সোশ্যাল মিডিয়ায় 'মহানগর' ওয়েব সিরিজ নিয়ে কোলাহল আমাকে বাধ্য করে হইচই প্লাটফর্মে ৮০ টাকা দিয়ে এক মাসের জন্য একটা অ্যাকাউন্ট করতে। এতে সুযোগ পাবো মহানগর কে মাপতে।
ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ৮০ টাকা কম নিয়ে দেখতে বসলাম মহানগর। 'ভালো' লেগেছে তবে 'অতি ভাল' লাগেনি। ভালোলাগা আপেক্ষিক। টাকার অংকে প্রকাশ হলে সুবিধা হয়। সেই সুবিধা গ্রহণ করে আমি মহানগরকে টাকার অংকে মাপি। ৭০ টাকা উসুল হয়েছে। ১০ টাকা লস। মন করতে শুরু করে খস খস।
শিল্প-সাহিত্যকে টাকার অংকে মাপা অশ্লীল লাগে, কিন্তু ক্যাপিটালিস্ট দাবার বোর্ডের এক নগণ্য গূটি হিসেবে আমি এই দাঁড়িপাল্লার বাইরে যেতে পারি না। দাবার বোর্ডে আটকে থেকে লস যাওয়া ১০ টাকা উসুল করতে আমি হইচই প্লাটফর্মে তিনটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি দেখে ফেলি - পার্সেল, প্রেম টেম, চিনি। প্রচন্ড ফালতু লাগে। টাকার হিসেবে প্রত্যেকটা মাইনাস ৫০। লাগতে থাকে হাঁসফাঁস।
এই লস মেনে নিতে পারিনা। শিল্প-সাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত বন্ধু, বান্ধবীদের খোঁচাতে থাকি ভালো কিছু সাজেস্ট করতে। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিই আমার কিপটামির কথা। স্মরণ করিয়ে দেই ৮০ টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলে আমি এখন মাইনাস ৮০ টাকায় অবস্থান করছি। তারা প্রায় সকলেই আমাকে জানায় অনতিবিলম্বে আমি যেন 'তাকদীর' দেখি। তাতে যদি উসুল হয় নেকি।
তাকদীর দেখে আমার ফল হয় মহানগরের মতন। ভাল লেগেছে তবে অতি ভাল লাগেনি। তবে এতে ৭০ টাকা উসুল হয়। কমে যায় ৮০ টাকা বরবাদ হওয়ার ভয়।
ক্যারাম খেলায় যেমন 'এক টোকা দিয়া বোর্ড সাফ' হয় তেমন আমি এক বাক্যে মহানগর এবং তাকদীরকে মূল্যায়ন করি - যেমন হাইপ নিয়ে গল্প শুরু হয়, যে গতিতে গল্প এগোয়, সেই গতিতেই শেষ এপিসোডে গল্প ভূপাতিত হয়।
ভূপাতিত কে অন্যভাবে বলা যায় মুখ থুবরে পরে।
১০ টাকা হারিয়ে আমি চূড়ান্ত সতর্ক হই। সোশ্যাল মিডিয়ার এবং বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করি এবং খুঁটে খুঁটে প্ল্যাটফর্মের সিরিজগুলো মাপতে থাকি। মাপামাপি শেষ হলে 'পাঁচফোড়ন' ওয়েব সিরিজ সিলেক্ট করি। পাঁচ জন ভিন্ন ডিরেক্টরের পাঁচটি ছবি। প্রথমে দেখি 'ডোনার'। এক ঝটকায় হয়ে যাই উইনার!
পয়সা উসুল হয়ে যায়। উসুল হয়ে লাভের পাল্লা ভিশন গতিতে উপরে উঠতে শুরু করে।
এক কারখানা মালিকের কিডনি রিপ্লেসমেন্ট হবে, ডোনার পাওয়া যায় এক কর্মচারীর মেয়েকে। কর্মচারী মেয়েকে বাধ্য করে মালিকের জন্য কিডনি দিতে। এই মেয়ের সাথে আবার কারখানার মালিকের ছেলের ইটিশ পিটিশ। ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলোর টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। গল্প হিসেবে আহামরি কিছু না। তবে শেষ দৃশ্য মুখ থুবড়ে পড়ে না।
ফজলুর রহমান বাবু ও তারিক আনামের অভিনয় দেখে আমি ভচকায় যাই। আবার মাপামাপি শুরু করি। এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে মোশাররফ করিম এবং চঞ্চল চৌধুরী ভালো; ফজলুর রহমান বাবু এবং তারিক আনাম অতি ভালো। প্রথম দুজন ৭০ টাকা। পরের দুইজন ৮০। তবে চারজনই এক ফসলেরই চাষী।
এরপর দেখি থ্রি কিসেস। ভুরু কুঁচকে যায়। বাংলাদেশে এমন ছবির শুটিং করা যায়! হোলি মোলি। এরপর দেখি লিলিথ। হোলি ক্রেপ। সাইন্স ফিকশন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অদ্ভুত ভালো এক্সিকিউশন।
পাঁচফোড়ন দেখার মাধ্যমে আমার অভিযান শেষ হয়। আমি দেখা ক্ষান্ত দিয়ে ভাবতে শুরু করি। যে ভাবনা আনন্দের। ভাবনা শেষ হলে আমি আবার মাপামাপি শুরু করি। এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে আমার ৮০০০ টাকা লাভ হয়েছে। তাতে মুখে হাসি এসেছে।
শেষে এসে একটা দ্বৈত পরিস্থিতির শিকার হই। মন খারাপ হয় যে আমি ৮০ টাকা দিয়ে ৮,০০০ টাকার আনন্দ উপভোগ করলাম। এর মাঝে হয়তো কোন একটা শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। শিল্পসাহিত্যকে হয়তো টাকায় মাপা যায় না, কিন্তু কলাকুশলীদের সঠিক মূল্য নির্ধারণের কোন মাপকাঠি নেই, থাকা প্রয়োজন। শুরু হওয়া উচিত তার আয়োজন।
যে পরিমান ভালোবাসা, যে পরিমাণ একাগ্রতা, যে পরিমাণ স্পৃহা নিয়ে ওয়েব সিরিজের কলাকুশলীরা এসব নির্মাণ করেন তার কণামাত্র আমরা দর্শকেরা তাদেরকে ফেরত দিতে পারি না। তাতে বেড়ে চলে দেনা।
তারা অমূল্য সৃষ্টি করেন। তাই এসব আমরা 'অ' মূল্যে নেই। এ আমার কথা না। কাজী নজরুল ইসলামের কথা। কবির কথা মনে আসাতে মনে পড়ল, তিনি আমার কাছে ৮,০০০ টাকা পান।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২১ সকাল ১১:৫৮