সর্বাঙ্গে ব্যাথা, খুব কষ্ট। আঙ্গুল দিলেই টের পাই। ডাক্তার দেখাই, ডাক্তার বলে আপনি ত ভাই ভাল আছেন, বাসায় গিয়ে রেস্ট করেন, ঠিক হয়ে যাবে। আমি বাসায় যাই, রেস্ট নেই, কিন্তু আঙ্গুল দিয়ে যখন গালে ছোট একটা চাপ দেই, ব্যাথা লাগে। ঘটনা কি?
ঢাকায় থাকি ব্যাচেলর হিসাবে, বাড়িওয়ালার শ্যালকের সাথে যখন দেখা হয়, বেটা জিজ্ঞাসা করে প্রতিবারেই, “আপনারা বাসায় থাকেন কতজন?” বলি আমরা তো ভাইজান এই বলেই বাসা ভাড়া নিসি যে আমরা দুইজন বন্ধু থাকব আর মাঝিমধ্যে আমাদের বাবা মা আসবেন, এর ব্যতিক্রম ত হয়না। তাও বেটা খোটা দিয়ে বলে, “আমি জানি তো আপনারা ব্যাচেলর”। ভাল কথা, পাপ করসি ব্যাচেলর হয়ে, হজম করি খোটাটা। এমনিতেও এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যে কোনও মাস্তান মার্কা জীবন যাপন করি। তাই তারে মনে মনে বলি, ভাড়া পাইতেছ বেশি ঠিক সময়মত, বলতেছ বল, কিন্তু মুড়ি খাও।
দেশের বাড়ি উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরও জেলায়। সাপ্তাহিক ছুটিতে সময় পাইলে মাসে একবার বাড়ি যাই মায়ের কাছে। আগে বাড়ি যাইতে ৭-৮ ঘন্টা লাগত, তাও গাড়ি ফুড ভিলেজে থেমে থাকত ৩০ মিনিটের বেশি। ফুড ভিলেজের গরুর মাংস ভাল, পথিমধ্যে তবিয়ত ভাল থাকলে গরুর মাংস ভালই পাইতাম, মনে হইত যেন পিকনিকে যাইতেছি। এখনও যায়, তবে এখন এমনিতেও খাওয়া লাগে, কারন এখন আমার বাড়ি পৌছাইতে লাগে ৯-১০ ঘন্টা, যদি রাস্তাতে জ্যাম না থাকে। জ্যাম থাকলে কোনও ঠিক নাই। শুধু উত্তরবঙ্গই না, ঢাকা থেকে যে কোন বিভাগীয় শহরে যাইতেই এখন একটা লম্বা সময় লাগে। কেন লাগে সেইটা নিয়েই আসলে লিখতে চাই।
হাতে পরিসংখ্যান নাই যে প্রতিদিন ঢাকায় কয়টা গাড়ি ঢাকায় ঢোকে অথবা বেরয়। তবে এখন সংখ্যায় এতটাই বেশি, যে আমার বাড়িযাত্রা কি পরিমানে চেঞ্জ হইসে সেইটা বলি। গাড়ির কাউন্টারে এখন রেগুলারই গাড়ি লেট করে ছাড়ার নোটিশ দেয়, কারন গাড়ি নাকি কেবল আসল বলে। পরিচর্যা চলতেছে, কিছু পার্টস মেরামত হচ্ছে, ঠিক হওয়ামাত্রই একই ড্রাইভার/অথবা হেল্পার ঐ গাড়িটা নিয়ে রওনা হবে। গাড়ি ছাড়ে, প্রায়ই সাভার-ইপিজেড পার হইতেই ২-৩ ঘন্টা লেগে যায়। এরপর ড্রাইভারের ত মাথা খারাপ। সময় মত গাড়ি পৌছাইতে হবে, নাইলে ত পরের দিন আবার গাড়ি লেইট। তাই বাকিটা সময় গাড়ি চলে মাতাল গতিতে। ওভারটেকিং ত অহরহ। ড্রাইভারের দিকে তাকায়ে মায়া লাগে, তাই মাঝে মধ্যেই স্পিড ব্রেকারের ধাক্কা অথবা হার্ড ব্রেক গিলে ফেলি কথা না বলে। কিছু অতি উৎসাহী মানুষ একটু গালিগালাজ করেই থেমে যায়। ড্রাইভারের মাথা আরও গরম হয়। সময় বাঁচাইতে একটা ওয়ান ওয়ে রোড (ফুলবাড়ি) দিয়ে গাড়ি যায়, পুরা রাস্তা অন্ধকার, কেউ কেউ আয়াতুল কুরসী পড়তে থ্রিলার হজম করে। বাসায় ফিরে মনে হয়, যেন বেঁচে গেলাম এই যাত্রায়।
