বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগে এই মুহূর্তে চলছে মহাসমাবেশ। কতিপয় উৎসাহী ব্লগার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে একটি ছোট্ট ব্যানারসহ শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। গত মঙ্গলবার সেই কতিপয় ব্লগারের অতি উৎসাহ এখন মিডিয়ার কল্যাণে সারা বাংলাদেশের মানুষের জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে শাহবাগ স্কয়ার পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সমস্ত টিভি মিডিয়া এই জনসমুদ্রকে কাভারেজ দিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এই ঘটনা খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এটিএন নিউজের হেডঅফনিউজ মুন্নী সাহা। কেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই ঘটনাকে গুরুত্ব দেননি? হয়ত কারণ এই, তারা মনে করেছেন এটি কোনও আন্দোলন বা বিক্ষোভের চিত্র নয়। হয়ত তারা মনে করেছেন এটি বৈশাখী মেলা টাইপের কোনও গনসমাবেশ। অথবা এটিও হতে পারে সমাবেশ থেকে আন্দোলনকারীরা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে...যা ওইসব মিডিয়ার কাছে চরম ঘৃণ্য সাজা এবং আদর্শবিরোধী। তবে মুন্নী সাহা ওই খেদ লাইভ সম্প্রচারে প্রকাশ না করলে আমরা হয়ত জানতাম না বিশ্বমিডিয়া এতো বড় গণজাগরণকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছে। মুন্নী সাহা কি এক অর্থে ক্ষতিই করলেন তবে?
সমাবেশে আগত মানুষদের সবাই একমনা এই কথা দাবি করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। তবে তাদের দাবি একটিই সেটি মোটামুটি স্পষ্ট ছিল আজকের দিন পর্যন্ত। রাজাকারের ফাঁসি চাই। ধীরে ধীরে রাজাকার থেকে নামটিও স্পষ্ট হলো...বোধয় লাকী নামের একটি পিচ্চি মেয়েই নামটিকে ছন্দোবদ্ধভাবে বলার সাহস প্রথম করলেন...ক-তে কাদের মোল্লা...তুই রাজাকার। ধীরে ধীরে একটি দাবির স্থলে যোগ হলো আরও বেশকিছু দাবি। জামায়াত নিষেদ্ধের দাবি, শিবির নিষিদ্ধের দাবি, জামায়াত-শিবির পরিচালিত ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি....সবসহ ৭১টি দাবি তাদের মুখে উচ্চারিত হলো। এতে কি 'রাজাকারের ফাঁসি চাই' দাবিটি কিছুটা দূরে সরে গেলো না? একপর্যায়ে মুন্নী সাহা আন্দোলনকারীদের কিছুটা ডিমোরালাইজইকি করলেন? তিনি বললেন ফাঁসিতো আর দুয়েকদিনে কার্যকর করা সম্ভব না, এটিতো একটি আইনী প্রক্রিয়ার ব্যাপার, এটিতো আপনাদের আবেগের দাবি, তো আপনারাতো আর ততোদিন রাজপথ দখল করে থাকতে পারবেন না...তো সেই অর্থে আপনারা আন্দোলন থেকে বা রাজপথ ছাড়বেন কখন?....এই টাইপের একটি প্রশ্ন তিনি করলেন একজন আন্দোলনকারীকে। অর্থাৎ আমরা বুঝে গেছি মুখে ওরা যতোই বলুক ফাঁসি ছাড়াই ওদের ঘরে ফিরতে হবে...সেই চ্যালেঞ্জই দিয়ে দিলেন মুন্নী। কিন্তু যতোটা সহজে ঘরে ফেরার সম্ভাবনা তারা আশা করেছিলেন তা কিন্তু হয়নি। যারা ভেবেছিলেন মহাসমাবেশের পর কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে শাহবাগ মোড় ছেড়ে যে যার মতো ঘরে ফিরে যাবে তাদের সে ভাবনা সত্যি হলো না। মানুষ শাহবাগ ছেড়ে যায়নি। সহসা যাবে বলেও মনে হয় না।
