মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস সীমাহীন উত্তেজনামূলক বক্তৃতা,বিবৃতি ইত্যাদি প্রচারণার মাধ্যমে গোলাম আযম এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে। এর একটি তালিকা ক্রমধারা অনুযায়ী
সাজালে বোঝা যাবে কতখানি নিচ এবং তৃতীয় শ্রেনীর রাজনীতিক ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
টিক্কা খানের কামানের গোলায় যখন ঢাকা শহর আগুনে জ্বলছিল,তখন গোলাম আযম ৬ এপ্রিল,১৯৭১ টিক্কা খানের সাথে দেখা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের পদেেপর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করেন।(দৈনিক সংগ্রাম,৭এপ্রিল,১৯৭১)।
৭ এপ্রিল গোলাম আযম সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলেন,সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের(মুক্তিবাহিনীদের-লেখক)দেখামাত্র খতম করে দেওয়া হবে। (দৈনিক সংগ্রাম,৮এপ্রিল,১৯৭১)।
১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। গোলাম আযম এই শান্তি কমিটির শীর্ষস্থানীয় সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।।(দৈনিক সংগ্রাম,১১এপ্রিল,১৯৭১)।
১২ এপ্রিল ছাত্র সংঘ নেতা মতিউর রহমান নিজামী,মোহাম্মদ ইউনুস,
নুরুল ইসলাম,শাহ জমাল চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেন,স্বাধীন বাংলা গোলামে পরিনত করবে।
১২ এপ্রিল ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটির মিছিলে গোলাম আযম নেতৃত্ব দেন এবং মিছিল শেষে গোলাম আযম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।।
(দৈনিক সংগ্রাম,১৩ এপ্রিল,১৯৭১)।
১৪ এপ্রিল দৈনিক সংগ্রাম বলে যে, দিনাজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে এবং সকল অনুপ্রবেশকারী মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করা হয়েছে।
১৫ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পাকিস্তানি সৈন্যদের গ্রামাঞ্চালে গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের(মুক্তিবাহিনীকে) আক্রমন করার পরামর্শ দেয়।
২২ এপ্রিল জামালপুরে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। মে মাসে জামায়াত নেতা ইউসুফের নেতৃত্বে খুলনায় রাজাকার
বাহিনী প্রথম কাজ শুরু করে।
২২ এপ্রিল দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে যে,মাননীয় প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান ও টিক্কা খানের সময় উপযোগী পদেেপর জন্য পাকিস্তান রা পেয়েছে।
২৩ এপ্রিল দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনী ধরার জন্য বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করার পরামর্শ দেয়।
গোলাম আযম পরিচালিত দৈনিক সংগ্রাম ৩০ এপ্রিল সংখ্যায় বলে যে,
যারা পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করেছিল তাদের পাকিস্তানে জায়গা হবে না।
পয়লা মে দৈনিক সংগ্রাম বলে,দেশের শান্তির জন্য দুষ্কৃতকারীর (মুক্তিবাহিনীর) মূল উৎস উৎখাত হওয়া প্রয়োজন। পত্রিকাটি আরো মন্তব্য করেন,দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিবাহিনীকে)
নিমূল করা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া,পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাংলাদেশ সরকার’ নামক কোন কিছুর অস্তিত্বও নেই বলে দৈনিকটি উল্লেখ করে।
৪ মে জামায়াতের এই দৈনিক পত্রিকাটি মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে। পত্রিকাটি বলে,এটা হবে ‘ঈমানি দায়িত্ব’।
৬ মে দৈনিক সংগ্রাম বলে, ‘বাংলাদেশ’ওয়ালারা ভূত তা অকল্যাণ বয়ে এনেছে।
২৫ মার্চ রাতের গনহত্যা ও ধ্বংসলীলাকে সমর্থন করে নির্লজ্জের মতো জামায়োতে ইসলামীর মুখপত্রটি ৮ মে তারিখের সংখ্যায় বলে,শেখ মুজিব ২৬ মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা কায়েমের পরিকল্পনা এঁটে ছিলেন। সেনাবাহিনী তা ২৫ মার্চ হঠাৎ আক্রমন চালিয়ে এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে আমাদের পাকিস্তানকে বাঁচিয়েছে।
২৪ মে জামায়োতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানায়। পত্রিকাটি বলে,‘গেরিলাগিরির’ নামে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা পািকস্তানি সেনাবাহিনী তছনছ করে দেবে।
২৭ মে দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনী ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে।
এদিন পত্রিকাটি মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনির কাছে আবেদন জানায়।