কিছুদিন আগে বাসের এক সুপারভাইজারের সাথে কথা হয় সামনের সিটে বসার সৌজন্যে। জিজ্ঞাসা করি, “ভাই এই রাস্তায় বাস ডাকাতি হয় কেমন?” বলে, “ভাই সেই যুগ কি আর আছে? এখন এত বেশি গাড়ি রাস্তায়, যে কোনও ডাকাত যদি বাস আটকায় ১ মিনিটও রাখে, তাইলে সেইখানে কম করে হইলেও ১০-২০ টা বাস লম্বা জ্যাম হয়ে যাবে। তাই ডাকাতির ডেফিনিশন এখন চেঞ্জড। ডাকাত বাসেই যাত্রী হিসাবে থাকে, চান্স পাইলে ড্রাইভাররে ভুলায়ে নির্জন যায়গায় নিয়ে যায়! মজা পাইলাম শুনে, ৫ বছর আগেও এরকম চিন্তা করা যাইতনা, গাড়ি বেশি হয়ে ভালই হইসে। আমরা উন্নত হইসি, ঢাকায় এখন মানুষ যখন তখন আসতে পারে। হুদাই তো নেতারা বলেনা, দেশে উন্নয়নের জোয়াড় চলতেছে।
যেহেতু ঢাকায় মানুষ বাড়তেছে, মানুষকে তো এইখানে খায়ে পড়েই বাঁচতে হয়। খাওয়া আসবে কোত্থেকে? ট্রাকে নিশ্চয়ই, তাই বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রাক ও বাড়তেছে। যত ট্রাক তত চাঁদা, পরিবহন নেতাদের ভুড়ি বাড়তেছে। তা হউক, আমার কি? যানবাহন বাড়ুক, উন্নতি হচ্ছে ত দেশেরই! কিন্তু হাইওয়েতে বাস চালানর মত দক্ষ ড্রাইভারের একটু কমতি আর কি। তাতে কি? এক ড্রাইভার আগে যেইখানে সপ্তাহে ৪ টা ট্রিপ দিত, সে এখন ১০ টা দেয়, টাকা বেশি পাইলে ফিটনেস কোনই বেপার না আসলে। আর ব্যবসা যখন রমরমা, তখন ড্রাইভাররে নাহয় মজুরি ১০% বেশিই দিলাম। আর নিতান্তই না পারলে হেল্পারও কিন্তু ভাল গাড়ি চালায়। কিছু গাড়ি আছে, যেগুলাকে আমরা আঞ্চলিক পরিভাষায় “মফিজ গাড়ি” বলি। সেগুলার ড্রাইভার মামারা কিন্তু বেশ রাফ এন্ড টাফ ম্যানলি গাড়ি চালান; বলেন “চাবি মাইরা দিছি ছাইড়া”। আর সুপারভাইজার বলে “যৌবন একটা গোল্ডলিফ সিগারেট”। রাস্তার খালুআব্বা ট্রাকগুলা ত আরেক কাঠি সরেস। এক্সিডেন্ট মাঝে মধ্যেই করেন ইনারা স্বভাব বশতই, পারলে বলে ওঠেন, “শিট, ইট হ্যাপেনস”। কিন্তু এদের সংখ্যা এখন এতটাই বেশি যে ভাল গাড়িকেও বেকায়দায় ফেলে দেয়। দক্ষ চালকেরা ঘুম ঘুম ও আহত চোখে বলে ওঠে হয়ত, “ড্যাম, ইট হ্যাপেনড”! কয়েকদিন আগেই দেখলাম, চিটাগাং রুটে গ্রীনলাইনের এক ভলভো গাড়ি ভয়াবহ একসিডেন্ট করসে, যেটা আগে এভাবে দেখিনাই। আমি বেচারা ভাবি, এইভাবে চলতে থাকলে বাড়ি যাওয়া আর জীবন নিয়ে জুয়া খেলার মধ্যে তেমন কোনও তফাৎ নাই।
একে দেশে ১৬ কোটি মানুষ, বেশিরভাগ মানুষই জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসতে হয়। আসতে বাধ্য আসলে, কিছু করার নাই, কারন দেশের উন্নয়ন চলতেছে ঢাকায়। জনগনের চাহিদা অনেক, সরকারের যোগান কম, তাই আমরা ভুখা পার্টি, এর মধ্যে ক্যাপিটালিস্ট সুবিধাবাদিরা ত বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের তরে। তাই আমরা ব্লাডি সিভিলিয়ান্সিই থেকে গেলাম। দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে ঢাকায় আমরাও নিজেদের ভাগ্যবদলে ব্রত; আমরা, কোটি দুয়েক পাপী ঢাকাবাসী কাম পরবাসী!
