ভাষা নিয়ে কত কত কত লেখা হলো। দেরিদা এসে একদিন বললেন ডিকনস্ট্রাকশনের কথা। যতদূর জানা, তাতে ঠিক-যে কোনো ‘সংজ্ঞা’ দিতে পেরেছেন তা নয়, বা, সহজ করে বুঝিয়ে দিতে, তা-ও নয়। তা হলেও খুব আলোড়ন তুলেছে এই ‘তত্ত্ব’, যেমনটা একদিন তুলেছিল অস্তিবাদ। কাদের মধ্যে আর, যারা পড়ে, যারা লেখে, আর ভাবে তাদের একটি বিরাট অংশের মধ্যে।
এই বি-নির্মাণ হচ্ছে নাকি একটি অনুসন্ধানপদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, সব ধরনের লেখাই বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ, লেখকের ইচ্ছা যা-ই থাকুক, ভাষার ভেতরকার বিপরীতার্থকতাকে তিনি অতিক্রম করতে পারেন না। ফলত, লেখা, তা সে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন যে বিষয়েরই হোক, লেখা বা টেক্সট তার সত্যতা, চূড়ান্ত অর্থ, চিরকালীনতা হারিয়ে ফেলে। এই ধারণার আওতায় শেষপর্যন্ত আর্টস ও সমাজবিজ্ঞানের সব শাখাকেই নিয়ে আসা হয়। যেমন, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, এমনকি, স্থাপত্যবিদ্যা।
দেরিদা কবি নন। নন নাট্যকার, গল্পলেখক বা অন্য কোনো অর্থে সাহিত্যিক। বুদ্ধিজীবী বলা হয়েছে তাঁকে। সে কারণেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন বহু লোক, বুঝিয়ে বলো। স্পষ্ট করে বোঝাতে পারেননি তিনি। এমনও বলেছেন একবার, ‘বি-নির্মাণ, যদি এমনকিছু থেকে থাকে, টেকস প্লেস অ্যাজ দ্য এক্সপেরিয়েন্স অব দ্য ইমপসিবল।’ বি-নির্মাণ বোঝা কষ্টকর - এমন এক অভিযোগের উত্তরে একবার বলেছেন বিরক্ত হয়ে, ‘বি-নির্মাণ বুঝতে হলে পরিশ্রম করতে হবে। বি-নির্মাণ যদি এতই দুর্বোধ্য হবে তবে হাজার হাজার শ্রোতা কেন ছুটে আসে আমার বক্তৃতা শুনতে। ওরা নিশ্চয়ই যথেষ্ট বোঝে আরও বোঝার মতো (দে ফিল দে আন্ডারস্ট্যান্ড এনাফ টু আন্ডারস্ট্যান্ড মোর)।
একই সাক্ষাৎকারের শেষে তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল, বি-নির্মাণের একটি অন্তত সংজ্ঞা দিন। তিনি বলেছিলেন, কিছু বলা অসম্ভব মনে হচ্ছে। আমি শুধু তা-ই করতে পারি যা আমাকে অতৃপ্ত করে রাখে।
মজার। এই ব্যাপার। কত পোস্টমডার্নিস্টের কতরকমের বোঝানোর চেষ্টা। তবে সেভাবে ব্যাখ্যা করা না গেলেও বিশ্বাস্য তো মনে হতেই পারে। ঠিক দেরিদা-র মতো করে না বললেও অন্যভাবে তো বলেছেন অস্তিবাদীদের কেউ কেউ, বিশেষত তথাকথিত অ্যাবসার্ড নাট্যকারেরা। পঞ্চাশের দশক থেকেই। যে, সঙ্গতি-টঙ্গতি নেই গো। হ্যাঁ, হাসতে পারো, একটু কাঁদতেও পারো। তবে, নিশ্চিন্ত থাকার কিছু নেই। সেজেগুজে থিয়েটারে এসে, সাজানো-গোছানো গল্পের মধুরেণ সমাপয়েৎ দেখে ফিরে যেতে দিতে চাই না তোমাকে আর। তোমার জন্য নিয়ে আসছি আমরা শহরভরা গণ্ডার, স্বামী-স্ত্রীর ঘরের পাশের কক্ষেই জ্যামিতিক হারে বাড়তে-থাকা মৃতদেহ। ব্যাখ্যা? না, কোনো ব্যাখ্যা নেই। নিজের নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতে পারো। নিয়ে এসেছি এমন বন্ধুদের, যারা কেউ কারো ভাষা বোঝে না। নাট্যকারদের একজন বললেন, নৈঃশব্দ্যই আমাদের একে-অপরকে বুঝতে সহায়তা করে। লেখায়-রেখায় ছড়িয়েছে সেই ভাষাহীনতার কথা। ভাষা না বোঝার কথা।