২৮ মে জামায়োতে ইসলামীর পত্রিকাটি মুক্তিবাহিনী নির্মূলের জন্য অস্ত্রশস্ত্র দাবি করে। তারা একই সাথে বেসমরিক পোশাকধারী একটি বাহিনী গঠনেরও পরামর্শ দেয়।
১৩ জুন জামায়োতে ইসলামী বলে,‘গেরিলাগিরির’ নামে যেসব দুষ্কৃতকারী দেশের শান্তি ব্যাহত করছে,সামরিক কর্তৃপরে অনুমতিক্রমে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতেই
দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিবাহিনীকে) নির্মূল করার জন্য গ্রাম প্রতিরা বাহিনী গঠন করতে হবে।(দৈনিক সংগ্রাম,১৩ জুন,১৯৭১)।
১৫ জুন দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনিকে খতম করার জন্য শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে না থেকে পাকিস্তানপন্থীদের পথ বেছে নিতে বলা হয়।
১৭ জুন গোলাম আযম বলেন,দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিযোদ্ধারা) এখনও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলেন,এদের যদি পকিড়াও করা হয়,তবেই পরিস্থিতি দমন করা যাবে। (দৈনিক
সংগ্রাম,১৭ জুন,১৯৭১)।
২০ জুন গোলাম আযম লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন,যারা প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেছিল,তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী
সকল দুষ্কৃতকারী(মুক্তিযোদ্ধ) উৎখ্যাত করেছে। তিনি মুক্তিবাহিনী মোকাবেলার জন্য সরকারের কাছে অস্ত্র সরবরাহের দাবি জানান। (দৈনিক সংগ্রাম,২১ জুন,১৯৭১)।
২২ শে জুন গোলাম আযম এক সাাৎকারে বলেন,তারা কখোনই পাকিস্তান ত্যাগ করতে পারবেন না। এই জন্য কোরবানি দেওয়ার জন্যেও তাঁর কর্মীরা প্রস্তুুত রয়েছে।
একই দিন গোলাম আযম এক কর্মিসভায় বলেন,বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট সামপ্রতিক গোলযোগ ১৮৫৭ সালের বাংলা বিদ্রোহের চেয়েও দশগুন বেশি শক্তিশালী
ছিল। তিনি ২৩ জুন বলেন,পূর্ব পাকিস্তানি ভাইয়েরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাস করবে।(দৈনিক সংগ্রাম,২২ জুন ও ২৩ জুন,১৯৭১)।
২২ জুন গোলাম আযম এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব দল আন্দোলন করছে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষনার আহ্বান জানান।(দৈনিক সংগ্রাম,২৩ জুন,১৯৭১)।
৩০ জুন গোলাম আযম এবং তার রাজনৈতিক পিতা মাওলানা মওদুদী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সংসদ সদস্যদের পদ বাতিল ঘোষনা করায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অভিনন্দন জানান। (দৈনিক
সংগ্রাম,৩০ জুন,১৯৭১)।
একই দিন জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করাকে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা বলে অভিহিত করে।
৪ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম এক উপসম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ইহুদী ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে।
৪ জুলাই ইসলামী ছাত্রসংঘের পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ুদ্র অস্ত্রের সাহায্যে রাজাকারদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লড়াইয়ের প্রশিন শুরু করা হয়।
(দৈনিক সংগ্রাম, ৪ জুলাই, ১৯৭১)।
৮ জুলাই জামায়াতে ইসলামী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়। একই দিন দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে,পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যেই এসেছে।
৯ জুলাই থেকে জামায়াতে ইসলামী,তার নেতারা এবং দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনীকে দুষ্কৃতকারীর সাথে ‘ডাকাত’ নামে অভিহিত করতে শুরু করে।(দৈনিক সংগ্রাম, ৯ জুলাই, ১৯৭১)।
১৬ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম এবং জামায়াতের নেতারা ভাষা আন্দোলনের স্মরণে নির্মিত ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি পকিস্তানি সেনাবাহিনী ভেঙ্গে ফেলায় অভিনন্দন জানায়।
একই দিন দৈনিক সংগ্রাম বলে,য়ারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে পাকিস্তানপন্থীরা তাদের কোনোদিনই মা করবে না।
১৭ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।
জুলাই মাসে বরিশালে মুসলিম লীগের সভায় ব্যারিষ্টার আখতারউদ্দিন আহমদ,মেজর আফসারউদ্দিন,এডভোকেট আব্দুর রহমান বিশ্বাস প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী ও বিদেশী চর
