যখনকার কথা বলছি তখন আমাদের গ্রামে কোন টিভি ছিল না । হঠাৎ একদিন শুনলাম নাটনাপাড়ার জসিম উদ্দিনের বাড়িতে সাদাকালো একটা টিভি এসেছে এবং সেটি বার ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে চালাতে হয় । আর সেটা চার্জ দিয়ে আনতে হয় ৫/৬ মাইল দূরে বামুন্দি অথবা দৌলতপুর থেকে । একবার চার্জ দিয়ে আনলে আট থেকে দশ দিন পর্যন্ত টিভি চালানো যায় ।
তখন টিভি বলতে ছিল শুধু বিটিভি । তবে আমাদের গ্রাম ভারত সীমান্তের অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় কোলকাতার ন্যাশনাল টিভিসহ আরো কয়েকটা বাংলা চ্যানেল আসত । কিন্তু সেগুলো দেখার জন্য বার বার এন্টিনা ঘোরাতে হতো এবং সেটাও ছিল একটা মহা ঝামেলার কাজ । কারণ একজন এন্টিনার বাঁশ ঘোরাতে হতো আর আরেকজন টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে ছবি পর্যবেক্ষণ করে বাঁশ ঘোরানিওয়ালাকে চিৎকার করে বলতে হতো ছবি ঠিকঠাক মত আসছে কিনা ।
এভাবেই শুরু হয়েছিল একটা বিদ্যুৎহীন গ্রামে আমার প্রথম টিভি দেখা ।
তো সেই জসিম উদ্দীনের বাড়ি আমাদের বাড়ির কিছুটা কাছাকাছি হওয়ায় মাঝে মাঝে লুকিয়ে চুরিয়ে আমিও যেতাম সেখানে টিভি দেখতে । তখন আসলে টিভিতে কি অনুষ্ঠান হচ্ছে সেটা বড় কথা ছিল না, টিভিতে ছবি দেখছি, সেটাই বড় কথা ।
তারপর আস্তে আস্তে অনেকের মত আমারও বিটিভির অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটা ধারণা আসল । জানলাম প্রতি মাসের সম্ভবত শেষ বৃহস্পতিবার রাত আট'টার বাংলা সংবাদের পর একটা করে বাংলা সিনেমা প্রচার করে এবং সে সিনেমা অসংখ্য এ্যাডের কবলে পড়ে শেষ হতে হতে রাত প্রায় বার'টা বেজে যায় । আমি ছোট মানুষ, রাত বার'টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকা সম্ভব না । তাই, দশ'টার পর ইংরেজি সংবাদ শুরু হলেই আমাকে বাড়ি চলে আসতে হতো । কারণ ইতোমধ্যে বড় ভাই আমাকে কয়েকবার ওখান থেকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে ।
এরকমই এক বৃহস্পতিবার রাতে সিনেমা দেখছিলাম । ছবির নাম সম্ভবত পিতাপুত্র । পারিবারিক কাহিনী, পিতাপুত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন, পুত্রের ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারছে না পিতা । আর এই ছবিরই নায়িকা ছিল কবরী । প্রথম দেখায় অসম্ভব ভাল লাগা । সেই ছোট মনেও দাগ কেটে গেল । সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম আজ পুরো ছবি না দেখে বাড়ি ফিরব না । কিছু মানুষের চাপাচাপির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম । এরমধ্যে একবার লক্ষ্য করলাম, বড় ভাই আমার নাম ধরে ডাকছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাকে । কিন্তু কোন সাড়াশব্দ না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম । অবশেষে আমাকে না পেয়ে বড় ভাই চলে গেল । এই প্রথম আমি পুরো সিনেমা দেখে শেষ করলাম । এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি !
এর অনেক বছর পর পাশের গ্রামে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওদের টিভিতে দেখলাম রাজ্জাক-কবরীর 'নীল আকাশের নিচে' ছবিটি । তখনো আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি । তবে কেউ কেউ ব্যাটারি দিয়ে টিভি দেখা শুরু করেছে ।
এরপর নায়িকা কবরীর বেশ কয়েটা সিনেমা দেখা হয়েছে । ততদিনে জেনে গেছি মিষ্টি মেয়ে কবরী সম্পর্কে অনেক কিছু । শুধু জানা হয়েছিল না মিষ্টি মেয়ের এই নায়িকার জন্যে আমার ভেতরেও ভালবাসার একটা জায়গা ছিল । আজ ঘুম থেকে উঠে তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সেটা উপলব্ধি করলাম ।
ওপারে ভাল থাকুক মিষ্টি হাসির প্রিয় নায়িকা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০৮