স্টার সিনেপ্লেক্সে ডজনখানেকবার যাওয়া হইছে, কিন্তু বলাকায় একবারও না। কিছুদিন আগে একটা কাজে নীলক্ষেত গেছি, সাথে ছিল মুভিপাগল এক বন্ধু। কাজটাজ শেষ করে করে ফিরার পথ ধরছি, হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল বলাকার সামনের নামটায়- "ফিরে এসো বেহুলা"। আর যায় কোথায়! টানতে টানতে আমারে নিয়া গেল বলাকা-২ তে। টিকেটের খরচ ও-ই দিল


যারা যাননাই তাগো জন্যে কই, ভেতরটা বেশ লাগল


যাই হোক, ঢুকে আরাম কইরা বসছি, (সামনের সারিতে তিনজন আপু ছিল, তাদের কলকলানি বড় ভাল পাইতাছিলাম :#> :#> ) প্লেব্যাকে পুরানো বাংলা গান বাজছিল। এ দেখি বাজতেই আছে, বাজতেই আছে। যখন মোটামুটি অধৈর্য্য হওয়া শুরু করলাম, তখনি দেখি স্ক্রিনের পর্দা উঠতাছে। এখানে বইলা রাখি, এই ক্ল্যাসিক জিনিসটা আমার খুব ভাল্লাগছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে এই সিস্টেমটা নেই। দুইটা পর্দা ছিল, লাল আর রূপালী। "রূপালী পর্দা" দুই পাশে যখন সরে গিয়ে স্ক্রিন উন্মোচিত হইতাছিল, তখন বেশ অন্যরকম একটা ফিল হচ্ছিল


কিন্তু ফিলিংসটা ভালভাবে উপভোগ করার আগেই দেখি পর্দায় আমাদের লম্বর ওয়ান শাকিব খান বিরাট এক রামদা নিয়া লম্ফঝম্ফ শুরু করছে!! :-& :-& :-& :-& পেছন দিয়ে সেই ৫০ ধরে চইলা আসা কন্ঠস্বর, "শ্রোতা বন্ধু, আসিতেছে..."... যাই হোক, গোটা তিনখান সিনেমার প্রায় পনের মিনিটের অ্যাড দেখতে হইল। একটা আই লাভ ইউ, একটা দারোয়ানের ছেলে, আরেকটার নাম ভুইলা গেছি। এরপর শুরু হইল আজিব এক কান্ড! কিন্ডারগার্টেন থিকা ম্যাট্রিক পর্যন্ত যতোরকম উপদেশ পড়ছি বইতে, সব আমগোরে শিখাইতে লাগল! "সদা সত্য কথা বলিবেন," "গুরুজনে কর নতি", "ধূমপানে বিষপান," "শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড" থেইকা শুরু কইরা আরও একগাদা উপদেশ মনভইরা শুনিলাম।






যাই হোক, টেকনাফ-তেঁতুলিয়া অনেক দৌড়াদৌড়ি করছি, এইবার রাজধানীতে আসি। অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে জাতীয় সঙ্গীত হইল, এবং তারপরই শুরু হইল আমগো সিনেমা- "ফিরে এসো বেহুলা"।


