আধ্যাত্মিক কালু গাজীর প্রসঙ্গ যখন উঠে তখন সুন্দরবনের মানুষ জানায় তারা কালু গাজীকে সাধক ও দরবেশ মনে করে এবং দাবী করে যে তিনি বনে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পথ দেখিয়ে লোকালয়ে নিয়ে আসতেন, বাঘের মুখ থেকে বাচাতেন, বন্য শুকরের কবল থেকে উদ্ধার করতেন। তারা এটাও বলে, তাকে চাইলেই দেখা যায় না, তার ঘর বাড়ী কেউ দেখেনি তবে বিপদে পরা মানুষকে তিনি উদ্ধার করতেন। সাত আট বছর আগে চার যুবক এক বাঘের কবলে পরে, বাঘ তাদের উপর ঝাপিয়ে পরার ঠিক আগে কোথা থেকে যেন কালু গাজী এসে হাজির হন এবং যুবকদের বলেন 'আমার পেছনে দাড়া', এরপর তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন বাঘের চোখের দিকে, এক সময় বাঘ পিছু হটে যায়; তিনি তারপর যুবকদের লোকালয়ে পৌছিয়ে দেন কিন্তু যুবকরা তাকে ধন্যবাদ দেবার আগে সন্ধ্যা -আলোয় মিলিয়ে যান। তাকে বহুদিন দেখা যায় না তবে সন্ধ্যে নামার সময় বা বিশাল ঝড় উঠার আগে কাকে যেন এখনো দেখা যায় সেজদা দিচ্ছে; স্থানীয়রা ধারনা করে নেয় কালু গাজী নামাজ পরছেন।
সাইক্লোনকে ভয় পাওয়া মানুষের মজ্জাগত স্বভাব তাই সুন্দরবনের মানুষরা একে ভয় পায় তবে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তারা ভয়-ডর ফেলে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করাই শ্রেয় মনে করে; তাদের কাছে এটাই নিয়তি যে বিশাল ঝড় এসে উড়িয়ে নিতে পারে তাদের সবকিছু, সাথে জীবনও। সুশীলদের 'সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে' অথবা 'সুন্দরবন বাঁচিয়ে দিল বাংলাদেশ' শ্লোগানগুলো সুন্দরবনের মানুষদের স্পর্শ করে না সামান্যতম, তারা এসব ভাবসমন্বিত কথা শুনতে নারাজ, বরং উন্নতির জোয়ারে ভেসে যাওয়া দেশে বাস করে এখনো মাটির তৈরি ঘরে প্রতি মুহূর্তে সাইক্লোন দ্বারা উড়ে যাবার আশঙ্কা নিয়ে তারা খানিকটা আশাহত স্বরে বলে - বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।
যাদের মরবার তারা মরবেই এ দর্শন সুন্দরবনের মানুষ অর্জন করেছে লড়াই করে বোঝা যায় তবে তাদের দার্শনিক ভাবার কারন নেই; বরং তাদের বলা যায় যোদ্ধা, তাদের যুদ্ধ প্রতি দিনের, প্রতি মুহূর্তের। কেউ কেউ আবার বেঁচে থেকেও মৃতের মতো জীবন কাটায় এই বনভুমিতে। এরা বাঘ বিধবা। মাছ, গোলপাতা, মধু বা কাঠ সংগ্রহে বনের ভেতরে গিয়ে বাঘের থাবায় প্রাণ হারায় যে পুরুষ তার স্ত্রী পায় এই উপাধি, যেন স্বামীর বাঘের পেটে যাওয়ার পেছনে সে দায়ী; হয় সমাজচ্যুত, কেউ মেশে না, কোন ক্ষেত্রে নিজ গর্ভের ছেলেরাও ছেড়ে যায়। স্বামী বনে গেলে স্ত্রীদের চুল আঁচড়ানো বারণ, তেল মাখা বারণ, খোলা চুলে চলাফেরা বারণ, সাবান ব্যবহার বারণ, রান্নার জন্য মরিচ পোড়ানো বারণ কিন্তু এসব মেনে চলার পরও যখন কারো স্বামী বাঘের আক্রমণে মারা যায়, সমাজ বলে, স্ত্রীর ব্রত পালনে কোথাও গাফিলতি আছে; সমাজ আরও বলে এরা অপয়া, অলক্ষ্মী, কুলক্ষনা। দুর্বিসহ পরিবেশের ভেতরে বেঁচে থেকে এরা কপালে হাত দিয়ে ভাবে মৃত্যু হবে কবে?
