গত কয়েক দিন ধরে সারা দেশে বিশেষত শিক্ষাঙ্গনের অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে উদ্বুত পরিস্থিতির প্রতিটি মূর্হুত দেশের সাধারন নাগরিকের মাঝে কেটেছে ভয়, শংকা এবং উদ্বিগ্নতায়। সরকারী দলের বিরোধী দলের উপর নিয়মিত অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যার সাথে সাথে নিজেদের অন্ত:কোন্দল, এর উপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ রণক্ষেত্র, একটি ভয়াবহ অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের আদরের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লীগ দখলের রাজনীতির পুরোনো হোলি খেলায় মেতে উঠেছে, যা এখনো অব্যহত। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠন সমূহকে হল থেকে বিতাড়িত করে নিজেরা নিজেরা সমরাস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, যা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। যদিও ঢাকার বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠানে কোথাও কোথাও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। তবে র্ভতি বানিজ্য, টেন্ডারবাজী সহ নানা অপকর্মে ছাত্রলীগের একক আধিপত্যে পারস্পরিক বিরোধীতা ছাড়া এখন র্পযন্ত আর অন্য কোন বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বিগত ১লা ফেব্রুয়ারী সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অন্ত:কোন্দলে সাধারন ছাত্র আবু বকর হত্যা এবং পরর্বতী সোমবার ৮ই ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হোসেন হত্যা, এ ঘটনা দু’টি সরকারের পক্ষ থেকে ও কয়েকটি স্বনাম ধন্য জাতীয় দৈনিকের পক্ষ থেকে দেখার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমুল র্পাথক্য এবং সে অনুযায়ী আচরন, উপস্থাপন, বিশ্লেষন প্রসঙ্গে কিছু বিষয়ের অবতারনা জরুরী মনে করছি।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভাব খানা এমন দেখা যাচ্ছে যে দেশটা এখন শুধু তাদের, অন্য কারো এখানে কোনো অধিকার নেই। দেশের সকল পরিসরে তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে নিজেরা নিজেরা পারস্পরিক প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে । যার প্রেক্ষিতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসন র্দীঘ দিনের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের ১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সবাই মনে করেছিল এবার হয়তো ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। কিন্তু না, পূর্বের ধারাবাহিকতায় গত ১লা ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে সংগঠিত কোন্দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার এফ রহমান হলের সাধারন ছাত্র আবু বকর গুরুতর আহত হয়ে পরর্বতীতে মারা যায়। এ প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ছাত্রলীগের প্রতি তার ভালবাসার দৃষ্টিতে মন্তব্যটি করেন এভাবে যে- এটা কোন ব্যাপার না, এমন ঘটতেই পারে। এর পূর্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারী নোমানীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার প্রেক্ষিতেও তিনি ছিলেন র্নিলিপ্ত। যদিও প্রধানমন্ত্রী নিজে ছাত্রলীগের র্কমকান্ডে রুষ্ট হয়ে অনেক আগেই ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে মনে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই স্নেহভাজন এসব সন্তানদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি এদের সুসন্তান রুপে গড়ে না তুলে বারে বারে অন্যায়ের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। যার পরিনতি ভাল হচ্ছে না।