আখ্যায়িত করে এদের উৎখাত করার আহ্বান জানান। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ জুলাই, ১৯৭১)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃটিশ টেলিভিশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের সচিত্র প্রতিবেদন দেখানো হলে দৈনিক সংগ্রাম ১৯ জুলাই সাফাই গেয়ে লেখে, এগুলো ঘূর্ণিঝড়ের ছবি।
২ আগষ্ট গোলাম আযম ঢাকার মাদ্রাসার ছাত্রদের মিছিলে বলেন,
মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নয়,এটা আদর্শিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জিততেই হবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ৩ আগষ্ট, ১৯৭১)।
একই দিন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বলেন,
মুক্তিবাহিনী পাঁচগুণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হবে।
একই সভাই মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাদের ‘ভাই’ আখ্যায়িত করায় ৩ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে,জনাব নিজামী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমাদের ‘ভাই’ বলে
যথার্থ করেছেন,সেনাবাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে শত্রুর (মুক্তিবাহিনীর) মোকাবেলা করতে হবে।
৮ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযম এক উপসম্পাদকীয়তে লেখেন,১৯৬৫ সালের যুদ্ধে টিক্কা খানের বীরত্বের কথা শুনে তাঁকে এক নজর দেখার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছিল। তাঁর ছবি আমার
মানসপটে বিশেষ মর্যাদার সাথে আকা রয়েছে।
১২ আগষ্ট গোলাম আযম বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের দুশমন আখ্যা দিয়ে তন্নতন্ন করে তালাশ করে খুজে বের করার আহ্বান জানান। মতিউর রহমান নিজামী ও মোহাম্মদ ইউনুসও অনুরূপ
বিবৃতি দেন।(দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগষ্ট, ১৯৭১)।
১২ আগষ্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পুতুল পূর্ব পাকিস্তানি ডাঃ মালেকের মন্ত্রিসভায় জামায়াতে নেতারা যোগদান করেন।
১৩ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রামও মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তিদানের আহ্বান জানায়।
পাকিস্তানের শেষ আজাদী দিবস ১৪ আগষ্ট সংখ্যায় দৈনিক সংগ্রাম স্বীকার করে,অত্যাচার-অনাচারের কারণে মুক্তিযুদ্ধোবিরোধী তাদের ‘শান্তি কমিটি’ অশান্তি কমিটিতে পরিণত হয়েছে।
১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের শেষ আজাদী দিবসে কার্জন হলে আয়োজিত এক সেমিনারে পিডিপি নেতা নূরুল আমীন বলেন,আজ আজাদী দিবস আনন্দের দিন,কিন্তু এই আনন্দের দিনেও আমাদের মন ভারাক্রান্ত।
কিন্তু গোলাম আযম একই অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বলেন,এবার প্রাণচাঞ্চল্যের সাথে আজাদী দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। পাকিস্তানের ভিতরে হাজার হাজার দুশমন জন্ম নিয়েছে। বাইরের চেয়ে ভিতরের দুশমন আরো বেশি
বিপজ্জনক । ঘরে ঘরে এইসব দুশমন খুঁজে বের করতে হবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগষ্ট, ১৯৭১)।
১৯ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রামের সাথে এক সাক্ষাতকারে গোলাম আযম বলেন,মুক্তিযুদ্ধের পাল্টা অভিযান নিয়ে আমাদের আসাম দখল করে নেওয়া উচিত।
২০ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযম বেনামে এক উপসম্পাদীয়তে আজাদী দিবস উপলক্ষে ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের তোরণ নির্মাণকে অভিনন্দিত করেন।
২২ আগষ্ট মতিউর রহমান নিজামী এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাকিস্তান যারা চায় না,তারা ইসলাম চায় না। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ আগষ্ট, ১৯৭১)।
২৩ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রাম ‘রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ জারি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।
২৬ আগষ্ট গোলাম আযম পেশোয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিবাহিনীর)হাত থেকে রা করেছে এবং এই দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংস করার জন্য
সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৭ আগষ্ট, ১৯৭১)।
জামায়াতে নেতা চৌধুরী রহমত এলাহী একই দিন সামরিক আইন তুলে নেয়ার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে একটি বিমান নিয়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে শহীদ হন। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম মতিউর রহমানের নিন্দা করে সম্পাদকীয় লেখে। আমাদের এই