সিনেমাটা যে আর্টিস্টিকভাবে ধারণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা নবীন পরিচালক তানিম নূর করেছেন, তা প্রথম পাঁচ মিনিট দেখেই বোঝা যায়। সিনেমার শেষটা শুরুতে দিয়ে অনেকটা হলিউড ধাঁচের রহস্যময়তা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে পরিচালক সফল।
ওপেনিং ক্রেডিটের সময় মনোযোগ দিলে সিনেমাটা আপনার জন্যে আরও উপভোগ্য হতে পারে। এতে হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবির সাহায্যে ঐতিহাসিক বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী দেখানো হয়েছে। এরপরই শুরু সিনেমার মূল অংশ।
তনিমা(জয়া আহসান) ও হাবীব(ইন্তেখাব দিনার) শহরতলীর এক সুখী দম্পতি। মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটভাবেই চলছিল তাদের জীবন, কিন্তু হঠাৎ করে এক সকালে অফিসের জন্যে বের হয়ে আর ঘরে ফিরল না হাবীব। দরজার নিচে দিয়ে একটা চিঠি পেল তনিমা, যাতে তাকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে রায়পুর স্টেশনে দেখা করতে বলা হয়েছে।
নিজের চেনাজানা জগৎটা মোটামুটি উলটে গেল তনিমার। বুড়ো বাড়িওয়ালা(হুমায়ূন ফরীদি), হাবীবের অফিসের বস(তৌকির আহমেদ) থেকে শুরু করে তার একসময়ের প্রেমিক(শহীদুজ্জামান সেলিম), সবার কাছে সাহায্যের জন্যে ছুটে গেল পাগলের মতো। কিন্তু কেউ তো তাকে সাহায্য করলই না, বরং স্বামী না থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করল। হাবীবের বস পর্যন্ত তাকে সরাসরি কুপ্রস্তাব দিল। থানায় গিয়েও কোন লাভ হল না, উলটো ওসি(মামুনুর রশিদ) তাকে নিয়ে হাসাহাসি করল।
শেষে একাই রায়পুর যাওয়ার জন্যে তৈরী হল তনিমা। তবে সমস্যা হল, রায়পুর স্টেশনটা কোথায় কেউই জানেনা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক স্টেশন মাস্টার(রাইসুল ইসলাম আসাদ) জানাল, রায়পুর একটা পরিত্যক্ত স্টেশন, যেখানে ট্রেন থামেনা। অগত্যা মোটা অংকের ভাড়ার চুক্তিতে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়েই রায়পুর রওনা হল তনিমা।
কিন্তু রায়পুর পৌছেঁ ভয়াবহ এক সত্যের সম্মুখীন হতে হল তাকে। সিনেমার একেবারে শেষ এসে সে উপলদ্ধি করতে পারে, সে আর কাউকে খুঁজছে না। তার সব প্রশ্নের জবাব সে পেয়ে গেছে।
সিনেমাটার দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। একটা হচ্ছে কালো পোশাক পরা দুজন লোক, যে কালো গাড়ি নিয়ে সবসময় তনিমা কে ফলো করে। আরেকটা হচ্ছে তনিমাদের বাসার কাজের মেয়ে নাসিমা। রহস্যময়তা সৃষ্টি করতে এই চরিত্রগুলো অনেকবার উপস্থিত হয়েছে। বিশেষ করে কাজের মেয়ে নাসিমা কে ঘিরেই যে মূল রহস্যটা আছে, সেটা কিছুক্ষণ সিনেমাটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। তবে যারা মোটামুটি হলেও বুদ্ধি রাখেন, তাদের প্রথম আধঘন্টা দেখার পরই সিনেমার রহস্য উন্মোচন করে ফেলার কথা।
জয়া যেই সিনেমায় আছে, স্বভাবতই সেই সিনেমার অন্যতম প্রাণ জয়ার দুর্দান্ত অভিনয়। গেরিলা, ডুবসাঁতারে তা আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে। তবে আমার মনে এই সিনেমাটায় কোন কোন ক্ষেত্রে জয়াকেও ছাড়িয়ে গেছে কাজের মেয়ে নাসিমা(এই অভিনেত্রীর আসল নাম জানিনা)। আমাদের দেশের নাটক বা সিনেমায় সাধারণত বাড়ির কাজ লোকদের ঠিক কাজের লোক মনে হয় না, কিন্তু এই সিনেমাটায় তার অ্যাপিয়ারেন্স এতোই চমৎকার যে আমার মনে হয় যেকোন কাজের মেয়ে চরিত্রের জন্যে মেয়েটি আদর্শ!
হলে ঢুকার সময়ই খেয়াল করেছিলাম পোস্টারে সব রাঘব-বোয়াল অভিনেতার নাম, সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্যই সিনেমাটাকে উৎরে দিয়েছে। প্রত্যেকটা ছোট ছোট রোলের জন্যেও বড় মাপের সব অভিনেতার আনা হয়েছে। তাই বলা যায়, কাস্টিং আর অ্যাক্টিং-এর দিক দিয়ে সিনেমাটায় বিন্দুমাত্র খাদ নেই। রাইসুল ইসলাম আসাদ গলায় মাফলার পেঁচিয়ে, পান চিবুতে চিবুতে যেভাবে স্টেশন মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করলেন তা কতজন করতে পারবে সন্দেহ আছে!
