মনে পড়ে সেই লালন ভাস্কর্যের কথা? সেই বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন? সেই বলাকা ভাস্কর্য? সেই ধর্মান্ধ মানুষগুলোর আস্ফালন, হুংকার?
হঠাৎ মনে পড়লো... মনটা এমনি খারাপ ছিলো, আরো খারাপ হয়ে গেলো। যেদিন লালন ভাস্কর্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়, কার কাছ থেকে প্রথম শুনেছিলাম মনে নাই। নিজের ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করলাম। তাগিদ অনুভব করলাম রুখে দাঁড়ানোর। প্রতিবাদ করার... এ যেন সেই জোর করে চাপিয়ে দেয়া ঊর্দু! নিজের কন্ঠকে রোধ করে দেবার পাঁয়তারা। জড়িত ছিলাম ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে বড়ো ক্লাব "সাংস্কৃতিক সংঘের" সাথে। সব স্থানে আস্তে আস্তে আন্দোলন দানা বাঁধছে। সরকারী ইউনিভার্সিটি গুলোতে তো তান্ডব বয়ে যাচ্ছে! আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে কি কিছুই করতে পারিনা?
গেলাম ভার্সিটির তৎকালীন প্রো-ভিসি স্যারের সাথে দেখা করতে। ভার্সিটির পক্ষ থেকে একটা মানব বন্ধন করার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। সাথে ছিলো ভার্সিটির ক্লাবগুলোর কয়েকজন প্রতিনিধি। তিনি বললেন, এটা বিতর্কিত বিষয়, ভার্সিটি এখানে কোন পক্ষে অবস্থান নিবে না। তাঁর সুন্নতি দাঁড়ি দেখে আগেই আঁচ করেছিলাম এমনটিই হবে। স্যারকে টপকে গেলাম ভিসি স্যারের কাছে, তিনিও একই কথা বললেন... ততদিনে আমি ডেট দিয়ে জনে জনে বলে প্রায় দুহাজার ছাত্রকে জানিয়েছি মানব বন্ধনের কথা। এখন তো পিছিয়ে আসা যায় না! "সচেতন ছাত্র সমাজের" ব্যানারে মানব বন্ধন করবো বলেই ঠিক করলাম। রাস্তা তো আর ভার্সিটির না! সেখানেই তো আমরা দাঁড়াবো! আরো জোরে শোরে শুরু করলাম ক্যাম্পেইন। যেহেতু ভার্সিটি অনুমতি দেয়নাই, সেহেতু কোন পোস্টারও লাগাতে পারছিলাম না! তখন হিজবুত তাহরীর সবে মুখ ফুটে উঠতে শুরু করেছে ভার্সিটি তে। সাথে কয়েকজন টিচারও জড়িত। হিতা থেকে হুমকি আসা শুরু হলো। বললো বোম মারবে মানব বন্ধনে। বললাম, মারো, কোন ব্যাপার না। কিন্তু আমি ছাড়া আর কারো গায়ে বোম লাগলে খবর আছে, আর আমার ঐসব বোম খেয়ে অভ্যাস আছে!
যেদিন মানব বন্ধন তার আগের দিনও কয়েকবার ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। কাওকে কিছু জানাইনাই। জানতাম এতো সাহস ওদের হবে না। পরেরদিন ৬০-৭০ জনকে নিয়ে ভালো মতোই শুরু ও শেষ করলাম মানব বন্ধন। অনেকেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেদিন... অনেকে দূর থেকে দেখেছে, সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু কাছে আসেনি...প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আসলে এমন আন্দোলনের কোন কালচার নেই, তাই বেশীরভাগই এড়িয়ে গিয়েছে।
শেষ হওয়ার পর হিতার ভার্সিটিতে যে দ্বায়িত্বে ছিলো, সে এগিয়ে এসে কনগ্রাটস জানালো, কিছুটা বিদ্রুপের সাথেই। দূর্ভাগ্য, তখন এক হিতা পন্থী টিচারের কোর্স করতেছি। উনি ক্লাসে এসেই আমাকে ব্যাক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলতেন। তাঁর পুরাতন কিছু ইতিহাস আছে হিন্দু ছেলেদের ফেল করিয়ে দেয়ার। আস্তে করে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসতাম... পরে ক্লাস করাই ছেড়ে দিলাম...
