১
ম্যাকবুকে যেনো অনন্তকাল ধরে টাইপ করে চলেছে নুশ। রিপোর্টটা শেষ হতেই চাইছে না। অথচ এই রিপোর্টের ওপরেই নির্ভর করছে তার পিএইচডি ডিগ্রি। এই করতেই উইন্টারটা চলে গেলো এবার। একবারো স্নোফলে ভেজা হলো না এবছর। দেশে থাকতে প্রতি বর্ষার প্রথম ফোঁটা গায়ে মাখা নিয়ম ছিলো নুশের। ইউরোপে পড়তে এসে নিয়মটা ঠিকই রেখেছিলো। তবে বর্ষার বদলে সে গায়ে মাখে তুষার কণা। পেঁজা তুলোর মতো নরম তুষারের কনা গায়ে মাখতে মাখতে স্বপ্নাতুর হয়ে ওঠে নুশ। বিয়ের পর পলাকে এখানে নিয়ে আসে এক উইন্টারে। প্লেন থেকেই নামতেই স্নোফল। কি অবাকই না হয়েছিলো পলা। এতদিন হয়ে গেলো, এখনো স্নোফল শুরু হলে, চোখ চকচক করে ওঠে পলার। সারা ইউরোপ যখন ঠান্ডায় কাবু, তখন পলা যেনো খোলস ছেড়ে বের হয়। নুশেরও কম প্রিয় না ইউরোপের ওয়েদারের এই দিকটি। লনে বরফের চাপ একটু জমতেই শুরু হয় দুজনের ছোটাছুটি। এ ওর গায়ে তুষারের ডেলা ছুড়ে দেয়া। ওয়েদার একটু ভালো হলেই লং ড্রাইভ। স্কিইং। আহা! জীবনটা কত মধুর। অথচ এবছর কিছুই করা হলো না।
ছটফটে পলার অবশ্য অনুযোগও নেই এ নিয়ে। সে জানে, নুশের পিইএচডি থিসিসের ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয়ার ডেডলাইন অলরেডি দরজায় নক করছে। এখন তার দিন-রাত সমান হয়ে গেছে। লিভিং রুমে বইয়ের স্তুপের আড়াল থেকে টানা ভেসে আসছে নুশের একঘেয়ে টাইপিংয়ের কটকট। কদিন ধরে নুশ কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো কিছু লাগলে ম্যাকবুক থেকে পলার আইফোনে ইনস্ট্যান্ট মেসেজ পাঠায়।
২
ঝাপসা হয়ে আসা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে পলা। ঝিরিঝিরি সাদা পেঁজা তুলো ঝরছে আকাশ থেকে। বহুকষ্টে বাইরে ছুটে যাওয়া থেকে নিজেকে ঠেকিয়ে রেখেছে সে। হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ হয় মৃদু ভাইব্রেশনে পাশের টেবিলটা কেঁপে ওঠায়। একটা বিপ শব্দ করে জ্বলে ওঠে আইফোনের স্ক্রিণ। নুশের মেসেজ। ‘একটা টি ব্রেক হবে নাকি’?