এতো লোক দেখে সরকার ও কিছু বাম নেতা নিজেদের হিরো বানাতে সেই লক্ষ্যজনতার মঞ্চে উঠে এলেন। যারা এলেন তাদের ভক্ত সংখ্যা থাকলেও জনপ্রিয়তা নেই মোটেও। যেমন জাফর ইকবাল। তার অসংখ্য ভক্ত আছে। আমি নিজেও তার ভক্ত....তার লেখা পড়তে আমি ভীষণ পছন্দ করি কিন্তু তার মতাদর্শ? ঠিক ততোটাই ঘৃণা করি। কিছু মানুষ এলেন সেই জনতার মঞ্চে যারা চরম নাস্তিক হিসেবে সমাজে পরিচিত। এলেন আওয়ামী লীগের সিলমারা কিছু মানুষ। আআমস আরেফীন সিদ্দিক, কিংবা ড. আনোয়ারকে কেউ কি ভাবেন তারা নিরপেক্ষ লোক? অর্থাৎ জনতার মঞ্চ চলে গেলো ক্ষমতাসীন লোকদের দখলে। আর কিছু লোক, যারা এতোলোক কোনওদিন নিজেদের সমাবেশে আনতে পারেননি সেই মুটে-মজুরের দল বাম নেতারা এলেন পতাকা নিয়ে...দলের প্রচারণার এর চেয়ে মোক্ষক সুযোগ আর নেই। তারা কেউ কেউ শাহবাগের এই জনতার মঞ্চ দখল করতে পাঠালেন তাদের নারী সদস্যদের। উদিচীসহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন দখল করে নিল মাঠ। একে এক ব্লগাররা সরে গেলো মাঠ থেকে। যাদের দাবি ছিল রাজাকারের ফাঁসি চাই। যাদের প্রচ্ছন্ন দাবি ছিল যদি প্রমাণই হয় রাজাকার, তবে তার ফাঁসিই চাই...অন্য কিছু নয়...এর আরেকটি অর্থ কিন্তু ভিন্ন।
ধীরে ধীরে দাবিনামায় যুক্ত হলো এমন কিছু দাবি যা একান্তই আওয়ামী লীগের, একান্তই বামদের এবং একান্তই ইসলামের শত্রুদের। ফলে কার্যত সরে গেলো যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। কেউ কেউ বললেন জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে বিচারের মাধ্যমে কাদের মোল্লা ও জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিতে হবে। এসব দাবি যদি বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দূরে থাক তাদের বিচারকাজই ভেস্তে যাবে। আবার নতুন আইন, নতুন ট্রাইব্যুনাল (কারণ এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে এই ট্রাইব্যুনাল তারা মানে না, ট্রাইব্যুনাল তাদের আস্থা হারিয়েছে), নতুন করে শক্ত-পোক্ত তদন্ত ইত্যাদি নতুন করে করতে গেলে যে সময় লাগবে তা হয়ত জামায়াত তাদের কে দেবে কিন্তু দেশবাসী ততোদিন এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখবে না। আজকের মহাসমাবেশ দেখে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এই ট্রাইব্যুনালের কোনও রায়ই মানুষ গ্রহণ করবে না। এবং গণমানুষের দাবি থাকলেও আবেগের দ্বারা কোনও ট্রাইব্যুনাল চলতে রাজি হবে না। অর্থাৎ গণমানুষের দাবি যদি হয় একমাত্র ফাঁসি, তাহলে বিচারালয়ের কোনও দরকার নেই, তদন্তের কোনও দরকার নেই, প্রসিকিউশনের দরকার নেই, সাক্ষী-জবানবন্দী দরকার নেই। তার মানে কি বাংলাদেশকে একটি বেআইনি দেশের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিচার মানি তালগাছ আমার...টাইপের দেশ হতে যাচ্ছে?
সবমিলে বিচারব্যবস্থার ওপর এতো বড় আঘাত এই প্রথম এলো। বিচারব্যবস্থার প্রতি এমন আস্থাহীনতা এতো মানুষ এমন তীব্রভাবে এর আগে কখনও প্রকাশ করেছে এমন নজির আছে বলে আমার মনে হয় না।
এতে কে লাভবান হলো? জামায়াত? না অন্য কেউ? বাংলাদেশের আইসিটিকে সারাবিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করলো কারা? এই জনসমুদ্র নয়কি?
