somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরা : একটি নাটকীয় ইতিহাস - শেষ পর্ব

২১ শে জুলাই, ২০১০ দুপুর ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্বের পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।


ব্যালকনিতে তাঁর প্রিয় আরামকেদারায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।সম্প্রতি তাঁর চতুর্দশ পুত্র জন্মগ্রহণ করেছে।তাঁর ইচ্ছে ত্রয়োদশ পুত্রের নাম যখন রেখেছেন সোমেন্দ্রনাথ,এই পুত্রের নাম রবীন্দ্রনাথ রাখবেন।কিন্তু স্ত্রী সারদা দেবীর ইচ্ছে ছেলের নাম হোক অরুণচন্দ্র।কারণ ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে,সারদা দেবীর ধারণা ঠাকুর পরিবারের এই কনিষ্ঠ সন্তান একদিন অরুণের(সূর্য) মতোই দীপ্তি ছড়াবে।

এককালের তুখোড় বিপ্লবী তরুণ দেবেন্দ্রনাথ এখন প্রৌঢ়।একে একে তিনি পার করেছেন ৪৪ টি বসন্ত।জীবনে কখনোই নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখেন নি,প্রাণাধিক প্রিয় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যে দশদিক ছুটে বেড়িয়েছেন।যার ফল এখন পাচ্ছেন।ইতোমধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য অনেকখানি ভেঙ্গে গিয়েছে,যৌবনের সেই জৌলুস তো নেই-ই,বরং বার্ধক্য যেন তাঁকে একটু দ্রুতই গ্রাস করেছে।

তাঁর প্রাণান্তর চেষ্টায় ঠাকুর পরিবার বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে।দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর যখন কয়েক কোটি টাকার ঋণের বোঝা দেবেন্দ্রের ঘাড়ে পড়ল,তখন তিনি স্বভাবতই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন।বিভিন্ন বড় বড় মানুষ,শুভাকাংখীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে,প্রচুর সম্পত্তি বিক্রি করে কোনমতে তিনি পূর্বের ঋণ শোধ করেন।এরপর জীবন সংসারে দিশেহারা দেবেন্দ্র ভাইয়ের হেফাজতে স্ত্রী-পুত্রকে রেখে ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে।জীবনের রূঢ়তা তাঁকে পুরোপুরি ধর্মকর্ম থেকে সরিয়ে এনেছিল।একমনে ইশ্বরের আরাধনা,মুক্তিলাভের উপায়,তাঁর পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবার জন্যে তিনি বরফরাজ্যে গেলেন।দিনের পর দিন,রাতের পর রাত তিনি হিমালয়ের গুহায় নিবিড় ধ্যানে কাটাতে লাগলেন।

সম্ভব হলে সারাজীবনই তিনি হিমালয়ে সন্ন্যাসী হিসেবে থেকে যেতেন,কিন্তু তিনি বিবাহ করেছেন,তাঁর সন্তানাদি রয়েছে।তাই শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের টানেই একসময় কলকাতায় ফিরলেন দেবেন্দ্রনাথ।ব্রাহ্মধর্ম তাঁর অনুপস্থিতিতে অনেকটাই নির্জীব হয়ে পড়েছিল,তিনি আবার উঠেপড়ে লাগলেন একে জীবিত করে তোলার জন্যে।তবে এবার আর ভুল করলেন না,নিয়মিত আয়-রোজগারের দিকেও মনযোগ দিলেন।এছাড়া তখনও তাঁর মাথার উপর ত্রিশ লক্ষ টাকার মতো ঋণ রয়েছে,সেসবও দ্রুত শোধ করা প্রয়োজন।

ঈশ্বর যেন সত্যি এবার তাঁর সহায় হলেন।পূর্বপুরুষদের মতো ছোটখাট ব্যবসা দিয়ে শুরু করে তিনি দ্রুত তরতর করে উপরে উঠে যেতে লাগলেন।জীর্ণ-শীর্ণ ঠাকুরবাড়ি আবার প্রাণ ফিরে পেল।ঠাকুর পরিবারের দীর্ঘদিনের দুর্দশাও কাটতে লাগল।ব্রাহ্মধর্মের পাশাপাশি সংসার ধর্মও নিপুণভাবে পালন করতে লাগলেন দেবেন্দ্রনাথ।তাছাড়া ততদিনে তাঁর মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছিল।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন,জীবন-সংসার ভুলে শুধু চোখ বুজে ধ্যান করলেই মুক্তি লাভ হয়না।পরিবার-পরিজন সবাইকে নিয়ে সুখে থাকাও মুক্তিলাভের চেয়ে কম হিতকর নয়।

