আজ ওর জন্য একটা প্রেমের গল্প লিখলাম। রামু এটা তোমার জন্যও।
ইয়াকুত আজ একটা বড় বিপদে পড়েছে। ছোটি খাটো বিপদে পড়লে ও সাধারণত রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে। কিছু ক্ষণ আগেও তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওড়েছে---- "বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা।বিপদে আমি না যেন করি ভয়।" কারণ ভেবেছিল- বিপদটা বুঝি বেশ ছোট খাটো।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন আর সেরকম মনে হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এই মুহূর্তে কোন কাজেই আসছে না। তাই আল্লাহকে ডাকা শুরু করেছে। ওর যে বিপদ তাতে এখন আল্লাহই একমাত্র ভরসা।
এই সকালবেলা ইয়াকুত একটা মিশন নিয়ে বের হয়েছে। অফিস যাবার বদলে যাচ্ছে মিরপুরে। সঙ্গে তার ব্যাক্তিগত ড্রাইভার। মানে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত গাড়িখানা নিয়ে বের হয়েছে। ইযাকুত জানে, এই মিশনের উপর নির্ভর করছে ওর সমগ্র জীবন।
আপা এইটা তো একটা চিপা গলি, গাড়ি নিয়া ঢুকতে পারমু কিনা সন্দেহ আছে।
একটু চেষ্টা করে দেখেন না- মালেক ভাই। ইয়াকুত নরম কণ্ঠে বলে। এই এলাকাটা খুবএকটা চেনে না সে। আজই প্রথম এসেছে।
ছেলেটা যে কই থাকে, আল্লাহই জানে। আধাঘন্টার উপরে মিরপুর সাড়ে এগারো তে গাড়ি নিয়ে ঘুরছে। ঢাকা শহরে বাড়ি খোঁজা যে এত কষ্টের, ইয়াকুত আগে বুঝতে পারেনি।
চেষ্টা করেও মালেক গাড়ি ঢোকাতে পারে না। অগত্যা গলির মুখে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে আরও কিছুটা পথ সামনে এগোয় ইয়াকুত। গলির শেষ মাথায় চায়ের দোকানটার পাশে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ইয়াকুত ডাকে- এই যে ভাই শোনেন?
এখানে ছোটনদের বাসাটা কোথায়? বলতে পারবেন। এই যে বাসা নম্বর।
ইয়াকুত একটা কাগজ এগিয়ে দেয়।
ছেলেটা বাসাটা দেখিয়ে দেয়। যাক বাবা পাওয়া গেল তাহলে। এটা এখন সে যাকে খুঁজছে সেই ছোটনদের বাসা হলেই হয়।!
দুবার ডোরবেল দেবার পর, মৃদু আওয়াজে দরোজাটা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটখাটো একজন মধ্যবয়সী নারী। চেহারায় কেমন সেলিনা হোসেন, সেলিনা হোসেন ভাব আছে। মুখটা মায়াময়। ওঁর যৌবনে বেশ সুন্দরী ছিলেন - দেখলেই বোঝা যায়।
ইয়াকুতের চিনতে ভুল হয় না। সব মায়ের চেহারাই অনেকটা এরকমই হয়।
খালাম্মা স্লামালেকুম।
এটা কি ছোটনদের বাসা?
মহিলা ইতিবাচক মাথা নাড়েন।
মহিলার কপালে অস্পষ্ট অপরিচিত জনকে দেখার ছায়া পড়ে, তোমাকে তো ঠিক--
খালাম্মা আমার নাম ইয়াকুত। আমি ছোটনের সঙ্গে কাজ করি। ছোটন তিন দিন ধরে অফিস যাচ্ছেনা, তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নিয়ে যাই।
একদমে কথা শেষ করে সে।
ও আচ্ছা, এসো মা ভেতরে এসো। মহিলার কণ্ঠে উষ্ণতা ঝরে পড়ে।
ছোট্ট ছিমছাম ড্রইং রুমের একটা সোফায় বসতে বসতে- ইয়াকুত আবার প্রশ্ন করে, ছোটন কি বাসায় আছে? ওর শরীর ভালো?
মহিলা ইয়াকুতের উৎকণ্ঠায়, স্নেহের হাসি হাসেন।
হ্যাঁ মা ও ভালো আছে। ও ঘুমাচ্ছে। তুমি বসো আমি ডেকে দিচ্ছি।
মহিলা যাবার জন্য উদ্যত। ইয়াকুত আবার থামায়---- খালাম্মা, আমি কি ওর সঙ্গে ওর ঘরে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?
মহিলা, এক পলক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন-- তারপর মৃদু হেসে বল্লেন-- ঐ যে মা ঐদিকে ওর ঘর।
তীর একবার ছোড়া হয়ে গেছে। ওর আর কিছুই করার নেই।
খুব অস্বস্তি নিয়ে, ধীর পায়ে ইয়াকুত দরোজায় টোকা দেয়।
বেশ ক'বার টোকা দেবার পর-- দরোজাটা খুলে যায়। ছোটন ভূত দেখার মত চমকে ওঠে।
তোতলায়-- আ আপনি? এত সকালে? এখানে?