ভয়ংকর এই উপলব্ধি। যা নিয়ে আসে উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা। আর ক্লান্ত, ক্লান্ত করে। এই বাংলাদেশে মনে কেন যেন ভেসে ওঠে পুতুল নাচের ইতিকথা। মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়ে ডাঃ শশীও একসময় অসারতার অভিজ্ঞতা পায়। এই অনুভূতি এমন যে শশী উদাসীন হয়ে পড়ে, আর সে মগ্নমনষ্কতার উপেক্ষা সইতে সইতে একসময় কুসুম উপলব্ধি করে যে তার মন মরে গেছে, ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। আর বরিশালের আশ্চর্য কবিটিও সামনে চলে আসেন। তাঁর ব্যবহৃত শব্দযুগল ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিশ্চয় কয়েক হাজারবার উদ্ধৃত হয়েছে, আরও লক্ষবার আলোচিত হলেও পুরানো হবে না মনে হয়। কালো কমেডিকে বুঝতে-বোঝাতে এর চেয়ে উপযোগী দুটি শব্দ কে আনতে পেরেছেন আর! একই অনুষঙ্গে তাঁকে একদিন লিখতে হয়েছে পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের কথা। লিখতে হয়েছে
সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়---দ্বেষ
বিচ্ছেদের, বিভেদের, হিংসার অনুভবই কি মানুষের মন জুড়ে থাকে বেশি সময় এই ভাষাছাড়া দুনিয়াতে? বলা মুশকিল। বেদনায়ও আনন্দ যে মিশে থাকে এ কথা বলেছেন বহুজন। তাহলেও ভাবুক মানুষটিকে ঘিরে থাকে মনে হয় এই চিন্তাটিই---
... .... ... ... ... ... ... ... পথ নেই ব’লে
যথাস্থান থেকে খ’সে তবুও সকলই যথাস্থানে
রয়ে যায়---
ভাবুক মানুষদের মধ্যে মিল তো থাকেই ভুবনজুড়ে। মনে পড়ে যায় একদিন ফরাসি লেখক আঁরি বারবুস লিখেছিলেন, দেয়ার ইজ নো ওয়ে আউট অর রাউণ্ড অর থ্রু, তাঁর নরক উপন্যাসে। সকলই রয়ে যায় যথাস্থানে। নো ওয়ে।
এ লেখায় চেতনাপ্রবাহে চলে এলেন একে একে দেরিদা, ইয়েনেস্কো (নামোল্লেখ করা হয়নি), হ্যারল্ড পিন্টার (নামোল্লেখ করা হয়নি), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (নাম বলতে হবে কেন), জীবনানন্দ দাশ (নাম বলতে হবে কেন), আঁরি বারবুস।
ভাষা যদি বিভ্রান্তিকর, সাইলেন্সই যদি যোগাযোগের সম্ভাব্য মাধ্যম, যে যেমন সে তেমনই থেকে যায় বলে যদি মনে হতে থাকে, প্রকৃতি যদি হিংসা ও ক্রুরতারই অন্য নাম (এ মুহূর্তে এ কথাটি বড়ই প্রাসঙ্গিক : সুনামি-তে আক্রান্ত হয়ে এশিয়ার আটটি দেশের এক লক্ষ বিশ হাজারের বেশি লোক বীভৎসভাবে মৃত্যুবরণ করেছে বলে আজ ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪-এর শেষ খবরটিতে জানা গেছে, এ সংখ্যা আরো বাড়বে) তবে, ২০০৪-এ এসে ফিরে ১৯৩১ সালে উইল ডুরান্ট-এর করা প্রশ্নটিই ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছা করে লেখক, ভাবুক, সৃষ্টিশীল সকল মানুষের উদ্দেশে: আজও আপনারা আপনাদের সৃষ্টির বা কাজের প্রেরণা খুঁজে পান কোথা থেকে। জ্যোতির্বিদেরা তখন বলেছিলেন আর আজও বলছেন নক্ষত্রের কক্ষপথে আমাদের এই জীবন চকিত একটা মুহূর্তই মাত্র। ভূতাত্ত্বিকরা এখনও নিশ্চয় বলবেন যে, দুই হিমযুগের মধ্যবর্তী অনিশ্চিত এক ছেদ মাত্র আমাদের এই সভ্যতা। জীববিজ্ঞানীরা বলেছেন আমাদের গোটা অস্তিত্বটাই শুধু যুদ্ধ, দেশ জাতি, সংঘ বা ব্যক্তির পারস্পরিক গ্রাস শুধু। ঐতিহাসিকেরা সেই তখনই বলেছিলেন, প্রগতির ধারণা শুধু একটা মায়া, অনিবার্য ধ্বংসের দিকেই গড়িয়ে