somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অনন্ত সম্পর্কের সম্ভাবনা

৩০ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
সবকিছুর নিজস্ব গন্ধ আছে। কিছু তীব্র আর কিছু হালকা। মৃত্যুর গন্ধ সবচেয়ে বেশী তীব্র, যেমনি তীব্র প্রেম-ভালোবাসা। কোনটাই গোপন থাকে না। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমার বাবা অতিদ্রুত জেনে গেলেন দাদাজানের মৃত্যু সংবাদ। বাদ আছর দাফনের সময় ধার্য করা হয়েছে। এখন রওয়ানা হলে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌছতে আমাদের সমস্যা হবার কথা না।

বাবা রাশভারি মানুষ। খুব কম কথা বলেন। চেহারা, কথা-বার্তায় অস্থিরতা নাই। ভাবলেশহীন। কিছুতেই হয় না কিছু এমন। আমরা দুই ভাই-বোন সবসময় তার দুরত্ব রেখে চলতাম। তিনিও সেই দুরত্ব কমানোর চেষ্টা করেন না।
মা তখন রান্নাঘরে।
বাবা খুব গম্ভীর গলায় মাকে বললেন, জাহান আজ ভোরে বাবা মারা গেছেন। তাড়াতাড়ি তৈয়ারী হও। এখুনী রওয়ানা দিতে হবে।
আমি আর বুবু মা’র পাশে বসে খেলছিলাম। কথাটা শুনে বাবার দিকে তাকালাম।
বাবা আমাকে বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহির রাজেউন বলো। মানুষের ইন্তেকালের সংবাদ শুনলে এটা পড়তে হয়।
কি বুঝলাম কে জানে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেছিলাম।
বাবা আবার বললেন, এর অর্থ হলো নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো।
মা কাদতে শুরু করলেন। আমার বড় বোন তার সাথে কান্না জুড়ে দিলেন।
বাবা বললেন, আহ, তোমরা কি শুরু করলে। তাড়াতাড়ি তৈয়ারী হও। নইলে বেজায় দেরী হবে।

জীবিত মানুষ মানেই অব্যক্ত মৃত মানুষ। মৃত্যু ছাড়া মানুষ সম্পূর্ণ ব্যক্ত হয় না। একমাত্র মৃত্যুই দিতে পারে জীবনের পূর্ণতা। জন্ম যেমন পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে, মৃত্যুও তেমন।
কথাগুলো বলছিলেন ইহসাক চাচা। বাবা বন্ধু। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মৃত্যু কি। কিন্তু তার এই অদ্ভুত কথাগুলো শুনে আমরা দুই ভাই-বোন কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম।
আমাদের সাথে ইসহাক চাচাও গেলেন। ইসহাক চাচা বেশ হাসি খুশি মানুষ। সবসময় মজার মজার কান্ড করেন। তারপরও বুঝি না বাবা সবসময় তার উপর এতো বিরক্ত হন কেন । তিনি কিছুই বললেই বাবা বিরক্ত হন। কিন্তু চাচা উল্টো হাসতে থাকেন। আমরা দু ভাই-বোন ইসহাক চাচার ভীষণ ভক্ত। আজ চাচাকে বাবার মতোই গম্ভীর মনে হলো। মৃত্যু বিষয়ে আমার ভেতর হতাশা তৈয়ারী হলো। এমনিতে মা’র কান্নাকে বেশীক্ষণ পাত্তা দিই না। তার ব্যাকুল হয়ে কেদে উঠা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্দ করলেও ইসহাক চাচার গাম্ভীর্য পরিবেশটাকে ভারী করে তুলল।
আমি মা’র জিজ্ঞেস করলাম, মা মরে গেলে কি হয়।
মা বলেন, মানুষ আল্লাহর কাছে চলে যায়, আর ফিরে আসে না। তোমার দাদু মারা গেছেন। তাকে আজকের পর আমরা আর দেখতে পাবো না। কথা বলো না, চুপচাপ থাকো।
এই বলে মা আমাকে জামা পড়াতে শুরু করলেন।