৩
আজ একদমই রিপোর্ট লেখায় মন নেই নুশের। বেডরুমে জানালার পাশে চেয়ার টেনে নিবিষ্ট মনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে পলা। স্থির দৃষ্টি। ভাবালু। এবার একবারও আউটিংয়ে যেতে পারেনি বউটাকে নিয়ে। স্কি করতে বড় ভালোবাসে বউটা। কিছু করারও নেই অবশ্য। এবছরই শেষ হয়ে যাচ্ছে তার স্কলারশিপের মেয়াদ। এর মধ্যে রিপোর্ট জমা না দিলে বিপদে পড়ে যেতে হবে। ফেসবুকেও আজকাল ঢুঁ মারা হয় না। তাই দেশের কারেন্ট ট্রেন্ড, ফ্রেন্ডদের লেটেস্ট আপডেট, কোনো কিছুরই খবর রাখা হচ্ছে না। কি মনে করে ফেসবুকে লগইন করে নুশ। পুরোনো ছবির ফোল্ডারগুলো হাতড়াতে শুরু করে। ক্যাম্পাসের নানা মুহুর্তে তোলা ছবির একটা ফোল্ডার আছে। তখনো পলা আসেনি তার জীবনে। একটা ছবিতে, বেলালের দোকানে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসা নুশ। ডান হাতে চায়ের কাপ, বাম হাতে ধোঁয়া ওঠা সিগারেট। ওই ছবিতে বন্ধুদের অনেক কমেন্ট। একটাতে চিকু লিখেছে, ‘কিরে নুশ? চা খাস!’ চিকু অর্থাত শিবু। ছয়ফুট লম্বা হলেও শিবুর কোমরের মাপ সাতাশের বেশী হবে না। আক্ষরিক অর্থেই তালপাতার সেপাই। তাই ক্যাম্পাসে তার নাম চিকু। ‘চা খাস’—আপাত নিরীহ এই শব্দ দুটোর শানে নূযুল যে জানে, সেই শুধু বুঝতে পারবে, কতটা ভয়ানক এই কমেন্ট।
একটু নষ্টালজিক হয়ে যায় নুশ। আহা! বেলালের চা। কতকাল খাওয়া হয় না। হঠাৎ চা খাওয়ার জন্য মনটা আইঢাই করে। পলা সবসময় ফেসবুকে অনলাইন থাকে। আজকাল স্মার্টফোন আসায় এই এক সুবিধা হয়েছে। নুশ অবশ্য এ ব্যাপারে একটু সনাতণ। ইউরোপে আসার সময় বাংলাদেশে যে ফোনটা ব্যাবহার করতো সেটা হাতে নিয়েই এসেছিলো। বাংলাদেশে থাকতেই ওটার ছাল-বাকল উঠে গিয়েছিলো। তখন কালার মনিটরঅলা ভিজিএ ক্যামেরার মোবাইল সেট কেবল বাজারে এসেছে। স্কলারশিপের জমানো টাকা দিয়ে ওটা কিনেছিলো নুশ। বড় ভালোবাবসর সেট। ছাড়তে পারে না। ভেবে রেখেছে, যদি কখনো নষ্ট হয়ে যায়, ওটাকে কবর দেবে। এপিটাফে লেখা থাকবে, ‘আমার সুখদু:খের সংগী, জন্ম:২০০৪। মৃত্যু:....’ নাহ্, বেঁচে থাকুক আরো অনেককাল। দীর্ঘজীবী হোক। এখনো ওটাই নুশের একমাত্র মোবাইল ফোন। পলা বলে বনেদি ফোন। নাম দিয়েছে ফোক্সওয়াগন বিটল। পলাকে একটা ইনস্ট্যান্ট মেসেজ পাঠায় নুশ, ‘একটা টি ব্রেক হবে নাকি’?
চেয়ার ঠেলে সরানোর শব্দ। পলা কিচেনের দিকে যাচ্ছে। নুশের মনটা ছুটে যায়, আট বছর পেছনে। ঢাকা ভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে। বেলালের চায়ের দোকানে সিমেন্টের বেঞ্চিতে।
৪
মাথার উপর সর্বশক্তিতে ঠান্ডা বাতাস উগরে দিচ্ছে এয়ারভেন্ট। তারপরও কুলকুল করে ঘামছে মনসুর সাহেব। এবছর শীতটা ঠিক জমলো না। কোথায় ঠান্ডায় হাড্ডি বাড়ি খাবে। উলটো, এসি চালিয়েও ঘামতে হচ্ছে। টাইয়ের নটটা একটু আলাদা করে দেয় মনসুর। ঢাকায় জাতিসংঘের বড়কর্তাদের একজন সে। আগারগাঁয়ের ইউএন বিল্ডিংয়ের সতেরো তলায় নিজের অফিস-সুইটে চামড়ার গদিমোড়া চেয়ারে গা ডুবিয়ে বসে আছে এই মুহুর্তে। গায়ে পিয়েরে কার্ডিনের সুট। সামনে ডেস্কে রাখা ম্যাকবুক। অনেকটা মোবাইল ফোনের মতো চারটা ডিভাইস পরপর সাজানো। দুটো চেনা যাচ্ছে ব্ল্যাকবেরি আর আইফোন। বাকি দুটো কি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেখতে গায়ে কাঁটা দেয়। অনেকটা ইউএস আর্মির হামভি জিপের মতো। আল্লাই মালুম, কি কাজে লাগে ওগুলা। কাঠের কেইসে রাখা সিগারেট। গোল্ডলিফ। ইউএনে জয়েন করার পর নিজেকে আগাপাশতলা বদলে ফেলেছে মনসুর। ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে অভ্যাস, সবকিছু। শুধু ভার্সিটি লাইফের এই একটা ব্র্যান্ড ছাড়তে পারেনি। জুনিয়র একজিকউটিভরা আজকাল আড়ালে আবডালে তাকে ‘মিস্টার গোল্ডলিফ’ ডাকে। ছাড়তে পারেনি বেলালের চা’ও।
একটা সিগারেট টেনে নেয় মনসুর। অফিস সুইটের বিরাট জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বিএনপি বস্তি দেখা যাচ্ছে। এই দেশটারে একেবারেই থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। থাকা যাবে না এদেশে আর। মনসুর অবশ্য জোর তদবির শুরু করেছে, হেড অফিসে ট্রান্সফার নেয়ার জন্য। দেখা যাক।
আজকাল একেবারে মুটিয়ে গেছে মনসুর সাহেব। নড়তে-চড়তে কষ্ট হয়। গরম সইতে পারেনা একেবারে। অথচ এক সময়ে তার স্লিম-অ্যাথেলিটক ফিগার ছিলো। পাহাড় চড়া ছিলো তার শখ। ভার্সিটির নাম্বার ওয়ান হার্টথ্রব। মনসুরের দখল নিয়ে কলাভবনে ছাত্রীদের কমনরুমে বহু মেয়ে নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করেছে বলে গল্প চালু আছে। অবশ্য এসব খুব একটা পাত্তা দিতো না মনসুর। নিজের মধ্যে সবসময় একজন বিপ্লবীকে খুঁজে পেতো। সবার সুখে দু:খে ঝাঁপিয়ে পড়াকে কর্তব্য বলে মনে করতো। যেকোনো আন্দোলনে নিজের পাছায় পুলিশের লাঠি না পড়লে, সম্মানহানী হয়েছে বলে মনে করতো। সম্মান বাঁচাতে এমন কিছু করে বসতো যাতে পুলিশ পেটাতে বাধ্য হয়। একদিন তো পুলিশ পেটাচ্ছে না দেখে এক কমিশনারকে থাপ্পড় দিয়ে বসেছিলো মনসুর। আর ছিলো খুব পড়ুয়া। পড়তে খুব ভালোবসতো। তবে পরীক্ষা দিতে নয়। তাই মনসুরের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট থার্ডক্লাস। কিন্তু ইউএনের সাদা চামড়ার স্যার-ম্যাডামরা মেধা চিনতে ভুল করেনি।
মনসুরের রুটিন ছিলো, এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সটান বেলালের দোকানে। সিমেন্টের বেঞ্চিতে এক পা তুলে কড়া পাত্তির লিকার আর সিগারেট দিয়ে ব্রেকফাস্ট। তারপর বাকি কাজ। মনসুর কোনোদিন ক্লাসে গেছে, এটা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না।
টাইয়ের নটটা আরেকটু ঢিলা করে নেয় মনসুর। সিগারেট পুড়েই যাচ্ছে। অ্যাশ পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দামি কার্পেট। মনসুরের দৃষ্টি অনেক দূর। জানালা হয়ে বিএনপি বস্তি ছাড়িয়ে চলে যায় আরো বহু দূর।
৫
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ছাত্র হলেও ক্লাসের বাইরে নুশের বেশীরভাগ সময় কাটে কলাভবনে। নুশ নিজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে। ওর ভাষায়, সিএসই-র পোলাপাইন সব খবিস। ওইগুলার কোনো লাইফ নেই। শালারা আড্ডা দিতে বইসাও প্রোগ্রামিং কপচায়। চায়ের দোকানে ঢুইকা, ওগো সার্ভিস কেনো সফটওয়্যার এনাবেল্ড না, সেইটা নিয়া চিল্লায়। কোনাভাঙ্গা আধোয়া কাপে চা আর চারজনে মিল্যা একটা সিগারেট কামড়াকামড়ি কইরা খাওয়ার সৌন্দর্য্য ওই শালারা কি বুঝবো?