আমিও চাই রাজাকারের ফাঁসি হোক। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হোক। দেখি আইন কীভাবে তাকে ফাঁসি দেয়...একজন চোখে দেখা সাক্ষীও নেই তার বিরুদ্ধে। একজনও লোকও বলতে পারেনি তাকে খুন করতে দেখেছে। সবাই বলছে সে অমুকের কাছে শুনেছে, অমুক তমুকের কাছে শুনেছে। আইনে এর ভিত্তি নেই। তবু বিচারকরা যে কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন সেই ক্ষমতা আইসিটি আইনে দেয়া আছে। এবং সেই সিদ্ধান্ত উভয়পক্ষ মানতে বাধ্য হবে। আর সেই রায় দিয়ে ফেলেছে আদালত। সুতরং হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ার চান্স নেই। তাহলে সমাধান কি? সমাধান আছে বেআইনী প্রক্রিয়ায় কাদের মোল্লাকে গণধোলাই বা অন্যভাবে হত্যা করা। তাহলেও কি বসে থাকবে জামায়াত-শিবিরেরে জানবাজ লক্ষ লক্ষ কর্মী? আর তা হলেওতো জামায়াতেরই লাভ। তারা বলতে পারবে আইন তাদের অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি, তাই বেআইনীভাবে হত্যা করেছে।
এবার আসি এই জনসমুদ্র জনসমুদ্র নাকি সামান্য কিছু। এটি নি:সন্দেহে জনসমুদ্র। তবে সবার দাবি আর মঞ্চে ঘোষিত দাবি কিন্তু এক নয়। এর চেয়ে বেশি লোক হয় তাবলিগ জামাতে। তারা চায় আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর শাসন। তারা চায় কোরআনের অনুশাসনে দেশে শান্তি আসুক। কিন্তু তাদের সেই দাবি কি কখনও পূরণ হয়? আজকের এই জনসমুদ্রের চেয়ে বেশি মানুষ জড়ো করতে পারবে জামায়াত, তাহলেকি তাদের দাবি পূরণ হবে?
না
দাবি পূরণের জন্য বিশাল গণজমায়েত কোনও ভালো রাস্তা নয়। দাবি আদায়ের জন্য চাই কৌশল। আর মিডিয়ার প্রচারণায় এভাবে বানের জলের মতো ভাসতে ভাসতে লক্ষ লক্ষ লোক এসে যদি শাহবাগ কেন পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে যায় তবু দাবি পূরণ হবার নয়। কারণ আইনের কাছে আবেগ নয়, আন্দোলন নয় আইনই সবচেয়ে বড়।....আর আইন যদি আবেগের কাছে হেরে যায় সেই আইনকে কেউ কোনদিন মান্য করবে না। তখন সবাই যে যার মতো আইন হাতে তুলে নেবে আর মহাসমাবেশ করে জায়েজ করে নেবে নিজেদের অপরাধ।
ধরা যাক, কাদের মোল্লার ফাঁসির জন্য এই গণজমায়েত। ফাঁসী হলো। তারপর জামায়াত রাস্তায় নামবে কাদের মোল্লাকে ফিরিয়ে দাও....নয়ত পল্টন ময়দান বা বায়তুল মোকাররম আমরা ছাড়ব না....যদি জনদাবির কারণে ফাঁসি দিতে পারো, তাহলে জনদাবির কারণে মৃত মানুষকে জীবিতও করে দিতে হবে....কী করবে বিচারবিভাগ?...পারবে প্রায় ৫০লাখ জামায়াত-শিবিরকর্মীর দাবি উপেক্ষা করে রাজপথ মুক্ত করতে?...সম্ভবত এভাবেই দেশে গৃহযুদ্ধের পথ উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে....
যা-ই ঘটুক তাতে জামায়াতের কোনও লস বা পরাজয় আছে বলে আমার মনে হয় না। ওরা কখনও ক্ষমতায় আসেনা ক্ষমতার স্বাদও পায় না...রাজপথে লড়তে লড়তে ওরা জীবন দেয়, আর এই জীবন দেয়াতেই ওদের সুখ....কারণ পরপারে আছে জান্নাত!......
অতএব শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে যারা ভাবছেন এ নিয়ে জামায়াত খুব চিন্তিত...আমার কিন্তু মনে হয় উল্টোটাই। আপনরা লক্ষ্যজনতা সায় দিচ্ছেন জামায়াতের দাবি বিচারবিভাগের অস্বচ্ছতা, আপনাদেরও দাবি প্রমাণ করে বিচারবিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা।....