somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রায়ের সময় কাদের মোল্লার চেহারা কেমন ছিল?

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আদালতকক্ষে ঢুকেই ইতিউতি খুঁজছিলাম মোল্লা সাহেবকে। বহু বছর আগে একবার সামনাসামনি দেখেছি, মোবাইল ফোনে কথাও বলেছি। কিন্তু আবার দেখতে ইচ্ছে করছে এখন। জনাকীর্ণ আদালতকক্ষ বলতে যা বোঝায় সেরকম ছিলোনা, এটির পরিবেশ। তবে বসবার বেঞ্চগুলো একেবারেই ভর্তি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর লাস্ট বেঞ্চে একটু জায়গা হলো। তখনো আমার চোখ মোল্লা সাহেবকে খুঁজে যাচ্ছে। সিনেমায় অনেক দেখেছি, কিন্তু বাস্তবের একজন যুদ্ধাপরাধী, যার বিরুদ্ধে রয়েছে শত শত হত্যা, বহু ধর্ষণের অভিযোগ, নিজের হাতে নাকি সে মানুষ জবাই করতো, সে যখন নিজের শেষ পরিণতি জানবে, সেই মুহুর্তে সে কি আচরণ করবে, জানতে ইচ্ছে করছে।
দশটা তেতাল্লিশ মিনিটে তিন বিচারপতি যখন এজলাসে প্রবেশ করলেন, তখন আমার পেছন থেকে কর্কশ (আমার কাছে কর্কশই লাগলো শুনতে) গলায় কেউ চিতকার করে উঠলো, জাজ সাহেব আমার কিছু বলবার আছে। সাথে সাথেই ঘাড় ঘুরালাম আমি। আমি যে বেঞ্চটিতে বসেছি, তার ঠিক পেছনেই একটা কাঠগড়া। সেখান থেকেই ভেসে আসছে মোল্লা সাহেবের উদ্ধত চিতকার। আমি একটা বেকুব! চারিদিকে খুঁজেছি, শুধু নিজের পেছনেই তাকাই নি।
বিচারকরা অবশ্য মিস্টার মোল্লাকে থামিয়ে দেন। তারা পড়া শুরু করেন ৩৫ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশ। রায়ে মণযোগ দিতে পারছি না। আমার শুধু ঘাড় ঘুরে যাচ্ছে পেছনের দিকে। গোল্ডরিমের চশমার ফাঁকে মোল্লা সাহেবের চোখ লাল। পলক পড়ছে না। আমার চোখে তার চোখও পড়ছে দু-একবার। মনে হলো একটুও বিচলিত নন তিনি।
রায় পড়া চলছে। এমন সময়ে আদালত কক্ষে একজন বোরকায় ঢাকা মানুষ ঢুকলো। মনে হলো বয়সে তরুনী হবে। চোখ আর মুখের কিছুটা দেখা যাচ্ছে তার। সাংবাদিক নয় হয়তো। আসামীপক্ষের কোনো আত্মীয় কি? না, তার চোখে তো বিষাদের কোনো ছায়া নেই। ঘটনাক্রম বলছে, কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই তরুনীর চোখ বলছে, সে আনন্দিত। দু-একজনের সাথে হাসি হাসি চোখ নিয়েই মৃদু স্বরে কথা বলল। আমার ঠিক সামনের বেঞ্চটিতে তার জন্য একটি জায়গাও ফাঁকা হয়ে গেলো। তরুনীটি বসল। আমি রায় শুনছি, ফিরে ফিরেই পেছনে তাকাচ্ছি। একে একে ছটি অভিযোগ উল্লেখ করলেন বিচারপতি। ছয় নম্বর অভিযোগ, মিরপুরের একটি পরিবারের সবাই জবাই করে হত্যা, নারীদের গণধর্ষণ। এই পরিবারটির কর্তার অপরাধ ছিলো, তিনি একা একাই জয়বাংলা শ্লোগান দিতেন। এই অপরাধে তাকে, তার স্ত্রীকে, ছেলেকে জবাই করে হত্যা করা হয়। দুমেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়। একজন সইতে না পেরে মারা যান। একজন বেঁচে আছেন আজো। সেই বীরাঙ্গণার সাক্ষ্যতেই প্রমান হয়েছে ওই ঘটনা ঘটবার সময় মোল্লা সাহেব সেখানে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন। আমি পেছনে তাকাই। কাদের মোল্লার ঠোটের কোনে কি সুক্ষ্ম হাসির রেখা খেলে গেল একটা?
সামনে তাকাই, তরুনীটির মন নেই রায় শোনায়। পাশের তরুনটির সঙ্গে তার মৃদুস্বরে আলাপ চলছে। তারা যে বেঞ্চটিতে বসে আছে, তার পেছনে কাঠের উপর খোদাই করে কেউ একজন লিখে রেখেছ: ‘মুজিব কোর্ট’, ‘জারজ পরিচালিত ট্রাইব্যুনাল’ এমন নানা শব্দগুচ্ছ। পাশের বেঞ্চটিতে একই অবস্থা। বেঞ্চের উপর রং দিয়ে লেখা সরকারী মার্ক ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’, সেখান থেকে ‘র’ এর ফোঁটা এমনভাবে তুলে ফেলা হয়েছে এবং ‘ধ’ মুছে ‘দ’ লিখে রাখা হয়েছে যে, এখন পড়তে হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক অপবাদ ট্রাইব্যুনাল’। এসব বেঞ্চিতে এখন যারা বসে আছেন, তাদের এসব নিয়ে কোনো বিকার নেই।। চিনতেও পারছি না তাদের ঠিক। যদিও উল্টোদিকের বেঞ্চে বসা সব সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাই হয় পরিচিত নয়তো মুখচেনা। আমি মনে হয় ভুল জায়গায় এসে বসেছি।
রায় পড়া প্রায় শেষ। এখন দন্ড ঘোষণা হবে। আমার পেছনে কাদের মোল্লা অবিচল। সামনের তরুনীটির গল্প এখনো চলছে।


