প্রারম্ভিকাঃ
প্রকৃতি নির্ভর আদি কৃষি ব্যবস্থার পূর্বশর্ত হচ্ছে অবাধ পানি প্রবাহ। আর ঠিক সেকারণেই হিমালয় বিধৌত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রারম্ভ থেকেই থেকেই হয়ে উঠে কৃষি ভিত্তিক সভ্যতার পীঠস্থান। অনেক ঐতিহাসিকের মতে আসাম উপসাগরের হিমালয় থেকে বয়ে আসা পলিমাটি সমৃদ্ধ কৃষিকাজের অত্যন্ত উপযোগী সমভূমিতে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার বৎসর পূর্বে প্রথম কৃষি নির্ভর জনবসতির গোড়াপত্তন হয়। যা ছিল আর্যদের আগমনের অনেক পূর্বের ঘটনা। তাছাড়া ভারতে আর্য উপনিবেশ গঠনের সাথে এদেশের কৃষি উদ্ভবের কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়না। তবে আর্য ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর এদেশে আগমনের সাথে সাথে বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক বীজ ও ফসলের বিস্তার আবশ্যিক ভাবেই এদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল এবং এখনো করছে। তাছাড়া অত্যন্ত উপযোগী কৃষি জমি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে এদেশে বসবাসের এবং যার ফলশ্রুতিতেই কৃষি একটি বাণিজ্যিকিকরণ এবং প্রসার সম্ভব হয়েছে। তাছাড়াও অন্যান্য কৃষি ভিত্তিক সমাজের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের সাথেও রয়েছে এখানকার আদি ধর্মীয় রীতির সামঞ্জস্য। বেদে গোমাতার পবিত্রতা এবং তাকে দেবতা জ্ঞান প্রাচীন কৃষি ভিত্তিক চাষ ব্যবস্থারই প্রতিফলন। তাছাড়া মাতৃ বা নারী রুপে দেবতার আরাধনা কৃষি ভিত্তিক আদিম জীবন ব্যবস্থারই প্রতিরূপ। যেখানে ফসলী উর্বরা জমিকে প্রসব সক্ষম নারীর সাথে তুলনা করে একধরণের আধ্যাত্তবাদ গড়ে উঠে। নারী হয়ে উঠে শস্য ক্ষেত্রের রূপক। যার প্রভাব এখনো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
সত্য যুগের ভুপতি জনক করি ভুমি কর্ষণ,
কমলা রূপিণী তনয়া সীতার পেয়েছিল দর্শন।
দ্বাপরে দেখি আপনার কাঁধে বলরাম হল বহে,
কৃষি লক্ষীর সেবায় স্বর্গ মিলে, ঋষিগণ কহে।
খনার পরিচয়ঃ
সত্যিকার অর্থে খনাকে নিয়ে ঐতিহাসিক কোন প্রমাণাদি পাওয়া যায়না। খনা কে, কি তার আসল পরিচয় তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। লোকমুখে প্রচারিত বিশেষ করে সেই সময়ের বহুল সমাদৃত কথকরাই মূলত খনার বচনকে লোকমুখে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রবাহিত করেছে দিক থেকে দিকে। আর যেহেতু খনার বচন বাস্তব জীবনের বহু সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে ব্যবহৃত হতো তাই সেগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে অনেক এবং যুগ যুগ ধরে লোকমুখে টিকে রয়েছে কিংবদন্তী খনা। প্রচলিত লোককথা অনুসারে, রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার জ্যোতির্বিদ বরাহ তার নিজের সদ্যোজাত ছেলে শিশুর ভবিষ্যৎ গণনা করে সন্তানের অকাল মৃত্যুর কথা জানতে পারেন এবং একটি কাঠের বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন এই আশায় যে সমর্পনের মাধ্যেমে ঈশ্বরের আশীর্বাদে হয়তো সন্তানটি বেঁচে থাকবে। ঠিক সেই সময়েই লংকা দ্বীপে জন্ম নেয় এক রাজকন্যা যার নাম লীলাবতী। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে লীলাবতীর জন্মের পরপরই সে রাজ্যে রাক্ষসরা আক্রমণ করে এবং রাজা রাণীকে হত্যা করে। অতঃপর সেই রাক্ষসদের আশ্রয়েই বেড়ে উঠে লীলাবতী যে রাক্ষসরাই সাগর মোহনা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল জ্যোতিষ পুত্রকে। তারা দুজন একই সাথে বড় হতে থাকে। নাম পরিচয়হীন জ্যোতিষ পুত্রের সাথে লীলাবতীর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং লীলাবতী জ্যোতিষ পুত্রের নামকরণ করে মিহির। এবং বড় হয়ে তারা দুজনেই বিভিন্ন শাস্রে পান্ডিত্য লাভ করে।