বিরশ্রেষ্ঠকে দৈনিক সংগ্রাম ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে আখ্যায়িত করে এবং পাকিস্তানি পাইলট মিনহাজ রশিদ যে মতিউর রহমানকে হত্যা করে দৈনিক সংগ্রাম সেই পাকিস্তানি পাইলটের জন্য আহাজারি করে লেখে,মিনহাজ
রশিদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী শুনে গর্বে বুক ভরে ওঠে। (দৈনিক সংগ্রাম, ৩০ আগষ্ট, ১৯৭১)।
পয়লা সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম আবার মন্তব্য করে মুক্তিযোদ্ধা পাইলট (বীরশ্রেষ্ঠ) মতিউর রহমান বিশ্বাসঘাতক এবং পাকিস্তানি পাইলট মিনহাজুর রশীদ ‘শহীদ’।
পয়লা সেপ্টেম্বর গোলাম আযম করাচিতে বলেন যে,বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (স্বাধীনতাকামীদের)খতম করার উদ্দেশ্যে রাজাকাররা ভাল কাজই করেছে। (দৈনিক সংগ্রাম, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
২ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী এবং দৈনিক সংগ্রাম বাঙালি নিধনকারী রক্তলোলুপ টিক্কা খানের বিদায়ে মন্তব্য করেন যে,তিনি কথা কম বলতেন এবং কাজ বেশি করতেন। তিনি বীরত্বের
সাথে ব্যবস্থা গ্রহন না করলে পাকিস্তান এতদিনও টিকে থাকতো না। এদেশের মানুষ কোনদিন টিক্কা খানকে ভুলবে না এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
৪ সেপ্টেম্বর জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে ভারতের এজেন্ট ও দুষ্কৃতকারী বলে বিবৃতি দেন।
একই দিন দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থন করায় সংবাদপত্রগুলোকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করে।
৬ সেপ্টেম্বর গোলাম আযম মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন। (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
একই দিন দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে,পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজাকারদের কৃতিত্বে আনন্দিত ও গর্বিত।
৬ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী বলেন ছাত্রসংঘ কর্মীরা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জমি রা করবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
১৩ সেপ্টেম্বর গোলাম আযম মুক্তিবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার আহ্বান জানান। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
১৪ সেপ্টেম্বর গোলাম আযম শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়,তাদের যে কোনো ব্যাক্তিকেই তালাশ করে বের করে শায়েস্তা করার আহ্বান জানান। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
একই দিন দৈনিক সংগ্রাম লেখে,আলবদর একটি নাম। যেখানেই তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। মুক্তিবাহিনীর কাছে আরবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।
১৪ সেপ্টেম্বর যশোরে মতিউর রহমান নিজামী সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার আহ্বান জানান। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
১৬ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী বলেন,দুনিয়ার কোন শক্তিই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
১৭ সেপ্টেম্বর গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজ ট্রেনিং গ্রহনরত রাজাকার শিবির পরিদর্শন করেন এবং রাজাকারদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য বত্তৃতা দেন।
১৮ সেপ্টেম্বর জামায়াতে নেতা আব্বাস আলী খান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের মালেক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন।
১৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে রাজাকারদের প্রসিণ ক্যাম্পে গোলাম আযম এক ভাষণে বলেন,বাইরের চেয়ে ঘরের শত্রু বেশি তিকর। এদের তম করতে হবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
২১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে নেতা আব্বাস আলী খান বলেন,পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য একদল ছাত্র দায়ী। (দৈনিক সংগ্রাম, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী তাঁবেদার মন্ত্রীদের জামায়াতে ইসলামী এক সংবর্ধনা দেয়। এখানে গোলাম আযম বলেন,পাকিস্তানই যদি না থাকে,তাহলে জামায়াত কর্মীদের বেঁচে
থেকে লাভ নেই । (দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।