সাজা শুনলাম। ১, ২ ও ৩ নম্বর অভিযোগে ১৫ বছর কারাবাস। ৪ নম্বর প্রমাণিত না হওয়ায় খারিজ। ৫ ও ৬-এ যাবজ্জীবন। ফাঁসি কই! আমার পাশে বিবিসির কাদির কল্লোল দাঁড়িয়ে, তার দৃষ্টি বিষ্ফোরিত। আরেক পাশে ডেইলি স্টারের জুলফিকার আলী মানিক, এটিএন বাংলার মাহমুদুর রহমান- সবারই দৃষ্টি বিষ্ফোরিত। চেহারায় বিস্ময়। শুধু আমার আশপাশের মানুষগুলোর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সামনের বোরকা পড়া তরুনীটি এবার অন্যপাশের আরেকটি ছেলের সাথে কথা বলছে। পেছনে মোল্লা সাহেব আগের মতোই অবিচলিত। আসলেই আমি ঠিক জায়গায় বসিনি।
রায় ঘোষণা শেষ। আমি একটু আড়ষ্ঠ। ঠিক মিলছে না কিছু একটা। বিচারপতিরা এজলাস ছেড়ে উঠে গেছেন। এমন সময় আমার পেছনে আবার পেছনে আবার সেই কন্ঠ। ‘আল্লাহু আকবর। এই রায়ে যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং যেটি হয়নি, তার সবই মিথ্যা....এখানকার বিচারপতিরা জল্লাদ, শয়তানের কাছে বিবেক বন্ধক রেখে এসেছে তারা...’।
কাদের মোল্লার সামনে অবস্থান নিয়েছে সেই তরুণীটি। কিছু সাংবাদিক ভিড় করে তার বক্তৃতার নোট নিচ্ছে। আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম আদালতকক্ষ থেকে। বের হবার সময় শুনতে পেলাম, কাদের মোল্লা কোরানের নামে শপথ করে বলছেন, শেষ বিচারে দিনে এই বিচারকদের নামে অভিযোগ জানাচ্ছেন তিনি...সেই সাথে একটি তরুনী কন্ঠ ভেসে আসছে ইনশা-আল্লাহ ইনশা-আল্লাহ।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাদির ভাইকে (কাদির কল্লোল) জিজ্ঞাসা করলাম, মেয়েটি কে? তিনি বললেন, কেনো আপনি জানেন না, ওতো কাদের মোল্লার মেয়ে!
আমার মাথায় একযোগে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় করলো সাথে সাথে। মোল্লা সাহেব একজন ঠান্ডা মাথার খুনী বলেই হয়তো রায়ের সময় বিচলিত হননি। কিন্তু তার মেয়ে! সে এত হাসীখুশী ছিলো কিভাবে? তবে কি তারা জানতো রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে না?
মিরপুরের আলুব্দী গ্রামে তিনশো-থেকে সাড়ে তিনশো মানুষ খুন হয়েছে। গণহত্যা। বিচারক তার রায়ে বলেছেন, সেই হত্যাকা্ন্ডে কাদের মোল্লা স্বয়ং যোগ দিয়েছেন। অস্ত্র চালিয়েছেন। এটা প্রমাণ হয়েছে। এই অভিযোগে তার যাবজ্জীবন হয়েছে। আর কতজন মানুষকে মারলে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া যেত?
কোথাও যেন একটা গড়বড় আছে! অনেক বড় গড়বড়!
ট্রাইবুনালের ফটক ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসছি। পাশ থেকে দুজন মানুষের আলাপ ভেসে এলো, ‘আমি কাল রাত এগারোটার সময়েই জানতাম’। ফিরে লোকদুটোর চেহারা দেখবার রুচি হলো না আর।