মৃত্যুকে এতো নিবিড় করে দেখার সুযোগ আমার হয়তো আগে কখনো হয় নাই। মানুষ এই আছে এই নাই। এই বোধটা তখনো জন্মে নাই। আমি কোনভাবে নিশ্চিত ছিলাম না, এই মানুষটাকে আর কখনো দেখব না। আমার দাদু ছিলেন বাবার উল্টো। সারান তার মুখ জুড়ে হাসি। গাম্ভীর্যের কোন ছায়া তার মুখে কখনো দেখি নাই। তখন আমার বয়স বেশী না। তাই দাদুর স্মৃতি তেমন একটা নাই। দাদুর কথা ভাবলে হাসিভরা একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমাদের ঘরের পুরানো আলমারিতে বাহারী ফ্রেমে দাদুর একখানা ছবি আছে। সাদা-কালো ছবি। সেই ছবিতেও দাদু হাসি হাসি মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই ছবির দিকে যেদিক থেকে তাকাই না কেন, মনে হতো তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। সেই হাসিমাখা কোমল চোখকে ফাকি দেয়ার জো নাই। কিন্তু সেই ছবির সাথে স্মৃতিতে থাকা দাদুর চেহারার কোন মিল নেই। গ্রামে গেলে দাদুর সাথে সারাদিন থাকতাম। রাতে দাদুর গলা জড়িয়ে ঘুমাতাম। দাদুকে আর দেখব না, এই চিন্তা আচ্ছন্ন করার যথেষ্ট কারণ ছিলো, তারপরও হয়তো বয়স সেই শোকটারে সমর্থন দেই নাই। পরবর্তীতে এই বিষয়ে বয়সকে যথেষ্ট ধন্যবাদ জানিয়েছি। বিষয়টা এভাবে স্বীকার করাটা লজ্জার। তারপরও ছোট খাট শোক যে আচ্ছন্ন করে নি তা না। কিন্তু আপনজনের মৃত্যু সহ্য করা আসলেই কঠিন। এই সাথে সম্পর্কের জায়গায় অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। সেটার মাজেজা হাজির করাই আমার উদ্দেশ্য।

হঠাৎ আমার খুব কান্না পেল। বুকের মধ্যে কেমন যেন করছিল। গ্রামে কাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। কে আমায় মজার মজার গল্প শোনাবে। খুব স্বার্থপরের মতো চিন্তা। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কি মনে করে বাবা আমাকে কাছে টেনে নিলাম। তিনি আমাকে তার কোলে বসালেন।
বললেন, কান্নার কি আছে। কাদলে দাদু কষ্ট পাবে। আল্লাহকে বলো দাদুকে যেন শান্তিতে রাখো।
বাবা এক নাগাড়ে এতোগুলো কথা বলাতে আমি অবাক হলাম। তাছাড়া বাস ভর্তি লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে সহানুভূতি। আমি খুব লজ্জা পেলাম। বাবার সাথে এমন অন্তরঙ্গতা আগে কখনো হয় নাই। সবসময় দূরে দূরে। বিশাল একটা ছায়া মতন। কিন্তু কখনো মাথার উপর পাই নাই।
বাবাকে আজ কি অন্যদিনের চেয়ে আলাদা মনে হচ্ছে। আমি ছোট্ট মানুষটা যেন আচ করতে পারি কিছু একটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। সামান্য øেহের প্রশ্রয়ে অনেক কাল ধরে খিল দেয়া দুয়োর যেন আমার চোখের সামনে পর্দা সরিয়ে নিজেকে মেলে দেয়।
আমি ভয়ে ভয়ে সে দুয়োর পেরুই। দেখতে পেলাম দু’পাশে সবুজ মাঠ। মাঝে সরু আইলে বাবা দাড়িয়ে আছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত ধরলাম। দুজনেই হাটতে শুরু করি। হাটতেই থাকি। এরপর গাঢ় কুয়াশা ঘিরে ধরে আমাদের।
ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমরা পৌছে গেছি শেষ বাস ইস্টিশনে। বাকি পথ রিকশায় যেতে হবে।
আমি, আপু আর মা এক রিকশায়। বাবা আর ইসহাক চাচা অন্য রিকশায়।
হঠাৎ করে আমি বললাম, বাবার সাথে যাবো। বাবা কোলে টেনে নিলেন।
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। কোন কথা বললেন না। অন্য সময় নানা উপদেশ থাকত। সবাইকে সালাম দেবে। পা ছুয়ে সালাম দেবে। দুষ্টুমী করবে না। পুকুরের কাছে যাবে না।
আজ এই নিরবতায় সবাই পাল্টে গেছে। বাবা মা ইসহাক চাচা সবাই চুপচাপ। পরিবেশের গাম্ভীর্যে আমিও গম্ভীর হয়ে উঠি।
হঠাৎ চেচিয়ে বলে উঠি, বাবা দেখেন কত্তো বড় নৌকো।
বাবা বলেন, হু অনেক বড়। এর চেয়ে বড় নৌকা আছে।
বাবা এই নৌকোয় চড়তে খুব মজা?
হা, খুব মজা।
আমি চড়ব।
আরেক দিন।
অন্য রিকশা থেকে মা বলেন, খোকন আমার কাছে এসো।
বাবা বলেন, থাকুক।