-যান তো ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর কথা হবে।
ছোটন ভীষন বিব্রত ভঙ্গিতে ঘরের এদিক ওদিক তকিয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে, বের হয়ে যায়।
-ঘরের ভেতর ঢুকতেই বিপরীত দেয়ালে ঝোলানো, চে গুয়াভারার বিপ্লবী মুখটা চোখে পড়ে ইয়াকুতের।
মেঝেতে বিছানা। মশারীটা খুব অযত্ন করে লাগানো। মশারীর একটা কোনা অসমানভাবে ঝুলে আছে। ঘরময় নানান বইয়ের স্তুপ।
কোনায়, ছোট্ট স্টিরিও সেটটার কাছে ছড়ানো অনেক সিডি। স্টিরিওটার পেছনে পুরানো একটা গীটার দাঁড় করানো। কম্পিউটারটা মাথার কাছে। সিঙ্গল ওয়াড্রোবটার একটা ড্রয়ার আধখোলা।
এ্যাশট্রে উপচে পড়ছে-- সিগারেটের শেষাংশে। এখনও এই ঘরটিকে এক্কবারে পারফেক্ট একজন ছাত্রর ঘর বলা যায়। কোথাও বসবার জায়গা না পেয়ে, বিছানার এক কোনায় চাদরটা একটু টেনে ঠিক করে আয়েস করে বসে ইয়াকুত অপেক্ষা করে ছোটনের জন্য।
বেশ অনেকক্ষণ পরে ছোটন একটা ট্রেতে দু কাপ চা আর হাল্কা নাস্তা নিয়ে ঢোকে।
শোভন দূরত্ব রেখে ছোটন বিছানায় ইয়াকুতের মুখোমুখি বেশ লাজুক ভঙ্গিতে বসে।
এটা আপনার ঘর?
প্রশ্নের ধরণে ছোটন হাসে।
আপনি হঠাৎ কি মনে করে?
আপনাকে গান শোনাতে এসেছি।
মানে? এটা আবার কি ধরণের কথা হল?
হল না? তাহলে বলি, আপনাকে দেখতে এসেছি।
আপনি আজ তিন দিন অফিসে যান না । কেন?
ও আচ্ছা আমি তো চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি।
বাহ! দারুণ তো। একদম মিলে যাচ্ছে।
মানে?
তখন থেকে মানে মানে করছেন কেন?
আপনাকে আমি আসলে একটা কথা বলতে এসেছি।
মনে মনে ছোটন একটু বিরক্ত হয়। এই হল বড় লোকের বাচ্চা-কাচ্চার একটা সমস্য।
নিজেরা যে অন্যের সমস্যা তৈরী করে, এটা তারা কখনই ধরতে পারে না। মন যা চায়, তাই করার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে।
মাকে সামলাবে কি করে, সেই চিন্তায় ছোটন অস্থির, আবার এই মেয়ে এখন নাটক করছে।
কি বলবেন, প্লীজ তাড়াতাড়ি বলুন। নিন চা নিন। তারপর যা বলবার সংক্ষেপে বলে, বিদায় হন।
ছোটন বুঝতে পারে ওর মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। একেতো হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেছে, আবার ঘুম থেকে ওঠার পর এখন পর্যন্ত একটা সিগারেটও খাওয়া হয়নি।
আচ্ছা আমি সরাসরি বলছি। ইয়াকুত স্পষ্ট চোখে তাকায়, ছোটনের দিকে।
আপনার সাথে কাজ করছি, তিনমাস হল। এই তিনমাসে আপনাকে যতটুকু দেখেছি, আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।
আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি রাজী থাকলে আমি আমার মাকে পাঠাবো, আপনার মা'র কাছে।
এই পাগল বলে কি? আপনার মাথার ঠিক আছে? আর তিনমাসেই আমাকে চিনে ফেল্লেন?
-সারাজীবন এক সঙ্গে থাকলেই কি মানুষ চেনা যায়?
আপনার কি মনে হয় না, আপনি একটু বাড়াবাড়ি করছেন?
-হ্যাঁ, একটু না অনেকখানি বাড়াবাড়ি করছি। সেইজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনাকে এইভাবে বলা ছাড়া আমি আর কোন পথ পাচ্ছিলাম না।
কেন? ছোটনের কণ্ঠে পরিষ্কার বিস্ময়!
-আপনি রবীন্দ্রনাথের লিপিকা পড়েছেন?