নুশের ভার্সিটির বন্ধুরা তাই সব আর্টস ফ্যাকাল্টির। সকালবেলা ক্লাস শেষ করে কোনোমতে কলাভবনের দিকে ছুট। তার আর্টস ফ্যাকাল্টির বন্ধুদের অবশ্য পেতে সমস্যা নেই। এরা সব ক্লাস করে বেলালের দোকানে। আহা। শিক্ষাজীবন কত আনন্দময় ওখানে। আর এখানে! যন্ত্রের জীবন। ক্লাস শেষ করে দোয়েল চত্তর বরাবর রাস্তা পেরোনোর সময় এসব চিন্তাই ঘুরছিলো নুশের মাথায়। রোদটা খুব চড়া আজ। হেঁটে সেন্ট্রাল পর্যন্ত যেতে গেলে টায়ার্ড হয়ে যেতে হবে। মনে মনে পকেটের একটা খসড়া হিসেব করে ফেলে সে। নাহ। অতিরিক্ত ৫ টাকা খরচ হলে অসুবিধা হবে না তেমন। টিএসসি বরাবর একটা খালি রিকশা যেতে দেখে চালুতেই লাফ দিয়ে ওঠে নুশ।
রিকশা থেকে নামতে নামতেই হাঁক ছাড়ে নুশ।
ওই বেলাল, একটা চা লাও।
আইজক্যা কাউরে দ্যাখতাছি না। লিডারগো সকাল হয় নাই নাকি?
-আজকে ক্লাসে গেছে সবাই। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে জানায় বেলাল।
ভুরু কপালে ওঠে নুশের।
-কি কও মিয়া? সূর্য কোনদিন দিয়ে উঠছে আইজক্যা!
রুবেলের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরায় নুশ। পিচ্চিটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো চোখের সামনে। ক্যাম্পাসে এসে তক দেখছে পিচ্চি রুবেলকে সিগারেট বিক্রি করতে। এখন তার নাকের নিচে গোফের রেখা দেখা যায়। সিগারেট ধরিয়ে চায়ে আলতো চুমুক দিতে দিতে সিমেন্টের বেঞ্চিটার দিকে এগিয়ে যায় নুশ। একটু কোনার দিকে বসে এবার সামনের রাস্তায় দ্রুত ধাবমান তরুন-তরুনীদের দিকে চোখ বুলাতে শুরু করে। বিশেষ করে পোটেনশিয়াল তরুনীদের ভাইটাল স্ট্যাটাস আন্দাজ করার চেষ্টা চালানো নুশের অনেকগুলো ফেবারিট টাইম পাসের একটা। ভালোই এগোচ্ছিলো। রসভঙ্গ হয় বামবু ভাইয়ের ডাকে।
-কি মিয়া ইঞ্জিনিয়ার, আছো ক্যামন?
বামবু ভাই গান করেন। আজকাল টিভিতে প্রায়ই দেখা যায় তাকে। চোখে রিমলেস চশমা। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর চাদর। দাঁতমুখ যতটা পারা যায় খিচিয়ে, গণসংগীত গাইছেন। তার নাম আসলেই বামবু ভাই কিনা, তা জানা নেই নুশের। তবে রিসেন্টলি ক্যম্পাসে তার আমদানি ঘটেছে এবং এই নামেই তিনি পরিচিত। তার ক্যম্পাসে আগমনের হেতু, একটা গানের দল বানানো। দলের সদস্য ক্যম্পাসের কজন শখের গায়ক। নুশের এক বন্ধু, অতীশও আছে এই দলে। দলের নাম ‘মাটি-সুরসিকা’। আজিব নাম। তবে গানটান খারাপ করে না এরা। নুশ নিজেও এদের দু-একটা কনসার্ট দেখেছে।
বামবু ভাইয়ের ডাকে তার দিকে একটু সরে আসে নুশ।
-ভালো আছি বামবু ভাই। চা খাবেন নাকি?