২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম ‘শেখ সাহেবের খাদ্য তালিকা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলে,রাষ্ট্রদ্রোহী শেখ মুজিব জেলের ভেতরে ভাল খাওয়া-দাওয়া করছেন এটা দুঃখজনক।
৭ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনী মোকাবেলায় রাজাকারদের জন্য ভারি অস্ত্রশস্ত্র দাবি করে বলে,অন্যথায় দুষ্কৃতকারী (মুক্তিবাহিনী) নির্মূল করা যাবে না।
একই দিন ইত্তেহাদুল ওলামার বৈঠকে মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেমদের সামরিক টেনিংদানের আহ্বান জানানো হয়।
১১ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ৩জন রাজাকার নিহত হলে দৈনিক সংগ্রাম একে ‘গৌরবের মৃত্যু’ বলে অভিহিত করে।
এই দিন জামায়াত নেতারা পুনরায় রাজাকার-আলবদরদের জন্য ভারি অস্ত্রশস্ত্র দাবি করে বলে,অন্যথায় মুক্তিবাহিনী দমন করা যাবে না।
১৪ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক আবুল খালেক এক বিবৃতিতে বলেন,রাজাকাররা সামরিক আইন কর্তৃপরে সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে কাজ করছে।
১৮ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম বলে,যারা পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না,তারা যেন এদেশ ছেড়ে চলে যায়।
২০ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম ‘তিক্ত হলেও সত্য’শিরোনামে বলে,জাতি কর্তৃক গোলম আযমের গলাধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২৯ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম অফিস-আদালত থেকে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের বের করে দেয়ার আহ্বান জানান।
৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে,দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিবাহিনীর) ক্রমবর্ধমান দুঃসাহসিক তৎপরতা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাদের এই দুর্বৃত্তপনার অবসান করা হবে। ইতিমধ্যেই সারাদেশে রাজাকার,মুজাহিদ ও বদর বাহিনী এই সব দুষ্কৃতকারী (মুক্তিবাহিনী)-কে একের পর এক খতম করে চলেছে।
৭ নভেম্বর ‘বদর দিবস’ শিরোনাম নিবন্ধে উল্লেখ করে,মক্তিযোদ্ধাদের নির্মূলে হয় গাজী,নয় শহীদ হওয়ার শপথ নিতে হবে।
৭ নভেম্বর জামায়াত নেতা আবুল খালেক বদর দিবসের এক জনসভায় বলেন,বাংলাদেশ আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিতে হবে।
এদিন ইসলামী ছাত্রসংঘ ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধোবিরোধী এক মিছিল বের করে এবং শ্লোগান তোলে,‘আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে।’ (দৈনিক সংগ্রাম,৮ নভেম্বর, ১৯৭১)
জামায়াতে ইসলামী দলটি যে ইসলামের নামে বরাবরই মিথ্যা এবং জালিয়াতির আশ্রয় নেয় তার প্রমান ৮ নভেম্বরের দৈনিক সংগ্রাম। এদিন সংগ্রাম বলে,মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল খরচ ইসরাইল বহন করছে। মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিংও দিচ্ছে দিচ্ছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী। ইহুদীরা মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র এবং টাকা-পয়সাও দিচ্ছে।
একই দিন দৈনিক সংগ্রাম বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরই রাজাকারদের স্থান। রাজাকার বাহিনীর দুই শাখা আলবদর ও আলশামস-এর ওপরই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
১০ নভেম্বর জামায়াতে নেতা আব্বাস আলী খান এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১০ নভেম্বর, ১৯৭১)
১২ নভেম্বরের দৈনিক সংগ্রাম প্রকাশ্যে বুদ্ধিজীবি হত্যার পরামর্শ দেয়। এদিন তারা বলে,বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধোকে সমর্থন করছে তাদের দ্রুত খুঁজে বের করে উৎখাত করতে হবে। এটা যতো বিলম্ব হবে ততোই পাকিস্তানের তি হবে।
ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে এক নিবন্ধে বলেন,পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বদর বাহিনী গঠিত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে আলবদর বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে পর্যুদস্ত করবে।
১৬ নভেম্বরের দৈনিক সংগ্রাম মক্তিবাহিনীর তৎপরতা যাতে বিদেশে যেতে না পারে তার জন্য বিদেশী সাংবাদিকদের ওপর কড়া নজর রাখার পরামর্শ দেয়।
একই দিন ছাত্রসংঘ নেতা ও আলবদর বাহিনী প্রধান মতিউর রহমান নিজামী এক নিবন্ধে বলেন,পাকিস্তান হচ্ছে আল্লাহর ঘর।
