রাত্রে ঘুমাইনি, ঘুমানোর পরিকল্পনাও ছিলোনা। বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিলো, কুয়াশার বৃষ্টি। বৃষ্টি টা উপভোগ করবো ভেবে খুব সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভোর ৬ টার দিকে শাহবাগের দিকে গেলাম একটা রিকশায়... এরপর হেটে হেটে ফাঁকা শহরে অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, ভালোই লাগছিলো... শাহবাগ, কাকরাইল, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আজিমপুর এসব এলাকা হেটে যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছি তখন পিছন থেকে একজন রিকশাচালক এসে আমার পাশে দাড়ালেন।
আজিমপুর বাসস্টান্ডের খুব কাছের একটি জায়গা। লোকটি বয়সে মুরুব্বি, অনেকটা আমার দাদা’র মতো দেখতে। শুদ্ধ ইংরেজিতে আমায় বললেন, ‘Where do you want to go, sir?’ উনার মুখে ইংরেজি শুনে আমি অবাক হলাম একটু, আগে কখনো একজন রিকশাচালকের মুখে ইংরেজি শুনিনি আমি। ভাবলাম উনি হয় এই ইংরেজি টা কারো কাছ থেকে শুনে মুখস্ত করেছেন, সেটিই আমার কাছে বলছেন। আমি একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম, ‘I wanna go Shahbag’। উত্তর এলো ‘Ok Sir, seat on my rickshaw!’এবার অবাক হওয়ার পালা আরোও একটু বাড়লো। এরপর আমি ইংরেজিতে যতগুলো প্রশ্ন করলাম তার সবগুলো উত্তরই পেলাম ইংরেজিতেই। নির্ভুলভাবে, নেটিভ স্পিকারদের মতো!
উনার রিকশায় উঠে বসলাম, ইংরেজিতে বললাম আমার আসলে কোন কাজ নেই এখন, ভবঘুরের মতো এদিক সেদিক একটু ঘুরতে চাই। আপনি আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে যান। উনি আমাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরলেন। উনাকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো, বললাম চলুন আপনাকে নাস্তা করাই। রাজি হচ্ছিলেন না, অনেকটা জোর করেই একটা দোকানের সামনে দাড় করালাম রিকশা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের একটি দোকান। এরপর আলাপচারিতা বাড়তে বাড়তে তিনি আমার সঙ্গে অনেক কাছের মানুষের কথা বলতে থাকলেন। ‘নানুভাই’ সম্বোধন শুরু করলেন।
যাত্রা আবার শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন রাস্তায়ই তখন আমরা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরছি। এবার শুনলাম তার জীবনের করুণ কাহিনী। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে, একসময় গার্মেন্টসের ব্যবসা ছিলো। দূর্ভাগ্যক্রমে সে ব্যবসায় মন্দা যায় কয়েকবছর ব্যবসা করার পর, মূলধন খুইয়ে ফেলেন। অবশিষ্ঠ সবকিছু বিক্রি করে দেন তিনি। সে টাকায় পাড়ি জমান প্রবাসে। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো, বিপত্তি বাধে কোন এক সড়ক দূর্ঘটনায়। সে দূর্ঘটনায় তাঁর সঙ্গী সবাই মারা যান, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান, যেটির চিকিৎসায় খরচা হয়ে যায় জমানো সঞ্চয়ের প্রায় সব টাকাই! নি:স্বপ্রায় হয়ে দেশে ফেরেন, বেকার হয়ে পড়েন।