এরই মাঝে একদিন ফোন এলো একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে, বললো, ভাই একটু ক্যাম্পাসে আসেন সচেতন শিল্পী সমাজ থেকে কয়েকজন এসেছেন ভার্সিটিতে সচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে। আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান। গিয়ে দেখি আনুশেহ দি, সুমী আপা, সুব্রতদা, তপুদা সহ আরো অনেকেই এসেছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই অপূর্ব গান "ধন-ধান্যে পুস্পে ভরা..." নিয়ে আমরা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করলাম। যখন নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা রাখছেন, তখন চিন্হিত কিছু হিতা ছেলে সরাসরি গালাগালি করতে করতে ঝগড়া বাধিয়ে দিলো। আমরা যারা ক্যাম্পাসের তারা ব্যাপারটা ট্যাকল দিলাম... উনারা চলে যাবার সময় আমাদের মূল চারুকলা ভিত্তিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হতে বললেন। কথা দিলাম এবং জড়িয়ে গেলাম বড়ো কঠিন ভাবেই! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে কি এক আবেগ, এক মোহ জড়িয়ে ফেললো আমাদের এক অদৃশ্য মায়ার সুতোর বাঁধনে.. এরই মাঝে নাম পরিবর্তন হলো আন্দোলনের, হলো বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন।
সে এক আবেগী মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রাণের টানে মনের টানে আমাদের মিছিলটি দিন দিন বড়ো হতেই থাকে!
বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচীর মাঝে বুকের সাথে জড়িয়ে থাকেন কিছু মহৎহৃদয় মানুষ! সুব্রতদার অসাধারণ ভালোবাসা আর নেতৃত্ব, তপুদার বজ্রকন্ঠ, কফিলদার আবেগ, আনুশেহ দি, কৃষ্ণকলি দি, রাহী ভাই, মাকসুদ দার গান ছিলো আমাদের উজ্জ্বীবনি! আমরা ৬টা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়ে জড়িত ছিলাম আন্দোলনের সাথে। আমরা নিজেদের উদ্যোগে ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে আয়োজন করে ফেললাম এক বিশাল প্রোগ্রামের। সফল হবার পর আমাদের আনন্দ আর উল্লাস দেখে কে!
সরকার মানলো না, মানলো না প্রাণের দাবি। ভেংগে ফেললো লালন ভাস্কর্য! আমাদের বুকের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলো সেই ভাংগা টুকরোগুলো... এর মাঝে আন্দোলন কর্মীদের মাঝে অন্তর্গত কোন্দলে ভাগ হয়ে গেলো আন্দোলন... চোখের সামনে এক মহৎ উদ্যোগ নিমিষেই হয়ে গেলো ধুলিসাৎ। হেরে গেলাম আমরা "নুমানি" নামের পাকিস্তানি চরের বাংলাদেশকে অস্থির করার পরিকল্পনার কাছে। (আহমদিয়াদের উপর হামলাতেও এই নুমানি নেতৃত্ব দিয়েছিলো)
আস্তে আস্তে কমে গেলো মানুষের চলাচল সেই বকুলতলায়। আগের মতো আর জমেনা গান কার্তিদা-কনকদার... ধুলো-মাটিতে জন্মাতে থাকে ঘাস...
আর পড়ে থাকে আমাদের কিছু দীর্ঘশ্বাস!
বাংলার সংস্কৃতির আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে পড়ুন।
সে সময় পোস্টারের জন্য লেখা আমার কয়েকটি স্লোগান-
কোন পথে এই স্বদেশ আমার
কোথায় লালন গান?
বুড়ো শকুনে ধরেছে খামচে
কে বাঁচায় তার প্রাণ?
একতারাটার তাঁর ছেড়া আজ
ঢোলের পর্দা ফাটা
"নারায়ে তাকবীর" হুংকারে সব
মুখের দরজা আঁটা।
কোথায় হাসন, লালন, করিম
কোথায় খোদাবক্স সাঁই,
তোদের লাশের ওপরে নাচে
শকুনে হায়েনায়...
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৩:১৭