পূর্বের পর
আবদালীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তিমুর সিংহাসনে বসেন, যিনি ২৩ জন পুত্রের জন্মদান ছাড়া আর কোন অবদান রাখতে পারেননি। এদের মধ্যে ২০ জনেরই একবছরের মাথায় নিজেদের মধ্যে হানাহানির ফলে মৃত্যু হয়। এমন মোক্ষম সময়ে পাঞ্জাবের শিখ শাসক রণজিৎ সিং পারস্য আক্রমণ করেন। ধারণা করা হয়, কোহ-ই-নূরের জন্যেই তিনি এ আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু পারস্যের কোষাগারে পাথরটি ছিল না। হতাশ রণজিৎ সিং লাহোরে চলে যান, সেখানে ২৩ ভাইয়ের সর্বকনিষ্ঠ ভাই শাহ সুজা তাঁর সাথে দেখা করেন। সুজা বলেন যে তিনি কোহ-ই-নূর তাঁর কাছেই আছে, কিন্তু তখনই সেটা ফিরিয়ে দেবেন যখন রণজিৎ সিং তাঁকে পারস্যের শাসক নিযুক্ত করবেন। রণজিৎ সিং রাজি হন। কোহ-ই-নূর তাঁর দখলে আসে, এবং শাহ সুজা ‘সুজা-উল-মুলক’ নাম ধারণ করে পারস্য শাসন শুরু করেন।
শের-এ-পাঞ্জাব নামে খ্যাত রণজিৎ সিং
১৮৩৯ সালে রণজিৎ সিং্যের মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয় পড়ে। ১৮৪৯ সালে তাঁর পুত্র দুলিপ সিং-এর কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ব্রিটিশ সরকার লাহোরে ব্রিটেনের পতাকা উত্তোলন করে, এবং পাঞ্জাবকেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করে। দুলিপ সিং তার প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশদের সাথে লাহোর চুক্তি করেন, যার প্রধান শর্ত ছিল কোহ-ই-নূর হীরাটি এখন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিপতি মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, কোহ-ই-নূর সম্পর্কিত এসকল কাজের মূল চাবিকাঠি ছিল ভারতে ব্রিটিশ গভর্ণর লর্ড ডালহৌসি।
ডালহৌসি সিদ্ধান্ত নেন, কোহ-ই-নূর ব্রিটেনের রাণীকে উপহার দেয়া হবে ভারতের আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে, তাই তিনি দুলিপ সিং-এর মাধ্যমের সরাসরি রাণীকে পাথরটা উপহার দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে একটা ইস্পাতের বাক্সে ১৮৫১ সালে HMS Medea নামের সামরিক জাহাজে করে কোহ-ই-নূর কে ব্রিটেন পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। পথিমধ্যে জাহাজটা বেশ ভয়াবহ কিছু দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছিল, এবং কলেরায় আক্রান্ত হয়ে জাহাজের সেকেন্ড ইন কমান্ড এফ এম লরেন্স সহ পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী এতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কথিত আছে, লরেন্সের মৃতদেহ তুলতে গিয়ে এক খালাসী তাঁর ওয়েস্টকোটের পকেটে হীরাটি পান, এবং সেটা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দিয়ে আসেন। আন্দাজ করা হয়, লরেন্স সম্ভবত কোহ-ই-নূর চুরি করার পাঁয়তারা করছিলেন। অবশেষে জাহাজটা ধুঁকতে ধুঁকতে পোর্টসমাউথ বন্দরে পৌঁছায়, এবং কোহ-ই-নূর আরও কঠিন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাণীর বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে পৌঁছানো হয়।
১৮৫১ সালের ১৯ এপ্রিল লণ্ডনের হাইড পার্কে সাধারণ মানুষের জন্যে কোহ-ই-নূর উন্মুক্ত করা হয়, কয়েক লক্ষ মানুষ সেখানে কোহ-ই-নূর দেখতে ভিড় জমায়।