পারিবারিক প্রসঙ্গ জানতে চাইলাম, বললেন আমার একজন ভাই ইঞ্জিনিয়ার, বোন ডাক্তার। তবে পারিবারিক সম্পর্কটা এখন খুব হালকা, যোগাযোগ নেই কারো সঙ্হেই। ছেলে বিবিএ পড়ছেন, মেয়েও স্নাতকে। বিয়ের সময় হয়ে গেলেও আর্থিক অনটনের কারণে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। সামনে ছেলের সেমিস্টার পরীক্ষা, টাকা দিতে পারছেন না বলে পরীক্ষাটাও হয়ত দেয়া হবেনা তার।
ব্যবসায়ী থাকাকালীন সময়ে বেশ কয়েকজনকে আর্থিক সহায়তা করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তারা এখন লাখপতি, তবে চেনেননা তাঁকে। ভদ্রলোক ইংরেজিতেই অনেক কিছু বললেন আমাকে। সারমর্ম এমন, বুঝতেই তো পারছ নানুভাই, একটা মানুষ কতটা আর্থিক অনটনের মধ্যে না পড়লে রিকশা নিয়ে পথে নামে! আমি অসহায় হয়েই, বাধ্য হয়েই এ বয়সে রিকশার প্যাডেল ধরেছি। ইচ্ছা ছিলো আর কিছু না পারি একটা সিএনজি কিনে নিবো, অন্তত আরোও একটু ভালোভাবে চলতে পারবো, জীবনের শেষদিনগুলো আরেকটু ভালোভাবে পার করতে পারবো। তবে সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না, তাই এভাবে প্যাডেল আমাকে ধরতেই হলো।
আরোও অনেক কথা শুনলাম ভদ্রলোকের কাছ থেকে। শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে এলো। নিজের কাছে খারাপ লাগছিলো এমন একজন মানুষ আমার মতো অধম কে রিকশায় করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন! উনাকে রিকশা থামাতে বললাম। ‘আপনার রিকশায় চড়ে নয়, আপনাকে আমি আজ নিজে রিকশা চালিয়ে শহর ঘোরাবো, প্লিজ আমায় নিষেধ করবেন না!’ বললাম উনাকে। উনি কোনভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। ভাবতেই পারছিলেন না একজন প্যাসেঞ্জার, যে কিনা কয়েক ঘন্টা আগে তারসঙ্গে পরিচিত, সে তাঁকে রিকশায় করে শহর ঘোরাবে! আমি উনাকে আস্তে করে বললাম, আপনি হয়ত এটাকে পাগলামি মনে করছেন, তবে বিশ্বাস করুন, আপনাকে যদি আজ আমি রিকশায় করে শহর ঘোরাতে পারি, অন্তত তা কিছু সময়ের জন্যও তাহলে নিজের কাছে খুব ভালো লাগবে, শান্তি লাগবে। উনি কিছু বললেন না, রিকশার প্যাডেল ধরলাম। ফাঁকা রাস্তায় এটি চলতে শুরু করলো।

ভালোভাবে প্যাডেল ধরতে পারছিলাম না, এ নিয়ে প্রথম দিকে উনি খুব হাসলেন। হাসির মাঝেই ধীরে আমিও অনেক পথ এগিয়েছি রিকশা নিয়ে। এরপর পিছন থেকে কোন শব্দ পাচ্ছিলাম না। কৌতুহল হলো, সামনে পথটা দেখে নিয়ে তাই আড়চোখে পিছে তাকালাম, দেখলাম ভদ্রলোকের দু’চোখ পানি তে ছলছল করছে। আমার মন টা আরোও খারাপ হয়ে গেলো। একটু পর ফোপানির হালকা শব্দও শুনতে পেলাম। তবে না, যতক্ষণ রিকশা চালিয়েছি ততক্ষণ উনার সে চোখে আর তাকানোর সাহস পাইনি। কান্নার শব্দ শুনেও না!
---------------------------------------------------------------------
লেখাটি ঢাকার রাজপথে: দিবালোকের আরব্য রজনী শিরোনামে বাংলানিউজে আজ প্রকাশিত হয়েছে, অনুমতি নিয়ে সামুতেই এর আগে প্রকাশ করেছেন জনপ্রিয় ব্লগার মাহমুদুল হাসান কায়রো ভাই। অসংখ্য মানুষের ইমেইল পেয়েছি, ফোন পেয়েছি। যারা মেইল করেছেন তাদের ধন্যবাদ। অনেকে 'রিকশাওয়ালা নানাভাই' কে সহায়তা করার কথা বলেছেন। তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি উনাকে দেখা করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবো।