১৯৮৬ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্ত বর্তমান ইউক্রেনে ঘটে যাওয়া চেরনবিল পারমাণবিক বিপর্যয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার চেয়ে চেরনবিল দুর্ঘটনার তেজস্ক্রিয়তা প্রায় ৪০০ গুন বেশি ছিল। এই দুর্ঘটনার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ৪০০০ এবং দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। দুর্ঘটনার এতো বছর পর আজো বহু লোক সেই তেজস্ক্রিয়তায় ভুগছে। এই পারমাণবিক দুর্ঘটনার ফলে সরাসরি ঝুঁকির মুখে চলে আসে প্রায় ২৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ইউক্রেনে ও বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত চেরনবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে। চেরনবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৪টি পারমাণবিক চুল্লী ছিল, দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটে চতুর্থ চুল্লীটি থেকে। মূলত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ হলো সামান্য পরিমান তেজস্ক্রিয় জ্বালানি ব্যবহার করে সস্তায় বিপুল পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হয়। কিন্তু হটাৎ যদি কখনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে লোডশেডিং হয় তখন কি ঘটবে ? সেরকমই এক নিরাপত্তাজনিত পরীক্ষা চালানোর সময় চেরনবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে। এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদেরকেই দায়ী করা হয়, কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল নয়। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে চেরনবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে পরীক্ষাটি চালানো হচ্ছিলো সে ধরণের পরীক্ষা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার আগেই সম্পূর্ণ করার নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নিয়োগ প্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্টান এই পরীক্ষা না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র উপযোগী বলে ঘোষণা করে। তখন চেরনবিল কর্তৃপক্ষ দ্রুত নির্মাণ কাজ শেষ করার কৃতিত্ব দেখাতেই বিনা অনুসন্ধানেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার অনুমোদন দেয়। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পর ১৯৮২, ৮৪ ও ৮৫ সালে এই পরীক্ষা চালানো হয় কিন্তু প্রতিবারেই কোন না কোন ত্রূটির কারণে পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়। তাই ১৯৮৬ সালে কর্তৃপক্ষ পুনরায় পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় আর তখনি ঘটে এই মহাবিপর্যয়।
পারমাণবিক চুল্লির নিরাপদ শীতলীকরণের এই পরীক্ষা চালানোর কথা ছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল দিনের বেলা। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে আনা অতি জরুরি। সেক্ষেত্রে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যেসমস্ত জায়গায় এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় সেসব জায়গায় প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু চেরনবিলের আশেপাশের কলকারখানার মালিকেরা এই বিদ্যুৎ ঘাটতি মেনে নিতে চায়নি। তারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে পরীক্ষাটি রাতের বেলা করতে। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন চেরনবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার "এনাতলি দিয়াতলভ"। তিনি বার বার এই পরীক্ষা চালিয়ে ব্যর্থ হবার কারণে তার পদোন্নতি আটকে ছিল। তিনি চাচ্ছিলেন সে রাতে কোনোমতে পরীক্ষাটি শেষ করে তার পদোন্নতি নিশ্চিত করতে। তাই এরকম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চালানোর জন্য যে ধরণের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার তার কোনোটাই ঠিকমতো গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি সেসময় যারা চুল্লিঘর পর্যবেক্ষণে ছিল এবং সে রাতের শিফটে দিয়াতলভের সাথে যারা কন্ট্রোল রুমে ডিউটিরত ছিল তারা কেউ কেউ জানতোইনা তারা এত বড়ো একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। এর কারণ হলো এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য যে পরিমান অভিজ্ঞতা দরকার সেই শিফটের অধিকাংশ কর্মীরই সে ধরণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
চেরনবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ নম্বর চুল্লির নিরাপত্তা পরীক্ষাটি চালানোর জন্য ১৯৮৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাত এগারোটার দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। পারমাণবিক বিক্রিয়ার শক্তি হ্রাস করানোর জন্য চুল্লিতে কিছু কলাম প্রবেশ করানো হয়। এসব কলাম ফিউশন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন নিউট্রন শোষণ করে তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমান দ্রুত কমে যায়। কিন্তু অনভিজ্ঞ কন্ট্রোল রুম অফিসারেরা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক কলাম চুল্লিতে প্রবেশ করায় , যার ফলে চুল্লি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরবর্তীতে কলামগুলো দ্রুত চুল্লি থেকে সরিয়ে নিলে ২৬ এপ্রিল রাত একটার দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায় চলে আসে। রাত একটা তেইশ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ শতাংশে আসার পর পরীক্ষা শুরু হয় কিন্তু পরীক্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথে চুল্লির উৎপাদন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। হটাৎ করে মোট শক্তির পরিমান বিপদজনক পর্যায় চলে আসে কারণ চুল্লিতে তখন ৩০টি কলাম থাকার কথা থাকলেও সে সময় চুল্লিতে নিয়ন্ত্রণকারী কলাম ছিল মাত্র ৬টি। এসময় চুল্লি ঠান্ডা করতে টারবাইনে প্রচুর পরিমান পানি প্রবেশ করানো হয়। কিন্তু সরবরাহকৃত পানি অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়ায় তা সহজে বাষ্প না হয়ে উল্টো চুল্লির তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকে। একসময় উৎপাদিত শক্তির পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে ১০০ গুন বেশি বৃদ্ধি পায়, এর ফলে দুটি বড়ো আকারের বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের ফলে চুল্লির তেজস্ক্রিয়তা রক্ষাকারী গম্বুজ আকারের ছাদ ভেঙে পড়ে এবং তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বাহিরে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করে।
জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার চেয়ে চেরনবিল দুর্ঘটনার তেজস্ক্রিয়তা প্রায় ৪০০ গুন বেশি ছিল। চেরনবিল পারমাণবিক চুল্লি বিস্ফোরণের ফলে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আশেপাশের প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকির মধ্যে চলে আসে প্রায় ২৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। তবে চেরনবিলের ঝুঁকি সম্পর্কে বুঝতে হলে আমাদেরকে আগে বুঝতে হবে তেজস্ক্রিয়তা কি ? তেজস্ক্রিয় পদার্থের একেকটি পরমাণু বন্দুকের গুলি মতো কাজ করে। আর এই তেজস্ক্রিয় পরমাণুর গতিপথে যা কিছু পরে তার সব কিছু ছেদ করে চলে যায়। আর চেরনবিল থেকে প্রায় এমন লক্ষ কোটি পরমাণু বা বুলেট ছড়িয়ে পড়েছিল। এর কিছু পরমাণু প্রায় ৫০ হাজার বছর সক্রিয় থাকতে পারে।
চেরনবিল দুর্ঘটনার সাথে সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ জন কর্মী মারা যায় এবং ২৩৭ জন কর্মী ও দমকল বাহিনীর সদস্য মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তায় আহত হয়ে এক মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। সরকারি হিসাব মতে , এই দুর্ঘটনার স্বল্প সময়ে প্রায় ৪০০০ ও দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৫০ লক্ষ লোক এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ শিশু রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্তের পরিমান অনেক বেশি। বর্তমানে চেরনবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৮০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কেউ বসবাস করে না। চেরোনবিলের ধ্বংসস্তূপে থাকা ২০০ টন গলিত পরমাণু জ্বালানি থেকে যে পরিমান ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে তা কয়েক হাজার বছরেও সম্পূর্ণ শেষ হবে না। এই তেজস্ক্রিয়তা কিছুটা লাঘব করতে ৩৬ হাজার টন ওজনের ৩৫০ ফুট এক ধাতব গম্বুজ স্থাপন করে হয়েছে চেরনবিলের চার নম্বর চুল্লির উপর। এটিই পৃথিবীর সব চেয়ে বড় বহনযোগ্য ধাতব নির্মিত কাঠামো।
বিগত শতকের চল্লিশের দশকে বিশ্ববাসী প্রথম পারমানবিক শক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। তৎকালীন জার্মান বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ ও মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহেইমার একে ওপরের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছিলো পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কারের নেশায়। পরবর্তীতে আমেরিকানরাই প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরী করে পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৫