নাহ। এখন আর চা খাব না। বামবু ভাইয়ের জবাব। রিকশায় আসতে আসতে মাথায় কয়েকটা লাইন এসেছে। এখনই লিখে না ফেললে পরে আবার ভুলে যাব।
বামবু ভাই ঝোলা থেকে থেকে কাগজ কলম বের করে ভাবের জগতে ডুব দেয়। কি আর করা। নুশ আরেক কাপ চা নিয়ে, আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। ফের শুরু হয় তার টাইম পাস। এই টাইম পাসের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে নুশের। প্রথমে সে তাকায় পায়ের দিকে। সেখান থেকে ছেলে না মেয়ে তা নিশ্চিত হয়। তারপর সে চেহারার দিকে তাকায়। ছেলে হলে নজর উপরে উঠায় না। কিছুক্ষণ পর সাদা চুড়িদার আর কোলাপুরি চটি পরা একজোড়া পা এগিয়ে আসতে দেখা গেলো বেলালের দোকানের দিকে। পাদুটো এগিয়ে যায় বামবু ভাইয়ের দিকে। দারুন অবাক হয়ে নুশ সাথে সাথে নজর উপরে ওঠায়। আরে। এ মালরে তো চেনে নুশ। ফালগুনি। ক্যাম্পাস নায়িকাদের টপ চার্টে আছে। নুশের কলাভবনের বন্ধুদের বান্ধবী। সেই সূত্রে নুশেরও বান্ধবী। দারুণ সেজেছে আজ ফালগুনি। চোখে কাজল। মুখে হালকা মেকআপ। জামার সাথে মেলানো লিপস্টিক। কপালে একটা টিপও আছে। মার্ভেলাস। নুশকে অবশ্য দেখতে পায় না ফালগুনি। তার মনযোগ বামবু ভাইয়ের দিকে। একটু দূরে হলেও তাদের আলাপচারিতা কান এড়ায় না নুশের।
ফাল্গুনি একগাল হেসে: আরে! বামবু ভাই, কি যে ভালো লাগছে আপনাকে দেখে।
-কেমন আছেন ফাল্গুনি । আপনাকে তো আর দেখিনা। ফোন নম্বরও জানিনা যে, ফোন করে খোঁজ নেবো।
-আজ আমার নাম্বার সেভ করে নিয়েন। চা খাবেন বামবু ভাই?
-আপনি যদি খান তো আমিও.....
এই পর্যন্ত শুনে হাসি পেয়ে যায় নুশের। মনযোগ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে ওই আলাপ থেকে। কোনার মধ্যে আরো সেঁধিয়ে যায়। বামবু ভাই যদি এখন তাকে খেয়াল করে, তাহলে ভারি লজ্জার একটা ব্যাপার হবে।
এদিকে, ফাল্গুনির সাথে গল্পে মগ্ন বামবু ভাই। তাদের চা দিয়ে গেছে বেলাল। চায়ে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় নুশের চোখে পড়ে যায় চোখ। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নেয় বামবু ভাই। তার বিব্রত ভংগিটি নজর এড়ায় না নুশের। আবার কান পাতে তাদের আলাপে। কিন্তু বুঝতে পারে কোথায় যেন একটা সুর কেটে গেছে। নুশ দ্রুত কি-প্যাড টিপে একটা এসএমএস লিখতে শুরু করে।
৬
পরদিন সকাল। বেলালের দোকানের সিমেন্টের বেঞ্চির এক কোনায় জবুথবু ভঙ্গিতে বসে লিরিক লিখছে বামবু ভাই। অন্য কোনায় বেঞ্চির ওপর পা তুলে দ্বিতীয় কাপের জন্য হাক ছাড়ছে মনসুর।
-ওই বেলাল, আমারে আরেক কাপ। রুবেইল্যা, জলদি গোল্ডলিফ দে এক প্যাকেট।
বেশ আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরায় মনসুর। বামবু ভাইয়ের দিকে উড়ন্ত কমেন্ট ছুড়ে দেয় একটা। ‘চলবে নাকি বামবু-দা’? বামবু ভাই জবাব দেয় না। মনসুর চায়ে চুমুক দেয়। মনটাই ভালো হয়ে যায় তার। শালা বেলাল চা’টা ভালো বানায়। হঠাৎ চোখ ছোট ছোট হয়ে যায় তার। দূর থেকে ওইটা কে আসতেছে ছুটতে ছুটতে। চিকু না! হ্যা চিকুইতো। চিকু একদম মনসুরের সামনে এসে ব্রেক করে।
কিরে মনসুর! চা খাস?