১৮৫২ সালে প্রিন্স অ্যালবার্টের আদেশক্রমে কোহ-ই-নূরের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির জন্যে একে রিশেপ করা হয়, ফলে এর ওজন ১৮৬ ক্যারেট থেকে ১০৫ ক্যারেটে নেমে আসে। এরপর একে রাণী ভিক্টোরিয়ার দু হাজার হীরা বিশিষ্ট একটি ব্রৌচে স্থাপন করা হয়, যা রাণী প্রায়ই পরিধান করতেন। ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর একে রাণী আলেকসান্দ্রার রাজকীয় মুকুটে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা পর্যায়ক্রমে রাণী মেরি এবং রাণী এলিজাবেথের মাথাতেও শোভা পেয়েছে।
হাইড পার্কে কোহ-ই-নূর প্রদর্শন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষ থেকে কোহ-ই-নূর ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু কোনটিই সফল হয়নি। ১৯৯৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতে এলে ভারতের জনসাধারণের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রার্থনা করা হয় কোহ-ই-নূর হীরা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে। রাণী ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দেন, এবং এরপর দীর্ঘ ১৩ বছর পর বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা ও তর্ক-বিতর্কের পর ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অফিসিয়ালি কোহ-ই-নূর ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। ভারতের সর্ববৃহৎ হীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান DHL এর সহযোগিতায় ভারতীয় সরকার এখনও কোহ-ই-নূর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
কোহ-ই-নূরের অভিশাপের ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করেন ট্যাভের্নিয়ার-ই, যা তিনি তাঁর ‘The Six Voyages’ বইতে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি সেটাকে বাবুরের হীরার অভিশাপ নামেই অভিহিত করেছেন, যার শিকার মালওয়ার রাজা, বিক্রমাদিত্য থেকে শুরু করে ইব্রাহিম লোদী, হুমায়ূন, শাহজাহান। কোহ-ই-নূর ছিনিয়ে এনে এঁরা কেউই শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেননি, এবং এদের কারোরই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
বিক্রমাদিত্য মারা গিয়েছিলেন লোদী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে, সিকান্দার লোদী, ইব্রাহিম লোদী দুজনই বিশ্বস্ত মানুষ দ্বারা খুন হয়েছিলেন। হুমায়ূনের মৃত্যু হয়েছিলেন লাইব্রেরীর সিঁড়িতে পা ফসকে পড়ে।
মুঘল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহানই বাবুরের হীরা নিয়ে সবচেয়ে মাতামাতি করেছিলেন। তাঁর জীবনের শেষটাও কেটেছে অসম্ভব কষ্টের মধ্য দিয়ে, নিজ পুত্রের হাতে নির্যাতিত হয়ে বন্দী হওয়ার মধ্য দিয়ে। কথিত আছে, আগ্রার কেল্লার যে ঘরে শাহজাহান বন্দী ছিলেন, তার জানালায় আওরঙ্গজেব কোহ-ই-নূর এমনভাবে রেখে দিয়েছিলেন, যাতে শুধুমাত্র সেটার মধ্য দিয়েই শাহজাহান তাঁর অমর সৃষ্টি তাজমহলের প্রতিবিম্ব দেখতে পান।
এর বিপরীতে দেখা যায় বাবুর, আকবর, জাহাঙ্গীর, আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধ হয়ে জরাগ্রস্থ হয়ে। বাবুর তো পাথরটা হুমায়ূনকেই দিয়ে দিয়েছিলেন, আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময় পাথরটা নিরুদ্দেশ ছিল। আওরঙ্গজেব একে কোষাগারেই রাখেননি, মসজিদে রেখে দিয়েছিলেন। এবং এদের কারও জীবনই কিন্তু হুমায়ূন, ইব্রাহীম লোদী বা শাহজাহানের মতো উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যায়নি। মালওয়ার শেষ রাজা, শাহ তামাস্প এঁরা কেউই কোহ-ই-নূর নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েননি, তাঁদের শেষ জীবনও কেটেছিল স্বাভাবিকভাবেই। মাঝে আবার মাহতার জামাল, মীর জুমলার মৃত্যু হয়েছিল কোহ-ই-নূর নিয়েই বিবাদের কারণে। মীর জুমলা শাহজাহানের কোষাগার থেকে পুনরায় হীরাটি চুরির চেষ্টা করছিলেন, এবং তিনি ধরা পড়ায় তাঁকে শূলে চড়ানো হয়।