ঐ যে একটি লোককে স্বর্গের দূতরা মার্কা ভুল করে, কেজোদের স্বর্গে নিয়ে আসে। এরপর লোকটি যেখানেই যায়, সবাই তাকে সরে যেতে বলে--কারণ সবাই খুব ব্যাস্ত।শুধু এ লোকটিরই কোন কাজ নেই।
অকেজো লোকটি আর কি করবে? ঝর্ণাতলায় গিয়ে বসে থাকে। সেই ঝর্ণায় রোজ স্বর্গের মেয়েরা জল নিতে আসে।
অকেজো লোকটি মেয়েদের জল তোলার পাত্রে ছবি এঁকে দেয়। চুল বাঁধার রঙ্গিন ফিতা বুনে দেয়। এমন সব কাজ করে, যার কোন মানে নেই।
মেয়েরা এসব দেখতে গিয়ে কাজে ভুল করে বসে। মন উদাস করে থাকে।
তারপর কেজোদের স্বর্গে ঐ ভুল লোকটির বিচার হয়। তারা লোকটিকে বিদায় করে দেয়--- লোকটি চলে যাবার সময় দেবতারা দেখলেন, স্বর্গের মেয়েরাও লোকটির সাথে স্বর্গ ছেড়ে চলে যেতে চায়। স্বর্গে এই প্রথম এমন একটি ঘটনা ঘটে যার কোন মানে নেই।
আপনি আমার চোখে সেই ভুল লোক। যার জন্য আমি স্বর্গ ছাড়তে রাজি আছি।
এই আমার ফোন নাম্বার-- ০১৭১------
যদি আমাকে কখনও ফোন করেন, আমি ধরে নেব- আপনি রাজী। আর আমার মাকে বলবো আপনার মা'র সঙ্গে দেখা করতে।
এরপর ছোটনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়াকুত বিদায় নেয়।
গত ১৫ দিন ধরে ছোটনের প্রায় দূর্দিন চলছে। দিনে কম করে হলেও মা একবার মেয়েটার খোঁজ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারপরও ছোটন সব চালিয়ে নিচ্ছে কারণ মা এখনও বাংলা সিনেমার ডায়ালগ দেওয়া শুরু করেনি।
"ছেলের বউ না দেখে মরতে চাইনা টাইপের--"
মা রীতিমত গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছে। কাছের বন্ধুদের বলে বেড়াচ্ছে, মেয়েটার একটু খোঁজ নাওতো? সেই যে গেল ---- ইত্যাদি নানান রকমের যন্ত্রনা।
ছোটনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সম্প্রতি বিয়ে করেছে। বউ যখন থাকে তখন তার টিকির নাগাল পাওয়া যায়না।
ক'দিনের জন্য বউ গেছে বাপের বাড়ি। এবার বান্দার দেখা মিললো। সে রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে একদিন এলো আমার বাড়িতে। ছোটন ভেবেছিল, ওকে একটু বুঝিয়ে বলবে। বল্লো- মাকে একটু বল্ আমার চালচুলোর ঠিক নেই- চাকরী নেই। বউকে খাওয়াবো কি?
এসব সাত-পাঁচ শুনে বন্ধু দা'ত কেলিয়ে বল্লো--- তোর তো উইকেট পড়ে যাচ্ছে হে!
মানে?
মেয়েটার কোন খোঁজই নিচ্ছিস না আবার বিয়ে করে খাওয়াবি কি এসব নিয়েও ভাবছিস। কথার এখানেই ইতি টানতে হল।
ছোটন মনে মনে ভাবে, আসলেই কি আমি খোঁজ নিচ্ছিনা?
এ মেয়ে ভারী ডেঞ্জারাস। ইদানীং আমার স্বপ্নেও হানা দিচ্ছে। কিন্তু বন্ধুকে বলার সাহস হচ্ছে না। তাহলে মা'র কান পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যাবে।
এত দূরাবস্থার মাঝেও একটা ছোট্ট সুখবর হল ছোটন এর মধ্যে একটা চাকরী আবার কেমন করে যেন জুটিয়ে ফেলেছে। সব প্রায় ঠিক হয়ে যাচ্ছিল-- হঠাৎই একটা দূর্ঘটনা ঘটে যায়-- আসলে নিয়তির উপর কারও হাত নেই------------
ছোটন নতুন অফিসের কাজে মোটামুটি ব্যস্ত। এর মধ্যেই একটা বিশেষ প্রয়োজনে ইয়াসীন ভাইকে ফোন করতে গ্রামীণের নম্বরটা ঘোরায়।
হ্যালো কে? ইয়াসীন ভাই?
- না দুঃখিত আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন। আপনি সেই ভুল লোকটা না?
আমি ইয়াকুত। আমি জানি আপনি আমাকে ভুল করে হলেও ফোন করবেন। এতদিন আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
শোন ইয়াকুত-----
বলুন, তবে কাল সকালে আমার মা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
ইয়াকুত শোন
বলুন?
তোমাকে নিয়ে এক'দিন আমি খুব ভেবেছি।
---কি পেলেন?
সত্যি শুনতে চাও?
খুব খু---উ---ব শুনতে চাই। আপনার কথা শুনবো বলেই তো এমন তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি।
যদি কোন কঠিন কিছু বলি---
--- আমি কঠিনের সাথে একবার লড়াই করতে চাই। শুধু একবার সংশপ্তক হতে চাই।
---শোন মেয়ে, আমি ভুল করে নয়- সত্যি সত্যি স্বর্গচ্যূতি চাই।
যাবে আমার সঙ্গে?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৩:৩০