হ খাই। তুই খাবি?
মনসুরের এই প্রশ্ন শোনার জন্য অবশ্য থেমে থাকে না চিকু। যে গতিতে সে এসেছিলো, সেই গতিতে উলটো দিকে ছুট লাগিয়েছে আবার। একটু অবাক হয়ে আবার চায়ে চুমুক দেয় মনসুর। এবার প্রশ্ন ছুটে আসে পেছন থেকে।
‘মনসুর ভাই, চা খাচ্ছেন’? রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠটা শুনে পেছন ফিরে তাকায় মনসুর। ইকোনমিক্সের শেলি এইটা। দুই ব্যাচ জুনিয়র। মনসুরের কাছে কয়েকদিন ম্যাথ করেছে লাইব্রেরিতে বসে। মনসুর নিজে ক্লাসের ধারেকাছে না গেলে কি হবে, মানুষকে পড়াতে ওস্তাদ। মনসুরের ভ্রুটা একটু কুঁচকে যায়। সে বলতে চাইছিলো: হ খাই। তুমি খাইবা। কিন্তু ততক্ষণে পাখি উড়াল দিছে। এইবার একটু ভাবিত হয় মনসুর। বিষয়টা কি! পাশ ফিরে বামবু ভাইয়ের দিকে নজর দেয় সে। ব্যাটা লেখা বন্ধ করে কেমন যানি একটু উসখুস করছে। এরই মধ্যে আরো বার দুই উড়ন্ত মন্তব্য ছুটে আসে আশপাশ থেকে। ‘মনসুর ভাই, চা খাচ্ছেন নাকি’? ঠিক ধরতে পারেনা মনসুর, কে বললো। ততক্ষণে কলাভবনমুখি ভিড়টা অনেক গাঢ়। একটা ক্লাস শেষ হয় আরেকটা শুরু হয়েছে। সব পোলাপান এখন রাস্তায়। মনসুরের মেজাজ চড়তে শুরু করে। সবাই একযোগে মশকরা করতে শুরু করছে নাকি তার সাথে!
মনে মনে গজগজ করছে মনসুর। সিগারেটও বিস্বাদ লাগছে। এরই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে অনিক বেরিয়ে এলো। হ্যাংলা, ছোটখাটো অনিক জার্নালিজমে পড়ে। কথাবার্তার ব্যালান্স নেই কোনো।
-কিরে মনসুর! চা খাস?