১৯ নভেম্বরের দৈনিক সংগ্রাম গোলাম আযমকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানোর আহ্বান জানায়।
২৪ নভেম্বর ইসলামী ছাত্রসংঘ নেতারা এক বিবৃতিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
একই দিন গোলাম আজমও এক বিবৃতি দেন। তিনি পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণের আহ্বান জানান এবং রাজাকার-আলবদরদের উন্নতমানের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার আহ্বান জানান। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১)
২৫ নভেম্বর জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও আব্বাস আলী খান পাকিস্তান রর জন্য দেহের শেষ রক্তবিন্দু দেয়ার জন্য জামায়াত কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।১২
জামায়াতে ইসলামী তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম এবং গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান,মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ ১৯৭১ সালের মুক্তিযদ্ধের নয়টি মাস এভাবে ক্ষিপ্ত কুকুরের মতো বাংলা, বাঙালি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকি,মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কলুষিত করে তুলেছিল। ২৫ মার্চের পর থেকেই সারাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। মা-বোনদের ধরে নিয়ে তাদের প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং সর্বশেষে ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র একদিন আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
নয় মাসের দৈনিক সংগ্রামের বিভিন্ন পাতা থেকে সংপ্তি করে ছোট যে ডায়রি তুলে দেয়া হয়েছে,তাতেই বোঝা সম্ভব সেদিন কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করেছিল। ‘মুক্তিযোদ্ধাদের খতম কর’,‘বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজ কর’,‘মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের পাকিস্তানে জায়গা হবে না’,‘মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দাও’,‘মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কর’, ‘মুক্তিযোদ্ধা নির্মূলের জন্য আরো উন্নত অস্ত্র দাও’,‘মুক্তিবাহিনী খতম করার জন্য সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না’,‘স্বাধীনতার সমর্থক দলগুলোকে নিষদ্ধ করতে হবে’,মুক্তিযুদ্ধ রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা’,‘স্বাধীন বাংলা ইহুদী ষড়যন্ত্র’,‘পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে’,পাকিস্তানের জন্য শেষ রক্তবিন্দুদানের আহ্বান’,‘মক্তিবাহিনীরা ডাকাত’,‘মুক্তিযোদধাদের পাকিস্তানপন্থীরা কোনদিনই মা করবে না’,‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান দুষ্কৃতকারী’,‘আলবদর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাক্ষাৎ আজরাইল’,‘পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াত কর্মিদের বেঁচে থেকে লাভ নেই’, ‘রাজাকারদের গৌরবের মৃত্যু’,‘পাকিস্তানের অস্তিতে যার বিশ্বাস করেনা’,তাদের এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে’, ‘অফিস-আদালত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বের কর’,‘বাংলাদেশ অন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিতে হবে’ইত্যাদি বাক্যগুলো প্রতিদিন গোলাম আযম,তাঁর শিষ্যরা,তার মুখপত্র বিরামহীনভাবে প্রচার করেছে। যে কোন সুস্থ মানুষ লাইব্রেরিতে গিয়ে দৈনিক সংগ্রামের পাতা খুললেই এই দলিল পড়ে শিউরে উঠবে।
আজ যেসব ভন্ড,প্রতারক,লম্পট রাজনীতিবিদরা গোলাম আযম ও জামায়াতীদের পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন তাদের জন্য করুনা হয়। তারা অমানুষ এবং খুনীর সহযোগী-খুনী। গোলাম আযমের নির্দেশে এদেশে রাজাকার-আলবদররা যে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে,তার দায়ভাগ নিতে হবে তাদেরও।
বিএনপি সরকারের তিন লম্পট(ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা,জমিরুদ্দিন সরকার ও রফিকুল ইসলাম মিয়া) যে ভুমিকা নিয়েছিল এদের প্রতিষ্ঠিত করতে,তাকে শুধু নির্লজ্জ বলা যায় না,তাঁরা বাংলা মায়ের কুসন্তান এবং কলঙ্ক। এরা গোলাম আযমের চেয়েও পাপী এবং নরাধম।
যারা আজ গোলাম আযমকে মাফ করে দিতে চায়,তারা হল পিশাচের বন্ধু। গোলাম আযম কি আজও মাফ চেয়েছে,নাকি ভুল স্বীকার করেছে,যে গায়ে পড়ে গিয়ে মাফ করে দিতে হবে!
