দেশলাই কাঠি
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন—
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাত্
আমি একাই— ছোট্ট একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন—
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে—
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।
আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছো বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে, গ্রামে— দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়—
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব—
সবাই— শেষবারের মতো!
কবিতাটা প্রথম শুনেছিলাম তিন থেকে চার বছর আগে আমার অনেকদিনের নেটবন্ধু ও একসময়ের কোচিং টিচার কল্লোল ভাইয়া(সংক্ষেপে কে.বি)’র মুখে।ওই একবারই।শোনামাত্রই অদ্ভুতরকমের আপন মনে হয়েছিল কবিতাটাকে।ঠিক যেন আমার নিজের মনের কথা।
অনেকের ভাষ্যে আমিও একটা দেশলাই কাঠি।হয়তবা সবাই সামনা সামনি এই উপাধি দেবেনা কিন্ত,কথা বার্তায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে।যেখানেই যাও,যেভাবেই বেড়াও ওই একই কথা।আম্মুর অফিসে যাও,যাওয়া মাত্রই –এতো শুকাইছো কেন? (আরে ভাই,মোটা ছিলাম কবে?)দেড় বছর আগের কথা।মায়ের তখন ক্যান্সার।ঢাকায় অপারেশনের পর বায়োপসি রিপোর্ট পেয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছি সিঙ্গাপুরে।বেচারির শরীরটা হয়ে গিয়েছিল একেবারে স্কুলে যাওয়া মেয়েদের মত।হোটেলের ক্লিনার মেয়েরা আসলো রুম সার্ভিস করতে। রুমে আমি আর আম্মু।একজন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন-you come to see the doctor?আমি মাথা নাড়তেই তার প্রশ্ন-who’s sick?আমারতো পুরোই আক্কেল গুড়ুম।আম্মুর পাশে আমারে রোগী মনে হয়,সর্বনাশ!
পাশ করার পর প্রায় দু’বছর ধরে সিভি লিখতে লিখতে হাতে,কাঁদতে কাঁদতে চোখে এবং বসে বসে বিডিজবস ঘাটতে ঘাটতে অন্যকোথাও প্রায় যখন ঘা হয়ে যাবার অবস্থা তখন পেলাম আমার অতি প্রত্যাশিত বন্ত।চাকরী।সেখানেও একই অবস্থা।টিফিন করছি সেইসময়-‘আলিয়া এত্তো খায়(আল্লাই জানে আমি কবে এত্তো খেলাম।খেতে তো ইচ্ছেই করেনা,একটু খেলেই পেট ঢাপুস) তবুও ওর গায়ে লাগেনা কেন? লাঞ্চ করছি।–ম্যাডাম,বেশি করে খান,নাহলে পাত্র এসে বলবে ,পাত্রীর সবই ভালো শুধু ---(এক্সকিউজ মি,আমি কি কোনোদিন বলেছি আমি সিঙ্গেল?!)
গতমাসে গিয়েছি ডাক্তারের কাছে।রিপোর্ট পাবার পর ডাক্তার কহিলেন-“ইঞ্জিনিয়ার?!!! কে ওকে দেখে বলবে ইঞ্জিনিয়ার???মেয়ে বিয়ে দেবেন না?খাওয়ান বেশি করে। ইঞ্জিনিয়ারদের কি বিয়ে হয়না নাকি?” সেই সাথে আরও কিছু উপদেশ যা ্রোগীকে আরও দূর্বল করে দিতে যথেষ্ট।ডাগদর মেডামের উপদেশ শুনে রাগেই মনে হয় শরীরটা ঠিক লাইনে আইসা পড়লো আবার(আলহামদুলিল্লাহ।বাবা শরীর,আর ঝামেলা করিস না)
যাহোক,আবার আসা যাক কবিতা প্রসঙ্গে।শবে বরাতের রাঁতে ছ’বছরের এক দেবশিশুর উপর নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে জুয়েল নামে টঙ্গীর এক নিকৃ্ষ্ট জ়ীব।উল্লেখ্য,ওই হারামী আগেও ৫ বছরের এক মেয়ে শিশুকে হত্যা করেছিল এই একই কায়দায়।আবার সেই রাতেই ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে জনগন হত্যা করেছে ছয় ছাত্রকে যাদের নামে কিনা কোনো মামলাই ছিল না।খবরটা দেখে আম্মু বলেছিল-উত্তেজিত জনগন আসলেই ডেঞ্জারাস।তাকে প্রশ্ন করেছিলাম-এই উত্তেজিত জনগন জুয়েলের বেলায় কই ছিল?তাকে তো পিটিয়ে থানায় দিল দু’দিন পর বেরিয়ে আবার আকাম করার সুযোগ দেবার জন্য।আম্মু বললেন-ওই যে,ব্যক্তিস্বার্থ!আর আসল ডাকাত দেখ গে ঠিকই ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে।পারে সব নিরাপরাধ লোকজনের সাথেই।
রাঁতের বেলা এসব হাবিজাবি ভেবে ঘুম আসছিলনা।তখনই আবার মনে পড়লো কবিতাটির কথা।চোখ থেকে নোনতা মতন কি জানি একটু গড়িয়ে পড়লো।নাহ,বন্ধুগন,যত যাই বলেন আমি কিন্ত এখনও দেশলাই কাঠি হতে পারিনি। তবুও স্বপ্ন দেখি এখনও ‘বেরিয়ে পড়ব, ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে, গ্রামে— দিগন্ত থেকে দিগন্তে’।অপেক্ষায় থাকি সেই দিনটার যেদিন আমি জ্বলে উঠব আনেকের সাথে কিংবা একাই, ‘প্রথ্মবারের মত।‘