আকাশে মেঘের ভেলা। দুটো পাখি আকাশে উড়ছে। একটা গরু পথের ধারে দাড়িয়ে আছে। নাম না জানা কতো গাছ পথের দু’পাশে। ঘাস ফড়িং, প্রজাপতির দল। ঘাসের বুকে নকশা কাটছে লাল নীল সাদা ছোট ছোট ফুল। দিগন্তে আকাশ আর মাটি যেখানে এক হয়ে গেছে কেমন যেন ধোয়া ধোয়া অস্পষ্ট ভাব। দূরের গাছগুলো কেন যে কালো দেখায়। এগুলো আগেও দেখেছি। কিন্তুু বাবার কোলে বসে এইসব কতো চমৎকার দেখা যায় আমার জানা ছিলো না। আমার স্বপ্নের দুয়োরটা খুলে গেল কি।
এভাবে পথ চলতে চলতে কখন যে বাড়ি পৌছে গেছি টেরই পেলাম না। আমি বুঝি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

দুই.
অনেক মানুষের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। সবাই যেন বাবার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল। হয়তো বলছিল। কিন্তু কি অদ্ভুত নিরবতা। যেন কেউ কিছু বলছিল না। আমি কখন কার কোলে বা কার হাত ধরে আছি, তার হদিস করা মুশকিলের ব্যাপার। অনেক প্রবীণ লোককে দেখলাম যারা বাবাকে নানান কথা বলছিল। স্বান্তনা দিচ্ছিল। যেন বাবা আমার মতো ছোট্ট হয়ে গেছে। তারা বাবার মাথায়, কাধে হাত দিয়ে কথা বলছিল। কেউ কেউ আমার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
অনেকে বলছিল, আমি নাকি দেখতে দাদুর মতো হয়েছি। তারা আপে করছিল কিভাবে সময় পার হয়ে যায়, তাদেরও ডাক এসেছে। কথার সমুদ্র, নিরবতার সমুদ্রের মধ্যে ভাসছিলাম।
কখন দাদুর বুড়ো বিড়ালটা আমার কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করছে টের পাই না। ভুলু বলে ডাকলাম। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। করুন করুন চেহারা করে রেখেছে। মনে হচ্ছে এই বাড়ির মানুষগুলোর মতো। কিছুণের মধ্যে সে আমার পিছু পিছু ঘুরতে লাগল।

কে যেন এসে বলল, খোকন তোর দাদুকে দেখবি না।
আমি বাধ্য হয়ে তার পিছু পিছু গেলাম। অনেকগুলো মানুষ সুর করে কুর’আন পড়ছে। আগরবাতির তীব্র ঘ্রাণ পরিবেশটাকে বদলে দিয়েছে। আমার তিন ফুফু। বাবা সবার ছোট। আমার ফুফারা বাবাকে জড়িয়ে কাদছেন। বাবাকে খুব বিব্রত মনে হলো। মনে হচ্ছিল তার চোখও ছলছল করছে। এরপর ফুফুরা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
কে একজন বলছিল, এভাবে কাদিস না তোরা, মুর্দার কষ্ট হবে।
আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। দাদুর কষ্ট হবে ভেবে চেপে রাখতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ফুফুরা জড়িয়ে ধরার পর কিযে হলো আমিও কান্না শুরু করলাম।
দাদুর মুখখানা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ঘুমিয়ে আছেন। একটু পরেই জেগে উঠবেন। সাদা কাপড়ে ঢাকা দাদুকে অচেনা লাগছে একটু একটু। মৃত্যু মানে কি অচেনা হয়ে যাওয়া।
বড় ফুপু এই বলে বিলাপ করছিলেন, মৃত্যুও সময় নাকি তিনি বারবার খোকন খোকন করে ডাকছিলেন।
আমার মুখটা দেখে যেতে পারলেন না।
তারপর কয়েকজন দাদুকে গোসল করাতে নিয়ে গেল। আমি তাদের সাথে গেলাম। বাবা আমাকে সরিয়ে আনলেন। আমি বাবার সাথে অযু করলাম।
বাবা বললেন, এখন আমরা তোমার দাদুর জানাযা নামাজ পড়তে যাবো। তোমার দাদুকে কি আর দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমি বললাম, না।
বাবা বললেন, ঠিক আছে, দেখার দরকার নাই।
তারপরও অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে কাফন পরানো দাদুকে দেখাতে নিয়ে গেল।