আজ গোলাম আযমদের নির্মূলের শ্লোগান এবং দাবি উঠেছে,কারন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল,পাকিস্তান না থাকলে তাদের বেঁচে থেকে লাভ নেই।
মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ঘরে খুজে বের করার জন্য তারা নির্দেশ দিয়েছিল,তাই তাদেরও আজকে ঘরে ঘরে খুঁজে বের করতে হবে। এবার আর আপোসের কোনো প্রশ্নই নেই।
কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও গোলাম আযম বাংলাদেশ ধ্বংসের এবং অস্বীকারের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। সেই প্রমান এবং সাক্ষ্য তিনি নিজেই রেখেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’নামে যে দিবস পালন করা হয় তার আহ্বায়ক হয়েছিলেন এই গোলাম আযম।
একই বছর ডিসেম্বরে গোলাম আযম লণ্ডনে যান এবং সেখানে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’নামে এক বাংলাদেশবিরোধী স্থায়ী ষড়যন্ত্র শুরু করেন। দীর্ঘ আট বছর এই কমিটির মাধ্যমে গোলাম আযম লণ্ডনে ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেন। (মুহাম্মদ কামরুজ্জামান,গোলাম আযমের সংগ্রামী জীবন,ঢাকা,১৯৮৯ পৃষ্ঠা৭০ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, পূর্বোক্ত,পৃষ্ঠা ৮২।)
গোলাম আযমের নির্দেশে লিখিত তাঁর তথাকথিত সংগ্রামী জীবনীর লেখক আলবদর মুহাম্মদ কামরুজ্জামান জানাচ্ছেন,১৯৭৩ সাল থেকে বেশ কয়েকবার গোলাম আযম সৌদি আরব যান এবং সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের সাথে দেখা করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার আহ্বান জানান।
আলবদর কামরুজ্জামান নিজেই লিখেছেন,বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের ওপর ধর্মনিরপেতার নামে ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেয়ার কোন ষড়যন্ত্র যাতে সফল হতে না পারে,সে বিষয়ে গোলাম আযম সৌদি বাদশাহর প্রভাব কাজে লাগানোর অনুরোধ জানান। (দৈনিক বাংলা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।)
আলবদর নেতা গোলাম আযম নিজেও জানাচ্ছেন,‘হজ-পরবর্তী ৬ বছর আমি প্রধানত লণ্ডনে কাটিয়েছি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিপন্ন মনে করাই ছিল স্বাভাবিক। (দৈনিক বাংলা, ১৮ এপ্রিল ১৯৭৩। )
এই স্বীকারোক্তি শুনেছি আমরা গোলাম আযমের নিজের জবানীতেই। এর চেয়ে বড় প্রমান আর দলিল কি প্রয়োজন আছে। গোলাম আযমরা এই পর্যন্ত যতো খুন,হত্যা,লুট,ধর্ষণ ইত্যাদি করেছে তার
সবটাই তারা করেছে ধর্মের নামে, ইসলামের নামে। ইসলামকে এভাবে তারা কীভাবে বারবার তি করেছে,তার একটা বিবরণ পূর্বের পর্ব-1 এ আলোচনা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের তৎকালীন হাক্কানী আলেমরা জামায়াত ইসলামী,মওদুদী, গোলাম আযমদের সম্বন্ধে তাই বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আলেমরা জামায়াতীদের কাফের বলেও ফতোয়া দিয়েছিলো।
জামায়াতীরা হল ধর্মোন্মাদ। ধর্মের মূল প্রেরণার সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। জামায়াতীরা ইসলামের মূল ভিত্তি নামাজ নিয়ে আন্তরিক নয়,দেশের অনেক জামায়াতীকে দেখা যায় তারা প্রকৃতপক্ষে নামাজই পড়তে
জানে না। তারা ইসলাম কায়েম করবে কিভাবে! মাওলানা সাঈদী তার জনসভা এখন ভিডিও ব্যবসায় পর্যন্ত নিয়ে গেছেন,ইসলামের তি করার আর থাকলো কি!
