' বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম। যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগণ এই বিশ্বসংসারের স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। "স্রষ্টার প্রতি মানুষের কি কোন কর্তব্য নাই? নিশ্চয়ই আছে"- এইরূপ চিন্তা করিয়া তাঁহারা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিয়া দিলেন। অধিকন্তু মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখাইয়া দিলেন সেই মহাজ্ঞানীগণ। এইরূপে হইল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হইল ভিন্ন ভিন্ন।
► এই স্টেটমেন্টকে আমার কাছে তার ভূমিকার উদ্দেশ্যের আত্মহত্যা বলে মনে হয়, তিনি তার লেখার উদ্দেশ্য রেখেছেন পাঠককে প্রশ্ন করবেন এবং সত্য প্রকাশ করবেন, কিন্তু প্রথমেই ধর্ম যে কাল্পনিক তা বলে দেয়া তো তাহলে সমীচীন নয়,তিনি স্বভাবধর্ম হতে প্রচলিত ধর্মকে পার্থক্য করতে চেয়েছেন ভাল কথা, বড়জোর বলতে পারতেন স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক ধর্ম,সমাজবিজ্ঞানীগণও তাই বলে আসছে, কিন্তু তা না করে সরাসরি নিজের মত দিয়েছেন। তারপর তার ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ধারনা তা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিবার প্রয়াস এটা ধর্মের উৎপত্তির কারন নয়, এটা ধর্মের একটা অংশ-রিচুয়ালিক পোরশন। বিশ্বাস, একতাবদ্ধ হওয়া এগুলিই ধর্মের মূল প্রেরণা। আর থিওলজিয়ান মাত্রেই জানে প্রধান ধর্মগুলোর মতবাদ মোটেও ভিন্ন নয়- ভিন্ন তার বহি:সজ্জা, অন্তসজ্জা নয়।
■ এই কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, এমনকি স্বামী-স্ত্রীতেও এই কল্পিত ধর্ম নিয়া মতভেদের কথা শোনা যায়। এই মতানৈক্য ঘুচাইবার জন্য প্রথমত আলাপ-আলোচনা, পরে বাক-বিতণ্ডা, শেষ পর্যন্ত যে কত রক্তপাত হইয়া গিয়াছে, ইতিহাসই তাহার সাক্ষী। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বমানব একমত হইতে পারিয়াছে কি?
► মতভেদ সবকিছু নিয়েই হয়,ধর্ম নিয়ে হবে সেটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ধর্মের উদ্দেশ্য থাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, ভিন্ন ধর্মালম্বীরা ধর্মের কারনে বাক-বিতণ্ডা বা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয় সেটা জাতিবিদ্বেষের চেয়ে ভয়ংকর নয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে মানুষ ভূমি দখল, নিজ রক্তের আত্মদম্ভ নিয়ে যত যুদ্ধ করেছে তার তুলনায় ধর্মযুদ্ধ কিছুই না, হতে পারে অধিকাংশ সময় দুপক্ষের ধর্মও ভিন্ন থাকে, সেটা ভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে খুবই সম্ভব,তারমানে এই নয় সেটা ধর্মযুদ্ধ। যেমন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যে দুটো যুদ্ধ ১ম আর ২য় বিশ্ব যুদ্ধ তার কারন ধর্ম না , জাতিবিদ্বেষ বা রাজনৈতিক কারন। কেউ বলতে পারে হিটলার তো ইহুদিদের নিধন করেছে, তারমানে ধর্মীয় যুদ্ধ। কিন্তু সবাই জানে এখানে হিটলারের জাতিবিদ্বেষই আসল কারন, হিটলার তো বলতোই , জার্মানরাই সেরা জাতি। তাছাড়া হিটলার খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু ছিল না, বাইবেলে বলা নেই ,ইহুদিদের ধরে ধরে মার। তাই ধর্মের কারনে যুদ্ধের চেয়ে জাতি বিদ্বেষ আরো ভয়ানক। আর এ ক্ষেত্রে ধর্মের কল্যানময়ী দিককে অস্বীকার করার উপায় নেই, ধর্মের চেয়ে ভাল আর কোন নিয়ামক আছে যা একাধিক জাতিকে ঐক্যবদ্ধকরতে পারে????
■ কেবল যে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন মত এমন নহে। একই ধর্মের ভিতরেও মতভেদের অন্ত নাই। হিন্দু ধর্মের বেদ যাহা বলে, উপনিষদ সকল ক্ষেত্রে তাহার সহিত একমত নহে। আবার পুরাণের শিক্ষাও অনেক স্থলে অন্যরূপ। 'বাইবেল'-এর পুরাতন নিয়ম (Old Testament) ও নূতন নিয়মে (New Testament) অনেক পার্থক্য......পবিত্র কোরানপন্থীদের মধ্যেও মতবৈষম্য কম নহে। শিয়া, সুন্নী, মুতাজিলা, ওহাবী, কাদিয়ানী, খারিজী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মত এক নহে। আবার একই সুন্নী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হানাফী, শাফী ইত্যাদি চারি মজহাবের মতামত সম্পূর্ণ এক নহে...
► একমত, ব্যাপারটা ধর্মালম্বীদের ধর্মথেকে বিচ্যুত আচরণ। তারজন্য ধর্মদায়ী সেটা ঠিক না,যেমন কুরআনে বলা আছে, 3:103:: And hold fast, all together, by the rope which Allah (stretches out for you), and be not divided among yourselves
Yusuf Ali's Quran Translation
আর চার মাজহাবের মত এক না এটা ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানশূন্যতার প্রকাশ। ইসলামে ইজমা কিয়াসের কল্যানে এবং কিছু ব্যাপারে ভিন্ন ভাবে পালনের অপশন রয়েছে,তারমানে এই নয় তারা ভিন্ন মতালম্বী।
■ হিন্দুদের নিকট গোময় (গোবর) পবিত্র, অথচ অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানদের নিকট কবুতরের বিষ্ঠাও পাক, অথচ অমুসলমান মাত্রেই নাপাক। পুকুরে সাপ, ব্যাঙ মরিয়া পঁচিলেও উহার জল নষ্ট হয় না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছুঁইলেও উহা হয় অপবিত্র। কেহ কেহ একথাও বলেন যে, অমুসলমানী পর্ব উপলক্ষে কলা, কচু, পাঁঠা বিক্রিও মহাপাপ। এমনকি মুসলমানদের দোকান থাকিতে হিন্দুর দোকানে কোন কিছু ক্রয় করাও পাপ।
►এটাও ধর্মালম্বীদের ধর্মথেকে বিচ্যুত আচরণ, আরজ আলীর সামাজিক সংস্কারকে ধর্ম হিসেবে মনে করেছিল সেটা পুরান কথা।বেশি কিছু না বলে ঋগ্বেদের একটা ভার্স কোট করি,
'যখন কোন ক্ষুধাতুর ব্যক্তি রব করিতে করিতে উপস্থিত হয় তখন যে অন্নবান হয়েও হৃদয় কঠিন করে রাখে এবং অগ্রে নিহে ভোজন করে. তাকে কেউ কখনো সুখী করে না।' ঋগ্বেদ ১০:১১৭:২
ঋগ্বেদ সর্ব্বোচ্চ গ্রন্থ হিন্দু ধর্মে, এই ভার্সে শুধু হিন্দুর কথা বলা হয় নাই, সব মানুষের কথাই বলা হয়েছে। আর কোরআনের রেফারেন্স দিতে চাইলে তো অসংখ্য দেয়া যাবে।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:৫৯