যায় সমস্ত গরিমা? আহা, কতই না সত্যি, বিশ্বাস্য মনে হয়! মনোবিদেরা জানিয়েছিলেন তখনই যে, আমাদের ইচ্ছাশক্তি কেবল পরিবেশ আর পরম্পরাচালিত! এখনও কি তাঁরা তা বলবেন না? অক্ষয় আত্মা বলে যাকে ভাবি সে কেবল মস্তিষ্কের ক্ষণিক স্ফূরণ---সেই ১৯৩১ সালেই এ কথা বলেছিলেন বিজ্ঞানীরা? কী অবাক! শিল্পবিপ্লব ধ্বংস করেছে আমাদের ঘর? করেছেই তো। প্রেম, সে কেবল শারীরিক সমীপতা? ছবি, মানে সিনেমা যা দেখছি, সাহিত্য যা পড়ছি, সকল মাধ্যম থেকে পৃথিবীর যা খোঁজখবর পাচ্ছি আজকালের তাতে তো তা-ই মনে হয়, প্রায় চুয়াত্তর বছর আগেও তা মনে হতো? উইল ডুরান্টের বক্তব্যে ফিরে যাই : ‘বিবাহ একটি সাময়িক কায়িক সুবিধা’? সন্দেহ তো হয়ই। শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকেই পাই: ‘গণতন্ত্রের পচন ঘটে গেছে, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নও লুপ্ত হবার পথে।’ লিখেছিলেন উইল ডুরান্ট, ১৯৩১ সালে! সত্যিই. বিস্মিত হতে হয়। ‘যে-কোনো আবিষ্কার শুধু শক্তিমানকে আরো একটু শক্তি দেয়, দুর্বলকে করে দুর্বলতর’? ঠিক, ঠিক। ‘যে-কোনো নতুন যন্ত্র বাতিল করে দিচ্ছে মানুষকে আর বহুগুণিত করে তুলছে যুদ্ধভয়’? একশো ভাগ সত্যি মনে হয়। আরো লিখেছেন ডুরান্ট সেই সেকালে : ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, কোনো দূরবীক্ষণ বা অণুবীক্ষণে আর পাওয়া যাবে না তাকে। জীবন মানে মানবপতঙ্গের বিস্তার শুধু, যেন গ্রহমণ্ডলের ক্ষত কিছুই নিশ্চিত নয় এখানে, একমাত্র পরাভব আর মৃত্যু ছাড়া। জীবন যেন এক ঘুম, যা থেকে জেগে উঠবার কোনো সম্ভাবনা নেই আর।’ উইল ডুরান্টের আগে কতজন জানি না, কিন্তু তারপর থেকে কত কত লেখকই না বলেছেন এসব কথা, প্রায় এমনই ভাষায়, কত কতবার।
‘তবে কি সত্যের আবিষ্কারই আমাদের সবচেয়ে বড়ো ভুল? জেনে ফেলাই কি আমাদের সর্বনাশ? মীমাংসাহীন এই সর্বনাশের মাঝখানে বেঁচে থেকে ওঁরা সৃষ্টির ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখেন কেমন করে---এই মনীষীরা--- এই ছিল নাকি ডুরান্টের প্রশ্ন, ১৯৩১ সালের জুন মাসে, শঙ্খ ঘোষের বাংলাঅনুসারে। (বস্তুত শঙ্খ ঘোষের লেখার মাধ্যমেই উইল ডুরান্টের চিঠি বিষয়ে প্রথম জানতে পারি, ডুরান্টের চিঠি থেকে এতখানি উদ্ধৃতির সুযোগ পাওয়া যায় এবং আমার এ রচনাটি লিখতে অনুপ্রেরণা পাই।)
এ প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল নিশ্চয় প্রশ্নকর্তারও। এই যে প্রশ্নগুলোকে এভাবে একের পর এক রচনা করে নিয়ে সাজিয়ে দেওয়া, সৃষ্টিশীল কিছু লেখার ইচ্ছা তাঁর না হলে কি তা সম্ভব হতো?
সবশেষের প্রশ্নটি এখানে আমার তা হলে এই : সৃষ্টিশীলতাই কি কেবল জাগিয়ে রাখতে পারে মানুষকে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে?
(প্রখ্যাত মার্কিন পণ্ডিত উইল ডুরান্ট প্রসঙ্গে তিনটি লাইন কেবল সংবেদী পাঠকের স্মৃতিকে সতেজ করে তুলতে : তাঁর জীবনকাল ১৮৮৫---১৯৮১, লিখেছেন ‘দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’ ১১ টি খণ্ডে, ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’, ‘দ্য গ্রেটেস্ট মাইণ্ডস অ্যাণ্ড আইডিয়াস অব অল টাইম’ প্রভৃতি অত্যন্ত সাড়াজাগানো বই।)
(রচনাকাল: ২০০৩)