বহুল কথিত রাজাকার মাফ পাওয়ার আওতায়ও গোলাম আযম পড়ে নি। স্বাধীনতার পরপর জেলখানাগুলো রাজাকারে ভরে গিয়েছিল। সেই সময় দেশে এতো ম্যাজিষ্ট্রেট বা বিচারকও ছিল না যে দ্রুত
বিচার নিষ্পত্তি করা সম্ভব ছিল।
উপরন্তু মাওলানা ভাসানী ও জাসদ দালাল আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে তৎকালীন শেখ মুজিব সরকারের প্রতি প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। হলিডে পত্রিকায় তৎকালীন ভাসানী ন্যাপ
নেতা এনায়েতুল্লাহ খান তো প্রকাশ্যে দালালদের হালাল করার নির্লজ্জ প্রচারণা চালাতেই ছিলেন। ভাসানী ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিঞা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাঁকেও জেলে আটকে রাখা
হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া হলে তৎকালীন ইসলামিক একাডেমি মিলনায়তনে তাঁর সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনায় প্রধান অথিতির ভাষণ দেন রাশেদ খান মেনন (তিনি তখন ভাসানী ন্যাপের নেতা ছিলেন)
অনেকেই এসব ঘটনা ভুলে গেছেন। এই সময় বড় বাস্তব ঘটনা ছিল পাকিস্থানে কয়েক লাখ বাঙালির আটকেপড়া। বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী জেনারেল মজিদ-উল হক,পররাষ্টমন্ত্রী কর্নেল
মুস্তাফিজ সাহেবরাও এই আটকেপড়ার মধ্যে ছিলেন। স্বদেশ তাদের এই লাখো বাঙালির আত্মীয়স্বজনরা চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছিল সেদিন। পাকিস্তানিরা তাদের জিম্মি করে রেখেছিল
। ফলে ছেড়ে দিতে হয়েছিল বন্দী পাকিস্তানি এক লাখ সৈন্যকেও।
এত কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে কতগুলো পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। তৎকালীন সরকার গোলাম আযমসহ তৎকালীন ১৫ জন দালাল রাজনীতিককে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ
দেন। (দৈনিক বাংলা, ২২ এপ্রিল ১৯৭৩।)
১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে সরকারের এক হ্যাণ্ডআউটে বলা হয়,যুদ্ধাপরাধীদের জন্য জেনাভা কনভেনশনের ৩ নং ধারা লংঘনের দায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। (দৈনিক বাংলা, ২১ এপ্রিল
১৯৭৩, ১৭ মে ১৯৭৩, ৩০ আগষ্ট ১৯৭৩, পয়লা ডিসেম্বর ১৯৭৩।)
যুদ্ধাপরাধীরা আদালতে হাজির না হওয়ায় গোলাম আযমসহ মোট ৩৯ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। (দৈনিক বাংলা, ২১ এপ্রিল ১৯৭৩, ১৭ মে ১৯৭৩, ৩০ আগষ্ট ১৯৭৩, পয়লা ডিসেম্বর ১৯৭৩।)
এরপর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দালালদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। মুসলিম লীগপন্থী একদল রাজনীতিক ছিলেন যারা মূলত যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছে। জামায়াতীদের মতো অস্ত্র নিয়ে
মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে নি। এই রকমসহ কয়েক প্রকার লোককে মাফ করা হয়।
প্রায় ১২ হাজার মামলা এবং ২৯ হাজার আসামী এই সময় কারাগারে আটকে পড়ায় তাদের ওপর নির্ভরশীল কয়েক লাখ পরিবার-সদস্য নিদারুণ সঙ্কটে পতিত হয় যা তৎকালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব
ফেলে। কিন্তু বলা হয়,
১. দেশদ্রোহিতা,হত্যা,ধর্ষণ,ডাকাতি,অগ্নিসংযোগের অপরাধী মাফ পাবে না।
২. দালালমন্ত্রী,উপদেষ্টা,রাজাকার কমাণ্ডার মাফ পাবে না।
৩. শান্তি কমিটির নেতা মাফ পাবে না।
৪. ১৮ ধরনের অপরাধী মাফ পাবে না। (দৈনিক বাংলা, ২১ এপ্রিল ১৯৭৩, ১৭ মে ১৯৭৩, ৩০ আগষ্ট ১৯৭৩, পয়লা ডিসেম্বর ১৯৭৩।)(বিভিন্ন প্রকার যুদ্ধাপরাধের দায়)
সুতরাং আজ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছে তা স্পষ্টতই মুক্তিযদ্ধের চেতনার ভিত্তিমূল থেকে উৎসারিত। গোলাম আযম ও খুনী রাজাকার-আলবদরদের আজ নির্মূল করার কথা উঠেছে,কারণ তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করতে চেয়েছিল।
গোলাম আযমের জায়গা বাংলাদেশে হবে না-এই শ্লোগান উঠছে এই জন্য যে,গোলাম আযম ’৭১ সালে বলেছিলেন,মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা পাকিস্তানে হবে না।
জামায়াতীদের উৎখাত ও খতম করার জনমত গড়ে উঠেছে এই জন্য যে, জামায়াতীরা মুক্তিকামী মানুষকে খতম করেছিল।
গোলাম আযমদের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করার কথা উঠেছে এই জন্য যে, গোলাম আযমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করতে চেয়েছিল।
জাতি আজ মুক্তিযুদ্ধের খুনীদের বিচার চায়। তাদের সকল অপকর্মের দলিল রয়েছে। পিছিয়ে যাওয়ার আর কোন অবকাশ নেই।