কিন্তু তার চেহারার একটি ভিন্ন মূর্তি দেখলাম গত ৮ই ফেব্রুয়ারী রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে। তিনি তখন নিজে স্বয়ং রাজশাহীতে গিয়ে হাজির হয়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে শায়েস্তা করতে নেমে পড়েন। তার সাথে সাথে ওনার সর্বশক্তি দিয়ে প্রশাসনের সকল হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে চিরুনী অভিযানের হুংকার ছোড়েন। তার এ হুংকার রাজশাহী জেলার সীমানা পেরিয়ে পুরো রাজশাহী বিভাগে পরর্বতীতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো প্রশাসনিক শক্তিকে একটি দলের গনগ্রেপ্তার, হয়রানি, মামলা, হামলা, র্নিযাতনের কাজে লেলিয়ে দেন। যার ফলস্বরুপ রাজশাহী কলেজ শিবিরের নেতা শাহীনকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিনকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করতে উৎসাহিত হয়েছে। একটি হত্যার বদলে তিনি দু’টি হত্যার সুযোগ তৈরী করেছেন। এর পর সারা দেশে প্রায় ছয় শত জামায়াত -শিবির নেতা-র্কমীকে ধড়পাকড় অভিযান চালিয়ে র্নিবিচারে আটক করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে জামাত-শিবিরের অফিস ভাংচুর করে এক অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি করে। উপরন্তু বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনিকযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে জামাত-শিবিরের নেতা কর্মীদের নামে মামলা দায়ের করা হয়। সারা দেশে পরিচালিত এহেন চিরুনী অভিযানটি যুক্তিসঙ্গত হতো যদি, এ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর এটি প্রথম কোনো রাজনৈতিক হত্যার ক্ষেত্রে হতো। অথবা এর পূর্বে ছাত্র লীগ র্কতৃক সংঘটিত হত্যাকান্ড সমুহের ক্ষেত্রেও একই ধড়পাকড় পদক্ষেপ গ্রহন করা হতো।
অন্যদিকে দেশের কিছু স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিককে এর পরিচালকদের নিজস্ব আর্দশিক চিন্তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। খবর প্রকাশ হতে থাকে, শিবির হত্যা ও রগকাটার পুরোনো ধারায় ফিরে গেছে, অন্য একটি দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়- ৭১ এর ন্যায় শিবির আবার হত্যা, রগকাটার রাজনীতি শুরু করেছে। ১১ই ফেব্রুয়ারী একটি জাতীয় দৈনিকের হেডলাইনে একটি ভয়ংকর রক্তখেকো জীবের চেহারা একে এর নীচে লিখা ছিল- ওদের রুখে দাড়াও, ১২ই ফেব্রুয়ারী- শিবির ধরতে চিরুনী অভিযান, ১৩ ই ফেব্রুয়ারী- শিবির পালাচ্ছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারী- দিশেহারা জামাত শিবির, ১৫ই ফেব্রুয়ারী- নানা নামে ৪৩ দেশে শিবির, সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এসব সংগঠন। এভাবে পরপর প্রতিদিন তাদের নিজস্ব আর্দশিক চিন্তার নগ্ন বিরোধীতাই ফুঁটে উঠেছে, ঘটনা ছুতা মাত্র। কারন সারা দেশের চিরুনী অভিযানের বিষয়টি এবং বিভিন্ন স্থানে জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের বিষয়টি সরকারী দলের কিছু লোক ছাড়া অন্য কেউ সুনজরে দেখেননি। অনেক গুলো পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তেও এ অভিযানের সমালোচনা করেছেন। এমনকি পত্রিকাটি রাজশাহী কলেজের ছাত্র শাহীনকে পুলিশ গুলি ঠেকিয়ে হত্যার খবরটিতেও কোন দুঃখ প্রকাশতো করেই নি বরং নিউজ করেছে- শাহীন হত্যায় ঢাকা পড়লো অনেক তথ্য। খবর গুলো পড়ে মনে হচ্ছিল পত্রিকাটি খুবই আনন্দিত ও উচ্ছসিত জামাত শিবিরের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ গনগ্রেপ্তার ও হামলায়।
শিবিরের বিরুদ্ধে রগকাটার একটি জগন্য বদনাম র্দীঘদিন থেকেই প্রচলিত ছিল। এ অপবাদের বিরোধীতা তারা র্সব র্পযায়েই করেছে। র্দীঘদিন পর তারা এ অপবাদ শোনা থেকে মুক্তও হয়, যা তাদের আর কেউ বলার সুযোগ পেত না। কিন্তু হঠাৎ করে এ অপবাদটি আবার তাদের ঘাড়ে উঠানোর জোরালো প্রচেষ্টা চলছে বলে মনে হয়। যদিও এ বিষয়টি এখনো কেউ নিশ্চিত নয় যে, এটি কারা ঘটিয়েছে? এবং যথেষ্ঠ সন্দেহ থেকে যায় এ নিয়ে যে এটি শিবিরের ঘাড়ে চাপানো পুরোনো অপবাদের ফিরিয়ে আনার নতুন ষড়যন্ত্র নয়। কারন আওয়ামী লীগের রাজনীতির মুখোশ আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সেক্রেটারীর লিখা- আমার ফাঁসি চাই বইয়ে। যেখানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ধারায় নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার নীতি স্পষ্ট হয়েছে।