ঈদে বাড়ি যাব, এক বন্ধু কে বললাম ফোনে আমারও টিকেট কাটতে। টিভি ছেড়ে দেখি, তারেক মাসুদ সহ আরও কিছু গুনীজন আর আমাদের মাঝে নেই। সবাই একটা অকস্মাৎ চিন্তায় পড়ে গেল, শহরে শিক্ষিত সমাজে শোক। টিভিতে মিডিয়া গোষ্ঠীর দুঃখী আস্ফালন। কেউ কেউ বলে উঠল, এটা চক্রান্ত, এটা হত্যা। একজন আবার বলেন, এর দায়ভার যোগাযোগমন্ত্রী নেবেন না কেন? অনুষ্ঠানের সঞ্চালক পরিস্থিতি বুঝে টপিক পাল্টানোর চেষ্টা করলেন ও কিছুটা সফল হলেন। আমি হাসলাম এবং তাদের কান্নাকাটি দেখতে থাকলাম এবং এক সময় বিরক্ত হয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিলাম। চিন্তা করতে থাকলাম, ঈদের টিকিট কাটা কি ঠিক হইল? গত দুই বছরে ২৯ রোজায় বাড়ি যাইতে সময় লাগসিল যথাক্রমে ২৪ ও ১৬ ঘন্টা। তাও আবার জীবন বাজি রেখে। বাবা-মা এই সপ্তাহে ঢাকায় আসার কথা ঢাকায়, মন চাইল উনাদের বলে দেই আসবেন না আপনারা। কিন্তু বাবাকে তো ডাক্তার দেখানো দরকার, অনেক কষ্টে হার্টের চেকাপ এর জন্য তাঁকে রাজি করাইসি। তাই বললাম না। একটা ভয় নিয়ে চুপ করে থাকলাম। রাতে খবরে দেখি পাবনাতে আরও ৫ জন মারা গেসেন। আরও এক জায়গায় আরও একজন। আহতদের অবস্থা শোচনীয়। মৃতদের বেশির ভাগ মানুষেরই ঢাকায় আসা/যাওয়ার হাইওয়েতেই এই পরিনতি। ট্রেন সার্ভিস ত ভালনা, নিতান্তই বিপাকে না পড়লে কেউ চড়েন না। যোগাযোগমন্ত্রী আবুল সাহেবের চামড়াও অনেক মোটা। তাই এই বিপজ্জনক হাইওয়েই পাপী আমার একান্ত ভরসা।
উন্নয়নের বদলে অসহায় মৃত্যু, এইটাই আমাদের অনেকের পরিনতি নয় কি? ঢাকার ভিতরের দূর্ঘটনার অবস্থা নাই বা বললাম, সবাই জানে কি অবস্থা এখানে। কিন্তু তাও আমাদের ঢাকায় আসা লাগবে। ঢাকায় আসতে রাস্তা আর কত বানাবে সরকার? ঢাকার ভিতরে যা অবস্থা, বাইরেও দিনে দিনে একই হইতেসে। সেখানেও অদূর ভবিষ্যতে রাস্তার বাঁকে বাঁকে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়াবে, দেশ আরও উন্নত হবে ঢাকার নেতৃত্বে। আমরা একটু আধটু মরবো, তবে মরে মরেও বাঁচব স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, যদি নসীবে থাকে আর কি।
তারেক মাসুদ সহ আরও অনেক দূর্ঘটনায় সবার দাবি, ফিটনেসহীন যানবাহন, রাস্তা নাকি সরু, রাস্তা ভালনা, তাই নাকি এই অবস্থা। আরে ভাই, এই সংখ্যায় প্রতিদিন ঢাকায় বাস/ট্রাক যাতায়াত করলে ত রাস্তা প্রতিনিয়তই খারাপ হবে যার সংস্কার কাঙ্গাল সরকারের জন্য কঠিন; এই আকারে গাড়ি ট্রিপ দিলে ত গাড়ির চাকা/ইঞ্জিন সহ্য করবেনা; এইভাবে বিশ্রামহীন কাজ করলে ত ড্রাইভার/হেল্পারের হুশ থাকবেনা; আর উন্নয়নের ভাগিদার হতে যদি মফস্বলের দক্ষ ড্রাইভাররা ঢাকায় চলে আসেন, তাইলে ওখানে আপনার স্বজনদের নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত হবেনা; আর এতও বেশি আকারে মানুষ মারা গেলে তারেক মাসুদ অথবা মিরসরাইয়ের শিশু-কিশোররের মরলেও আমাদের মনে হবে “আর আই পি তারেক মাসুদ/মিরসরাইয়ের শিশুরা, তোমাদের আমরা ধরে রাখতে পারলাম না”। এটা আমাদের একটা মানসিক অচলাবস্থা নয় কি?
সরকার ত সহজে ভাল কাজ করতে পারেনা, আমরা হাত গুটায়ে উন্নয়নের সুবিধা নেই আর সময় মত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করি। নিজে বাঁচলে বাপের নাম, যুগে যুগে কাপুরুষদের প্রিয় উক্তি; আমরাও তাই আওড়াই এবং পরের দিন একটা মৃত নতুন পাপী সকাল উপভোগ করি। যেই পাপী সকালে এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যে কোনও মাস্তান হয়ে ঘুরে বেড়াই।
প্রথমেই বলসিলাম আমার সেই ব্যাথার রোগের বেপারে; সকলের কাছে প্রশ্ন , “আচ্ছা, আমার ব্যাথাটাকি আমার আঙ্গুলেই ছিল?”