হলুদ দাঁতগুলো কেলিয়ে হাসতে লাগলো অনিক। দেখেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো মনসুরের। এত জোরে কাপটা নামিয়ে রাখলো, যে ভেতরে থাকা তলানিটুকু চলকে জামায় এসে লাগলো।
-হ চা খাই! তো কি হইছে! চা খাওন কি নিষেধ নাকি! (সাথে আরো কিছু গালি)
উত্তেজনায় মাতৃভাষা বেরিয়ে পড়ে মনসুরের। অনিক অবশ্য গায়ে মাখে না। চোখের কোন দিয়ে সে দেখে, বামবু ভাই সটকাচ্ছে। ঠোটে হাসি আরো চওড়া হয় অনিকের। গোডাউনে থাকা প্রায় লাল হয়ে যাওয়া দাঁতগুলোও বেরিয়ে আসে তার।
৭
টাইটা টেনে পুরো খুলে ফেলে মনসুর। অফিসারসুলভ গাম্ভির্য ঝেড়ে জোরে হাঁক ছাড়ে।
- বেলাল এক কাপ কড়া পাত্তির লিকার-চা লাগাও।
ইউএন-এ জয়েন করার পর মনসুর প্রথম সুযোগেই বেলালকে এখানে আরদালির চাকরি দিয়েছে। ক্যাম্পাসের দোকানটাও আছে। ওটা বেলালের ছোট ভাই সামলায়। বেলাল ছুটির দিনগুলোতে গিয়ে হিসা্ব নিকাশ দেখে। বেলালের কাছে মনসুর ঈশ্বরের সমান। আগে মনসুর ভাই বলে ডাকলেও এখন স্যার বলে ডাকে।
স্যারের জন্য পোরসিলিনের কাপে তার প্রিয় কড়াপাত্তির চা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় বেলাল। ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মনসুর স্যার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন দূরে। অন্যমনস্ক। জামার হাতা গোটানো। হাতে সিগারেট পুড়ছে। ছাই জমে লম্বা হয়ে গেছে। যেকোনো সময়ে ভেঙে পড়বে। অ্যশট্রে ফাঁকা। সিগারেটের অনেকগুলো মোথা আর ছাই কারপেটে গড়াগড়ি খাচ্ছে। টেবিলের ওপর টাই রাখা। চা চেয়েই আবার ভাবনার গভীরে ডুব মেরেছে মনসুর।
স্যারতো এমন না। কাজ ছাড়া তো তারে কখনো দেখা যায় না। বেলাল ভাবে। আইজকা জানি স্যারের কি হইছে। ঘাঁটানোর সাহস হয় না তার। টেবিলের ওপর আস্তে করে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে পা টিপে টিপে বেরিয়ে যায়।
৮
চা-কাহিনীর কয়েক মাস পরের ঘটনা। রোজার মাস। নুশের বন্ধুবান্ধব একটাও রোজা রাখে না। নুশ প্রথম প্রথম দু’একটা রোজা রাখলেও বন্ধুদের তালে পড়ে সে-ও বাদ দিয়েছে। তাছাড়া সামনে ফাইনাল। রোজা রেখে পড়াশোনার লোড নেয়া একটু কষ্টকরও বটে। নুশের যতই পরীক্ষা থাকুক আর যাই থাকুক। দিনে একবার হলেও কলাভবনে আসা চাই তার। রোজার মাসে অবশ্য নিয়মনটা একটু বদলে নিয়েছে সে। এখন পিএল চলছে। দিনের বেশীরভাগ সায়েন্স লাইব্রেরিতেই কাটে তার। লাঞ্চের আগে আগে কলাভবনে চলে আসে সে। বেলালের দোকান সামিয়ানা দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে ভেতরে চা-সিগারেট খাওয়ার সিজনাল ব্যবস্থা। নুশের কলাভবনের বন্ধুদের আড্ডা রমজান মাসে এই সামিয়ানার ঘেরাটোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নুশ পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে অনিক বসে আছে। নুশকে দেখেই মুখ উজ্জ্বল হয় অনিকের।
-আরে মামু। আইয়া ভাল করছ। খিদা লাগছে খুব। মোল্লায় যামু খাইতে। তু্মি লও আমার লগে।
কিন্তু অনিকের আশায় পানি ঠেলে দেয় নুশ। আড়মোড়া ভেঙে বলে-
-এখন খামু না। মাথাডা জ্যাম হইয়া আছে। তুই খাইয়া ল। আমি একটু বিড়ি ফুঁকি কতক্ষণ।