পাদটীকা:
বিকেল থেকেই শাহবাগে আছি। আমি, আমার স্ত্রী, আমার ভাই—আমার পরিবারের সবাই সেখানে। জনতার শক্তি কত বড় হতে পারে দেখেছি। গভীর রাতে যখন ফিরেছি তখনও সেখানে ভিড় বেড়েই চলছিলো। একটু আগে টিভিতে দেখলাম মানুষ আরো বেড়েছে। আমিও এখন যাব সেখানে আবার।
১৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নীলপরী আর বাঁশিওয়ালা

লিখেছেন নিথর শ্রাবণ শিহাব, ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৪৮

আষাঢ়ের গল্পের আসর

সন্ধার পর থেকেই ঝুম বৃষ্টি। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দিনের মত আলো করে। কান ফাটিয়ে দেয়া আওয়াজ। কারেন্ট নেই প্রায় তিন ঘণ্টার ওপর। চার্জারের আলো থাকতে থাকতে রাতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামে ক্ষমার অফারের সাথে শর্তগুলো প্রচার হয়না কেন?

লিখেছেন আফনান আব্দুল্লাহ্, ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৫১

ইসলামে পাহাড়সম পাপও ক্ষমা পাওয়ার যে সব শর্টকাট অফার আছে, সেগুলোতে ব্ল্যাক হোলের মতো কিছু গভীর, বিশাল এবং ভয়ঙ্কর নোকতা যুক্ত আছে। কোনো এক অজানা, অদ্ভুত কারণে হাজার বছরের ইবাদত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা যদি পুড়ি, তবে তোমরাও আমাদের সঙ্গে পুড়বে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৫:০১


২২ বছর ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল, বিরোধীদের দমন—এরদোয়ানের শাসনযন্ত্র এতদিন অপ্রতিরোধ্য মনে হতো। কিন্তু এবার রাজপথের তরুণরা সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তুরস্ক এখন বিদ্রোহের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

চেংগিস খান: ব্লগের এক আত্মম্ভরী, অহংকারী জঞ্জাল

লিখেছেন আমিই সাইফুল, ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৪৪

ব্লগ জগতে অনেক ধরনের মানুষের দেখা মেলে—কেউ লেখে আনন্দের জন্য, কেউ লেখে ভাবনা শেয়ার করতে, আর কেউ লেখে শুধু নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে। কিন্তু তারপর আছে চেংগিস খানের মতো একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাকিস্তান প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া নষ্ট প্রজন্ম

লিখেছেন Sujon Mahmud, ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১১:৩৬

৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্ষিতা বাঙালি নারীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অস্ট্রেলীয় ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস গণধর্ষণের ভয়াবহ মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক পাক অফিসারকে জেরা করেছিলেন যে, তারা কীভাবে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×