‘‌'... আমার আব্বা যদি কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকেন, আপনারা তাকে মাফ করে দিবেন। আর যদি কেউ তার কাছে কোন টাকা পয়সা পেয়ে থাকেন, তাহলে দয়া করে জানাবেন। আমি পরিশোধ করে দেবো।’' বাবার গলা ধরে এলো।
কেউ একজন বললেন, তিনি কেমন মানুষ ছিলেন।
অন্যরা বলতে লাগল, তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।
আমিও দাদুর কবরে এক দলা মাটি দিলাম। তারপর আমরা সবাই একে একে বাড়ির পথ ধরলাম। হঠাৎ করে মনে হলো দাদুকে এভাবে রেখে এলাম কেন। বাবাকে বলব ভাবছি। দেখি, বাবা বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না।

চারদিকে সুমসাম নিরবতা। ঝি ঝি পোকারাও চুপ হয়ে গেছে। তারপরও রাতের আলাদা সুর তাল লয় আছে। এটা এখানে আসলে বুঝতে পারি। জোছনার রুপালী আলো জানালা পার হয়ে চিকমিক করছে প্রাচীন মেঝেতে। মেঘের ছায়া খেলছিল। একেকটি মেঘ একেক রকম। চাদের আলো গলে মেঘ দূর কোন দেশে যায়, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে আমাকে বলবে মেঘের কথা। আমারও খুব মেঘ হতে ইচ্ছে করে। সে ইচ্ছে গোপনে ফুসে রাখি। মা’কে বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এমন কিছু বললেই মা কেমন করে হাসে। আর বুবু বলে বোকা ছেলে। জেনেশুনে বোকা হতে কে চায়।
হাসনা হেনার সুবাস চাদের আলোর সাথে মিশে অদ্ভুত আবেশে ভাসিয়ে দিয়েছে চারদিক। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে হঠাৎ। দাদুর কথা ভেবে কান্না পাচ্ছিল। আমি মা-বাবার মাঝখানে শুয়ে আছি। মা’র গা ঘেসে। যাতে আবার বাবা বিরক্ত না হন। গ্রামে এলে রাতে দাদুর গলা জড়িয়ে ঘুমাতাম। দাদু কতো গল্প করত। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতো। সেই স্পর্শে ঘুমে চোখ বুজে আসত। আমি জেগে থাকার চেষ্টা করতাম। যাতে অনেক অনেক গল্প শুনা যায়। আর প্রতিদিনই ভুল করে ঘুমিয়ে পড়তাম।

আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম। হায়, আমার মনের খবর কেউ রাখে না। দাদুর প্রতি অভিমান হলো। কেন যে আমাকে ফেলে চলে গেল।
দাদুর কথা খুব মনে পড়ছে?
বাবার গলা শুনে চমকে উঠি। আস্তে আস্তে মোলায়েম কন্ঠে কথা বলছেন।
আমি মাথা নাড়ি। বাবা অন্ধকারে কি ঠাহর করলেন কে জানে। তিনি আমার পিঠে হাত রেখে কারো কাছে টেনে নেন।
তোমাকে দিনে তেমন একটা কাদতে দেখিনি। দিব্যি খেলা করে বেড়িয়েছ। এখন কাদছ কেন?
আমি কিছু বলি না।
আসো তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।
বাবা কি কোমলভাবেই না আমার পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। আমি তার গলা জড়িয়ে ধরি। বাবার শরীরে অন্যরকম একটা গন্ধ আছে। অন্যকিছু থেকে আলাদা। মনে হচ্ছিল আমি চোখ বন্ধ করে হাজারো লোকের ভিড় থেকে বাবাকে আলাদা করে নিতে পারব।
খোকন গল্প শুনবে।
হা, শুনব।
বাবা আমাকে গল্প শোনাতে লাগলেন। ঠিক গল্প না। বাবা আর দাদুর কাহিনী। ছোটবেলার কাহিনী। মজার মজার কাহিনী। আমার ইচ্ছে করছিল সারারাত বাবার মুখে এইসব শুনব। কিন্তু কখন যে ভুল করে ঘুমিয়ে পড়ি আমার নিজেরও মনে থাকে না।

ভোরবেলায় বাবা, মা আর ফুফুদের সম্মিলিত কুর’আন তেলওয়াতের মধুর আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। তখনও সূর্য উঠেনি। আমি এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম। বাবা আমাকে ডেকে তার পাশে বসালেন।