তুই শালা একটা মাদার....। বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত জিহ্বার ডগা দিয়ে কথাগুলো ভেতরে ঠেলে দেয় অনিক। অন্য যে কেউ হলেই অনায়াসে কথাগুলো বলে দিতে পারতো। কিন্তু এই শালা জানি ক্যামন অন্যরকম। আইনস্টাইন আইনস্টাইন একটা ভাব নিয়ে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু মুখ তো না যেনো চিনির তলোয়ার। জবাবে এমন মিষ্টি করে কোনো হুজুরের বাণী ছেড়ে দেবে, তখন গোসল করেও গায়ের জ্বালা কমানো যাবে না। অনিক একাই চারুকলার সামনে মোল্লার হোটেলের দিকে রওয়ানা হয়। রোজার মাসে এই মোল্লা আর জগার ক্যান্টিন ছাড়া কোনো ক্যান্টিনেই লাঞ্চ পাওয়া যায় না। অনিকের মোল্লাই পছন্দ।
৯
গোগ্রাসে গিলছে অনিক। রোজার মাসে এই এক সমস্যা। হলের কোনো ক্যান্টিনেই সকালের নাস্তা পাওয়া যায় না। অনিক তাই আরলি লাঞ্চ মারে প্রতিদিন। কিন্তু দুপুরে চুলা থেকে মোল্লার হাঁড়ি নামার আগে থেকেই পেটে ছুঁচোর ডন শুরু হয়ে যায়। মুখের মধ্যে এক দলা ভাত নিয়ে গরুর মাংসের আধাসেদ্ধ একটা টুকরোর সাথে যুদ্ধ করছে অনিক। কোনোমতেই কবজা করতে পারছে না। সমস্ত মনযোগ তার সেদিকে। আচমকাই নুশের গলা কানে আসে অনিকের। কাকে যেনো ব্ল্যাকহোল বুঝাচ্ছে। মোল্লার দরজা দিয়ে ঢুকছে নুশ। তার সাথে ফালগুনি। আজ একটা ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি পড়েছে ফালগুনি। কপালে ম্যাচিং টিপ। চোখে শ্যাডোও দিয়েছে ময়ুরকন্ঠী। এ মাল সাজন-গোজন ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। অনিক ভাবে। ভাবছে এড়িয়ে যাবে কিনা। আরেক গ্রাস ভাত ঠেলে দেয় মুখের মধ্যে। কিন্তু এড়াতে পারে না। চোখাচোখি হয়ে যায় নুশের সাথে। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অনিক। দম দেয়া পুতুলের মতো ফুল ভলিউমে বলে ওঠে-
-আরে মামা, এইডা কি মাল লইয়া আইছো! রোজা তো ভাইঙ্গা গেলো।
অনিকের কথার সাথে সাথে মুখ থেকে কয়েকটা ভাতও ছিটে আসে। সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে মোল্লার তেল-ঝোলের দাগে কালোবর্ণ টেবিলে। ততক্ষণে ভেতরে থাকা জনাকুড়ি কাষ্টমারের চোখ একযোগে ঘুরে গেছে দরজার দিকে। অনিক অবশ্য আগেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার নজর ভাতের প্লেটে। খিদেটা এখনো মরেনি। আরো প্লেট-দুই খেতে পারলে হয়তো পেটটা ঠান্ডা হবে।
১০
টুংটাং শব্দে ধ্যান ভাঙে নুশের। চায়ের কাপে চামচ নাড়ছে পলা।
-কি ভাবছিলে।
-কই কিছুনাতো।
-কখন থেকে চা নিয়ে বসে আছি। তুমি কিছু করছোও না, আবার আমাকেও নোটিশ করছো না।
-না, তেমন কিছু না। আজ আর লিখতে মন চাইছে না।
দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে নুশ। দরজার পাশে দেয়ালে ঝোলানো হ্যাঙ্গার থেকে পারকাটা নিয়ে গায়ে চড়ায়। শু-স্ট্যান্ড থেকে টেনে নেয় একজোড়া থারমাল বুট।
-চলো লনে যাই। এখনো স্নোফল চলছে। আজকের দিনটা নিজেকে ছুটি দিলাম।
একটা কিশোরী আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পলার চোখে-মুখে।
আহা! জীবনটা কত আনন্দের। পলার দিকে নরম তুষারের একটা ডেলা ছুড়ে দিতে দিতে ভাবে নুশ।
(ডিসক্লেইমার: এই ঘটনা এবং যাবতীয় চরিত্র কাল্পনিক। যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা ঘটনার সাথে মিলে যায়, তা অনভিপ্রেত কাকতালমাত্র।)