বাঘে মানুষ মারে, কুমীরে মানুষ মারে, সাইক্লোনে মানুষ মারে কিন্তু মানুষ কি মানুষ মারতে পারে; এ প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয়রা বলে কখনোই না। সম্পূরক প্রশ্ন তখন এসে যায় বাঘের হাতে মরে যাওয়া মৌয়াল, বাওয়াল এবং জেলেদের স্ত্রীদের কেন তাহলে ভিটে ছাড়া করা হয়, কেন তাদেরকে স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়; যে প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হয় স্থানীয়রা কিন্তু পর মুহূর্তেই তা কাটিয়ে বলে এরা স্বামীখেকো আর শোনায় সোনামণির কাহিনী। বলে সোনামণি রাক্ষস; ১৯৯৯ সালে তার স্বামী বাঘের থাবায় মরে, কোলের এক মাসের বাচ্চাসহ তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয় গ্রাম থেকে, পরে তার দেবর তাকে বিয়ে করে কিন্তু ২০০৩ সালে তাকেও বাঘে নিয়ে যায়। এখন সে কই জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানায় শ্বশুরবাড়ীর লোকরা এই পরিক্ষীত অপয়াকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতো যাতে তার মুখ দেখে কারও ভাগ্য খারাপ না হয়।
বোঝা যায় সোনামণি সেলেব্রিটি এ অঞ্চলে তাই তাকে খুঁজে পাওয়া কষ্ট হয় না। অপরাধবোধের বোঝা নিয়ে, শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায় গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে সে বলে স্বামী বাঘে নেছে তাই মাননুষ ঘেন্যার চকি দ্যাখে, মিশতি চায় না। দু ছেলে ও দু মেয়ে আলাদা হইয়েসে, আমাকি দ্যাখে নি। প্রশ্ন করে - ঘর দোর নি, অর্থকড়ি নি, বাচপো কেম্যায়? ধুঁকে ধুঁকে জীবন চলা এ নারীর সামনে বেশীখন দাঁড়ানো যায় না, আত্মা ফুঁড়ে যন্ত্রণা আসে তাই বেরিয়ে এসে চায়ের দকানে বসা শ্রেয় মনে হয় যেখানে সন্ধ্যায় স্থানীয়রা এসে সিগারেট ফুঁকে, চা পান করে আর জীবন যুদ্ধ নিয়ে আলাপ চারিতা চালায়। বনে বাঘের সংখ্যা কত হতে পারে জানতে চাইলে স্থানীয়রা বলে সাদা চামড়া এসে মাঝে মাঝে গুনে। বাঘ দেখে এরা ভয় পায়, সাদা চামড়া দেখলে এরা আনন্দিত হয়। বুবার্ট হেনড্রিকস ১৯৭৫ সালে সুন্দরবনে অবস্থান করে সরেজমিন জরিপ চালিয়ে জানিয়েছিলেন ৩৫০টি বাঘ আছে বনে; ১৯৮২ সালে মার্গারেট স্যালটার বলেছিলেন ৪২৫টি বাঘ আছে; ১৯৯৩ সালে ধন বাহাদুর তামাং প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে জানিয়েছিলেন ৩৬২টি বাঘ আছে। কিন্তু ২০১৬ সালে আমেরিকার ইউএসএআইডি ক্যামেরার সাহায্যে গণনা শুরু করে দুই বছর পর জানায় সুন্দরবনে মাত্র ১১৪ টি বাঘের অস্তিত্ব পেয়েছে তারা। এ তথ্য স্থানীয়দের দিলে তারা একটু নড়ে চড়ে বসে এবং শরীর সামনের দিকে এগিয়ে বলে বাঘ তো বাঘই, ধরলে রক্ষা নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২০ রাত ১০:৩০