এ অমীমাংসিত রগকাটার বিষয়টি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও আওয়ামী রাজনীতিবীদরা লুফে নিয়েছে। এখন কথায় কথায় শিবিরকে ধরাশায়ী করার জন্য এটিকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছে। উপরে উল্লেখিত জাতীয় দৈনিকের ধারাবাহিক খবরের পর তারা তাদের একটি ম্যাগাজিনের শিরোনাম করেছে- ধর্মের নামে ছাত্রশিবির রগ কাটতে মস্ত বীর। এ হাতিয়ারটি এখন তারা কথায় কথায় ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
এরা যে জামাত-শিবির কে শুধুমাত্র ৭১ এর ঘটনার জন্য বিরোধীতা করেনা এটা তাদের মনের অজান্তেই স্পষ্ট করেছে। ৪৩ দেশের ইসলামী দল গুলোকে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে। আসলে ইসলাম জড়িত বিষয়টিই তাদের দেহ জালার মুল কারন। সেটা বাংলাদেশের ইসলামী ছাত্রশিবিরই হোক আর শ্রীলংকার ইসলামী মোভমেন্টই হোক। শ্রীলংকান মুসলিম ছাত্রদের জনপ্রিয় দল এ মুসলিম সংগঠনের ব্যাপারে তারা রির্পোট করেছে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। এরা মুসলিম নামধারী হলেও সকল দেশের সকল মুসলিমের র্স্বাথ বিরোধী। তাহলে প্রশ্ন আসে এরা মুলতো কার পক্ষে কথা বলতে চাইছে।
অপবাদ ছাড়া এসব গনতান্ত্রিক ইসলামী সংগঠন সমূহকে ঘায়েল করাও মুশকিল। কারন পত্রিকা ঘাটাঘাটি করে এ রকম কোন ছবি পাওয়া যাবে বলে আমি যথেষ্ট সন্দিহান যে- শিবিরের কোন র্কমী অস্ত্র উচিয়ে কাউকে গুলি করছে কিংবা ছিনতাই, রাহাজানি, পুকুর ডাকাতি, টেন্ডার দখলের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই তারা জঙ্গি, রগকাটা ইত্যাদি অপবাদ পুন: পুন: প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু অন্য দিকে পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিনকার খবরে ছাত্রলীগের পুকুর ডাকাতি, জমি দখল, অন্ত কোন্দলে গোলাগুলি, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খুনাখুনি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই ইত্যাদি লেগেই থাকে। অস্ত্রসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কাডারদের আমরা সাম্প্রতিক সময়েই পত্রিকায় প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু সন্ত্রাস তৎপরতার চিরুনী অভিযান চলে শিবিরের বিরুদ্ধে আর ছাত্রলীগকে অতি স্নেহ সহকারে পুলিশের হেফাযতে সন্ত্রাসের সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়। পুলিশ যদি কাউকে কখনো ভূলক্রমে গ্রেফতার করে তবে তাকে ছাড়িয়ে এনে পুলিশকে উল্টো অপযস্থ করা হয়।
পরিশেষে আমি বলতে চাই সকল ছাত্র সংগঠন, সকল নাগরিকের সমান অধিকারের এর র্পূব র্শত হলো সমানভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। সাহারা খাতুন যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারী নোমানী হত্যার প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারতেন, তবে হয়তো কোন শিক্ষাঙ্গনে কেউই কোন খুনের মতো সহিংস ঘটনা ঘটানোর সাহস পেত না, এমনকি কারো উপর দোষ চাপানোর জন্যও না। কিন্তু সরকার প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে সারা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে, দেশে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছেন। যার প্রেক্ষিতে হয়তো সোনার ছেলেরা আস্কারা পেয়ে যে কোনো ঘটনা ঘটাতে দ্বিধাবোধ করবেনা। যা দেশকে অনাকাংখিত, অস্থির, যে কোনো পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:৫০