নাদির শাহ ও তাঁর পরবর্তী কয়েকযুগে কোহ-ই-নূর নিয়ে প্রচুর মাতামাতি হয়, এবং সর্বশেষ শাহ রুখ ব্যতীত প্রত্যেকেরই মৃত্যু হয়েছে নিজ আত্মীয়ের হাতে। আবদালী সুফী ধরনের মানুষ ছিলেন, হীরার লোভ তাঁর ছিল না। তাঁর পরবর্তী আরও কয়েকযুগ কোহ-ই-নূর ও রাজ্য নিয়ে হানাহানির যুগ। সবশেষে রণজিৎ সিং কোহ-ই-নূর ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়।
রাণী ভিক্টোরিয়াই প্রথম মানুষ, যিনি কোহ-ই-নূর সর্বাত্মক ব্যবহারের পরও কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হননি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকার এখনও পর্যন্ত কোহ-ই-নূরের অভিশাপ সম্পর্কে অবগত, এবং এ অভিশাপকে কেউই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেননি। তাই কোন ব্রিটিশ রাজপুত্র বা রাজার সম্পত্তি হিসেবে কোহ-ই-নূর কখনো গণ্য হয়নি, হয়েছে রাণীর সম্পত্তি হিসেবে।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, সাম্যন্তক মণির এ অভিশাপের শুরু হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে, যিনি ভল্লুকরাজ জাম্বুবানকে মল্লযুদ্ধে হারিয়ে সাম্যন্তক মণি ও জাম্বুবানের কন্যা জাম্বুবতীকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নামে দ্বারকার শাসক সত্রাজিত মিথ্যা রটনা করেন যে শ্রীকৃষ্ণ সাম্যন্তক চুরি করেছেন। ক্ষুদ্ধ কৃষ্ণ সত্রাজিতকে মণিটি দিয়ে দেন, কিন্তু একই সাথে একে অভিশপ্ত করেন অনন্তকালের জন্যে। জাম্ববতীর অনুরোধে তিনি শুধু নারীজাতির জন্যে একে অনুমোদন করেন।
তবে খুঁটিয়ে দেখলে কিন্তু কোহ-ই-নূরের অভিশাপ আরও আগে থেকেই, এর আবিষ্কারক বালক থেকেই শুরু হয়েছিল এর মানুষবধ। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মালওয়ার রাজাও শেষ রাজাও অভিশাপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন, যে কারণে তিনি ককেটুর মণিটি পুনরায় ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। তাই ১৩০৬ সালের একটি মালওয়া শিলালিপিতে এই লেখাটি দেখা যায়- He who owns this diamond will own the world, but will also know all its misfortunes. Only God, or a woman, can wear it with impunity।
কোহ-ই-নূর (১০৮ ক্যারেট)
ট্যাভের্নিয়ারের দেখা কোহ-ই-নূর বা দ্য গ্রেট মুঘল (১৮৬ ক্যারেট)
কোহ-ই-নূরের অপর দুই জাতভাই, দরিয়া-ই-নূর এবং অর্লভের অবস্থান যথাক্রমে বর্তমানে ইরানের সেন্ট্রাল ব্যাংকে এবং রাশিয়ার ক্রেমলিন জাদুঘরে। কোহ-ই-নূরেরই অপর এক জাতভাই মনে করা হয় নূর-উল-আইনকে, যা বর্তমানে ইরানের সম্পত্তি।
সবশেষে একটা কথা। ইতিহাস কথা বলে। কিন্তু যখন একই ইতিহাসের কথা অনেকে বলে, তার মধ্যে কোন কথাটা ঠিক, বের করা মুশকিল। পৃথিবীর আরও অসংখ্য ইতিহাসের মতোই তাই কোহ-ই-নূরের ইতিহাসও রহস্যমণ্ডিত, বিভিন্ন বর্ণনায় বিভক্ত। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক বাবুরনামাকেই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে ধরেন, তবে বাবুরনামারও কিন্তু বিশুদ্ধতার মানদণ্ড নেই। সাম্যন্তক মণিই বাবুরের হীরা কিনা, বাবুরের হীরাই দ্য গ্রেট মুঘল কিনা, এবং দ্য গ্রেট মুঘলই কোহ-ই-নূর কিনা, সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু এর কোন জবাব নেই। তাই মিথ হোক কিংবা বাস্তব হোক... যেকোন একটা ইতিহাসকে সত্যি বলে ধরে নেয়ার বিকল্প নেই।