একসময় লীলাবতী ও মিহির দুজনেই রাক্ষসদের কবল থেকে পালানোর সুযোগ খুজতে থাকে এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র গণনা করে পালানোর নিরাপদ সময় বের করে এবং সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে পদার্পণ করে। জ্যোতিষ শাস্ত্র গণনা করে তারে আরো জানতে পারে মিহির হচ্ছে রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ জ্যোতিষী বরাহের পুত্র। লীলাবতী ও মিহির দুজনে বরাহের কাছে যান এবং মিহিরকে পুত্র হিসেবে গ্রহন করার জন্য রাজ বরাহকে অনুরোধ জানান। বরাহ অতীত ঘটনা স্মরণ করে সানন্দে মিহিরকে গ্রহন করে এবং লীলাবতীতে পুত্রবধূর মর্যাদা দান করে। ধীরে ধীরে লীলাবতী জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাথ পাণ্ডিত্যের কথা লোক মুখে রটে যায়। পরবর্তীতে লীলাবতী রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় আমন্ত্রিত হন এবং রাজ জ্যোতিষী বরাহের স্থলাভিষিক্ত হন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন লীলাবতীর শশুর মিহিরের বাবা প্রাক্তন রাজ জ্যোতিষী বরাহ। গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকে লীলাবতীর ক্ষতি সাধন করার। এবং ছেলে মিহিরকে নানা কু-মন্ত্রণা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে লীলাবতী মিহিরের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং একসময় প্রচন্ড ক্রোধে মিহির লীলাবতীর জিহ্বা কেটে তাকে বোবা করে দেয়। ওড়িয়া ভাষায় খনা অর্থ বোবা। যা পরবর্তীতে খনার বচন বা বোবার বচন হিসেবে লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকে।
খনার বচনঃ
মূলত কৃষি উৎপাদন এবং প্রকৃতি ভিত্তিক বিভিন্ন উপদেশই খনার বচনের মুল উপজীব্য। তাছাড়াও বর্ষপঞ্জী, জ্যোতিষ গণনা, বিধি নিষেধ, স্বাস্থ্য সহ নানা পরিসরে রয়েছে খনার বচনের ব্যাপ্তি। নিচে আমরা কয়েকটি কৃষিভিত্তিক বচন ও তার অর্থ জেনে নেই।
কলা রুয়ে না কেট পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
অর্থঃ কলাগাছের পাতা না কাটলে তাতে কলার ফলন ভালো হয়।
নারিকেল গাছে নুনে মাটি, শীঘ্র শীঘ্র বাধে গুটি।
অর্থঃ নারিকেল গাছের গোড়ায় লোনা মাটি দিলে নারিকেলের ফলন ভালো হয়।
হাত বিশেক করি ফাঁক, আম কাঠাল পুতে রাখ।
অর্থঃ বিশ হাত ফাঁক করে আম কাঁঠাল গাছ না বুনলে গাছে ভালো ফল আসেনা।
ডাক দিয়া বলে মিহিরের স্ত্রী শোন পতির পিতা,
ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।
রাজ্য নাশ গো নাশ হয় অগাধ বান,
হাতে কাঠা গৃহী ফিরে কিনতে না পায় ধান।
অর্থঃ ভাদ্র মাসে ভুমিকম্প হওয়া বড় বন্যা এবং ফসলের দারুণ ক্ষতির লক্ষণ।
শুক্লপক্ষে ফসল বুনে, ছালায় ছালায় টাকা গুনে।
অর্থঃ চাঁদের শুক্লপক্ষে ফসল বুনলে ফলন ভালো হয়।
আষাঢ় শ্রাবণে টুটে পানি, তার মর্ম পাছে জানি।
অর্থঃ আষাঢ় শ্রাবণ মাসে বর্ষা কম হলে পরে বন্যা হয়।
মানুষ মরে যাতে, গাছলা সারে তাতে।
পচলা সরায় গাছলা সারে, গোধুলা দিয়ে মানুষ মারে।
অর্থঃ যে স্থান মানুষ বাসের অযোগ্য সে স্থানে গাছ ভালো হয়। পচা দুর্গন্ধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও গাছের জন্য তা উপকারী।
বাপ বেটায় করবে চাষ, তাতে পুরবে মনের আশ।
অর্থঃ নিজের আত্নজ ব্যাতিত সম্পূর্ণ অন্যের উপর চাষের ভরসা করলে চাষাবাদের ক্ষতি হয়।
ক্ষেতের কোনা, বাণিজ্যের সোনা।
অর্থঃ কৃষিকাজ বাণিজ্যের থেকে উত্তম।
কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, বাঁশ করে টাস টাস।
অর্থঃ সময়ের চাষ সময়ে না করলে ফসল অনিশ্চিত।
সাত হাত তিন বিঘতে, কলা লাগায় মায়ে পুতে।
অর্থঃ সাত হাত পর পর তিন বিঘা গর্ত খুড়ে কলাগাছ লাগাতে হয়।
খনা বলে চাষার পো, আশ্বিনের শেষে সরিষা রো।
অর্থঃ আশ্বিন মাসের শেষে সরিষা বনতে হয়।
ষোল চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা
তার অরধেক ধান, বিনা চাষে পান।
অর্থঃ মুলাতে সবচে বেশী চাষ দিতে হয় আর চাষ ছাড়াই পান উৎপাদন করা যায়।
গাই দিয়া বায় হাল, দুঃখ তার চিরকাল।
অর্থঃ গাই দিয়ে হাল বাইতে হয়না।
কচু বনে ছড়ালে ছাই, খনা বলে তার সংখ্যা নাই।
অর্থঃ ছাই কচুগাছের জন্য উপকারী।
হয়তো খনা কোন একক নারী অথবা মাতৃ রুপে আমাদের আবহমান কৃষি ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক। হতে পারে যে কোন কিছুই তবে, খনার বচন শুধু বাংলার কৃষি প্রবাদই নয় বরং আমাদের খনার বচন আমাদের লোকজ ভাষা, আমাদের লোক সাহিত্য, আমাদের কৃষ্টি, অভিজ্ঞতার ছন্দবদ্ধ প্রয়োগ, আমাদের ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি একটি সমৃদ্ধ বিজ্ঞান।
(চলবে , , , , , )
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
খনা ও খনার বচন নিয়ে ইশতিয়াক আহমেদ চয়ন ভাইয়ের একটি চমৎকার পোষ্ট -
খনা : এক ক্ষণজন্মা কিংবদন্তীর দুঃখগাথা