এই খোকন ওঠ।
আমি বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরতাম।
এতোন ঘুমায় নাকি। এই বলে দাদু দু’হাত ধরে আামাকে টেনে তুলতেন। অনিচ্ছাসহ উঠে বসতাম।
চল বাইরে থেকে হেটে আসি। তার আগে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নে। সকালের হাওয়া শরীরের জন্য ভালো। এই হাওয়া গায়ে লাগলে অসুখ বিসুখ হয়না। শহরে তোরা এই হাওয়া কই পাবি।
দাদার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হাটা। রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের আইলে নেমে পড়তাম।
দাদা বলতেন, স্যান্ডেল খুলে ফেল।
আমরা দুজনে স্যান্ডেল খুলে হাটতাম। ঘাসের উপর খালি পায়ে হাটতে কিযে মজা। সবুজ নরম ঘাসগুলো পায়ে সুড়সুড়ি দেয়। হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠি।
দাদা বলেন, কিরে কি হলো।
মজা লাগছে।

শীত আসি আসি করছে। সকালের বাতাসের শীতের শিরশির আমেজ টের পাওয়া যায়। সেই বাতাসে মিশে থাকে সারারাতের কেদহীন শুদ্ধ আবেশ। তাই কি সকালের আলো-বাতাস সবই এতো ভালো লাগে। বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে আছি। আগে কখনো বাবার সাথে এইভাবে বের হইনি। একেবারে বের হইনি বললে ভুল হবে। যেমন- গতকালও এমন হয়েছিল। যদিও সেটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন যদি বাস্তব হয়, তখন স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক থাকে না। এতটুকু তখন না বুঝলেও স্বপ্নের মতা টের পেয়েছিলাম। মা বলেন, প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ভালো কিছু চিন্তা করবি। আল্লাহকে বলবি সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখাও। তাহলে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখবি। সেই স্বপ্ন যদি সত্য হয়ে যায় কতো মজা। মা আরো বলতেন, যখনই মন খারাপ করবে সুন্দর একটা স্বপ্ন বানিয়ে ফেলবি। আমি বাবাকে নিয়ে কতো সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন বানিয়েছি। কিন্তু জানতাম না বাস্তবের বাবা স্বপ্নের চেয়েও বেশী কাছের।

আমি বাবার হাত ছেড়ে আগে আগে হাটছিলাম। আমিই পথ দেখিয়ে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি আমার আর দাদুর গোপন জগত। পেছনে তাকিয়ে দেখি বাবার মুখে মিটি মিটি হাসি। ভোরের কোমল আলো-বাতাসের সবটুকুই তার হাসিতে খেলা করছে।
বাবাকে বলি, চলো স্যান্ডেল খুলে হাটি।
স্যান্ডেল খুলে হাটলে কি হবে?
খুব মজা হবে।
কেমন মজা?
আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করি। উত্তর দিতে পারি না।
ঘাসের কথা বলে উঠবে তাই-না?
আমি অবাক হয়ে বাবাকে বলি, তুমি কি করে জানো।
কেন? আমিও তো একদিন তোর মতো ছোট্ট ছিলাম।
এই বলে বাবা আমায় জড়িয়ে ধরেন। আমি একটা দৃশ্য বানাতে চেষ্টা করলাম। বাবা দাদুর হাত ধরে এই পথে হাটছেন। তারা সূর্য উঠাতক হাটবেন। হাটতেই থাকবেন। হাটতে থাকবেনই। বাবা তার ছোট্ট হাত দিয়ে দাদুকে একবার ছুয়ে আবার দৌড়ে সামনে যাচ্ছেন।
বলছেন, বাবা তাড়াতাড়ি আসো। আমরা সূর্য উঠার আগে ওখানটায় পৌছতে চাই।
দাদু দুষ্টুমী করে আস্তে হাটেন। বাবা যতই বিরক্ত হন, দাদু ততই হাসেন।

আমি আর বাবা ক্ষেতের আইল ছেড়ে উঠে এসেছি।
বাবা চলো ঐখানটায় যাই। সূর্য উঠার আগে পৌছতে হবে। তাহলে আমরা ফার্স্ট হবো।
বাবা বলেন, ঠিক আছে।
কিন্তু বাবা যেন কিছুতেই ফার্স্ট হতে চায় না। রাগে আমার চেখে জল আসে। আমার রাগ দেখে তিনি হাসেন। একটু পরে সূর্যও কি এভাবে হাসবে। ইচ্ছে করে বাবাকে ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। বাবা দিকে তাকায়, দেখি তিনি মিটমিট করে হাসছেন। যেন আমার মনের কথা তিনি বুঝে ফেলেছেন। এখন তো চাইলেও পালিয়ে যেতে পারব না। থাক, পালিয়ে গিয়ে কাজ নেই। বাবার এই হাসি সূর্যের হাসির সাথে এক হবার আগেই আমাকে ওখানটায় পৌছতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ৮:৩৩
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×