১ ঘন্টা ৫৩ মিনিট সিনেমার কাহিনীর জন্যে একটু বেশি-ই বলতে হবে। মোটামুটি দেড় ঘণ্টায় সিনেমাটা ঠিকভাবে শেষ করা যেত। তাই বুঝতেই পারছেন, জায়গায় জায়গায় বোর ফিল করা অস্বাভাবিক নয়। কাহিনী মাঝে মাঝে এতোই স্লো হয়ে যায় যে দেখার আগ্রহই চলে যায়।
তবে এর ঠিক বিপরীত দিকে আছে চিত্রগ্রহণ, এডিটিং। এক কথায়- অসাধারণ। প্রত্যেকটা শটের মধ্যে যে যত্নের ছাপ আছে, তা মনে হয় শুধু একজন তরুণ পরিচালকের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। পুরনো আমলের লম্বা বারান্দাওয়ালা, উঁচু ছাদওয়ালা বাড়িতে বসে হুমায়ূন ফরীদি টম অ্যান্ড জেরি দেখছে টিভিতে, আপনমনেই হেসে উঠছে দেখতে দেখতে... একদম শেষে শুধু আলোর কারসাজি ব্যবহার করে জয়াকে বোঝানো হচ্ছে যে পৃথিবীর সব পুরুষ ঠিক একইধরনের... ইত্যাদি ক্রিয়েটিভ আইডিয়া আমাদের ছবিতে বড় একটা দেখা যায় না। এখানে আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন, সমাযে একটা একা মেয়ের অসহায়ত্বের কথা কিন্তু ফারুকীও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারে। কিন্তু সেটা ছিল অনেকটা হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমার মূল কনসেপ্ট একই, কিন্তু প্রকাশের ধরন একেবারেই ভিন্ন।
কাহিনীর বিচার করলে সিনেমাটা খুবই সাদামাটা। এই একই ধরনের কাহিনী নিয়ে অসংখ্য সিনেমা হয়েছে, হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, আমাদের দেশে এ ধরনের কাহিনী নিয়ে যতো সিনেমা হয়েছে, তার মধ্যে এটাই সেরা। বিশেষ করে আধুনিককালের তনিমার অভিযান আর স্বামী লখিন্দরকে বাঁচানোর জন্যে বেহুলার অভিযানের মধ্যে তুলনাটা বেশ ইউনিক লেগেছে। বেহুলাকে যেমন অনেক রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্য-দানো পার হতে হয়েছিল, তনিমাকেও তেমনি আধুনিক রাক্ষসদের সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছে তার মর্যাদা রক্ষার জন্যে।
সবশেষ কথা, এতো চমৎকার ক্যামেরার কাজ সত্ত্বেও সিনেমাটা দেখে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি, তার মূল কারণ অহেতুক কিছু কাজকর্ম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাবিব অফিসে যাওয়া থেকে শুরু করে কিডন্যাপের চিঠি পাওয়া পর্যন্ত সময়টা নিয়ে পরিচালক অন্তত ছয়-সাত মিনিট সময় নষ্ট করেছে, যেটার কোনই দরকার ছিল না। আবার চিঠি পড়ার পর জয়ার অতিনাটকীয়তাও একটু বেখাপ্পা লেগেছে। ওহেতুক কিছু আর্টিস্টিক শট দেখানো হয়েছে, যেগুলো স্লো কাহিনীকে আরও স্লো করে ফেলেছে। এতো শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রী না থাকলে হয়তো এসব খুঁত আরও বড়ো হয়ে চোখে পড়ত, তাই এযাত্রা বেঁচে গেছে বলা যায়।
গানের উপর পরিচালক বোধহয় খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তারপরও অর্জুন আর আবিদার কণ্ঠে গানগুলো একেবারে খারাপ লাগেনি।
সিনেমাটার শুরু থেকে শেষ, পুরোটা একধরনের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট চিন্তাধারা প্রকাশ করেছে। অ্যাকশন-ফাইটিং মুভিভক্তরা সম্ভবত তাই এটা দেখে তেমন কোন মজা পাবেন না। হল থেকে বের হওয়ার সময় দু-একজনকে বলতেও শুনলাম, "বেশিরভাগই তো মাথার উপ্রে দিয়া গেল! কি হাই থটের ফিলিম!!"
তবে আমার মনে হয় শুধু উৎসাহ দেয়ার জন্যে হলেও ছবিটা সবার দেখা উচিত। আমরা যদি উৎসাহ না দিই, তাহলে এমন পরিচালকরা আর এভাবে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না, চিরকাল ওই শাকিব খানকে নিয়েই থাকতে হবে।
এইবার বলি শুরুতে আপুদের কথা উল্লেখ করার কারণটা! সিনেমা শেষ করা বাইর হওয়ার সময় প্রথম দুইজনের পর তৃতীয় আপু(যিনি আমার ঠিক সামনে ছিলেন!


এরপর থিকা মনে হইতাছে, ধুর, গোল্লায় যাক সিনেপ্লেক্স!! বলাকার স্টিলের চেয়ার আর চেয়ারের চিপা তার চেয়ে অনেক ভালো!!


সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:৪৬