কিন্তু বয়সতো কারও থেমে থাকেনা।যৌবনে দেবেন্দ্র নিজে নেতৃত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ব্রাহ্মসভা করেছেন,ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন।যেসব বাধা-বিপত্তি ধর্মপ্রচারে এসেছে,সেসব দূর করার জন্যে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন কতো ভেবে ভেবে।কিন্তু সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করলে তাকে আর যাই হোক,ঠিক “সূর্যদেবতা” ভাবা যায় না।দেবেন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাই হল।তিনি একা আর যেন টানতে পারছিলেন না,নতুন কোনো নেতৃত্ব অনেক বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।

এমন সময়ই ব্রাহ্মসমাজে আবির্ভাব কেশবচন্দ্র সেনের।সে দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রের একদা সহপাঠী ছিল।

কেশব যেন দেবেন্দ্রর যৌবনেরই আরেক পুনর্জন্ম।কিন্তু তার গতি আরও অবাধ।সব কিছুতেই তার প্রবল উৎসাহ।ব্রাহ্মধর্মকে সে একটা গণ্ডির মধ্যে বাঁধতে মোটেই রাজি নয়।তার ইচ্ছে এ ধর্ম দেশের দেশের আনাচে-কানাচে তো বটেই,দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ুক।পাপবোধ তার মনে অতি প্রবল।বেহালা বাজানোয় সে বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছিল বলে নিজের হাতেই নিজের বহুমূল্য বেহালাটি ভেঙ্গে ফেলেছে।

ব্রাহ্মধর্মের মূল কথাটাও অনেক সরল করে বলে কেশব।সে শাস্ত্রের মারপ্যাঁচের ধার ধারেনা।বলে,আমাদের এই ঈশ্বর জীবন্ত ঈশ্বর।তিনি সকল মানুষের।সকল অবস্থার সব মানুষ ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারে,তাঁর কাছে সবাই সমান।

দেবেন্দ্রনাথের কাছে ব্রাহ্মধর্মে নতুন রক্ত সঞ্চার করা কেশব ধীরে ধীরে পুত্রের চেয়েও প্রিয় হয়ে উঠল।সে কথা বলার সময় দেবেন্দ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।জাগতিক কোনো কিছুর জন্যেই কেশবের কোন লোভ নেই,তার সমস্ত জগৎ ব্রাহ্মধর্মকে নিয়ে।

ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দু ধর্মের প্রতি দেবেন্দ্রের শ্রদ্ধা অভাব ছিল না।তাঁর বাড়িতে দূর্গাপূজা হয়,তিনিও বাধা দেন না।যদিও তিনি নিজে উপস্থিত থাকেন না।বাল্যবিবাহের বিরোধী না হলেও বিধবাবিবাহ তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননা।জাতভেদ তাঁর পছন্দ নয়,তবু এর বিরুদ্ধে সরাসরি তিনি কিছু বলতে চাননা।কিন্তু কেশবের মত আরা টগবগে তরুণ,তারা এতোসব মানবে কেন?তাদের মতে হিন্দুদের কোন গোঁড়ামির স্থান ব্রাহ্মধর্মে নেই।এবং ব্রাহ্মধর্মের আচার্য হিসেবে দেবন্দ্রনাথেরও সেসব গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়।তাদের কথামতই দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারীকে সম্পূর্ণ ব্রাহ্মমতে বিবাহ দিলেন দেবেন্দ্রনাথ।কিন্তু এর সাথে সাথেই সমাজ যেন ফুঁসে উঠল।শালগ্রাম শিলা নেই,পুরোহিত নেই,একে কি বিয়ে বলে!অনেকে একে ব্যভিচার বলে ঘোষণা করল।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসবেন বলে ভেবেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ,কিন্তু তিনিও নিশ্চুপ রইলেন।ব্রাহ্মদের ব্যাপারে তিনি বরাবরই একটু চুপচাপ।আবার ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি যে সব হিন্দুয়ানী মানেন তা নয়।

এ অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথ অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়লেন।এই বৃদ্ধ সিংহের পক্ষে আর এতো চাপ সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না।তিনি অকস্মাৎ ব্রাহ্মধর্মের আচার্য পদ থেকে সরে দাঁডিয়ে নতুন আচার্য হিসেবে ঘোষণা করলেন ২৩ বছর বয়সী কেশবচন্দ্র সেনকে।কেশবের উদ্দামতাই শুধু পারবে এইসব গোঁড়া হিন্দুদের সঠিক জবাব দিতে,দেবেন্দ্র ভাবলেন।

কিন্তু স্বভাবতই অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ,প্রবীণ ব্রাহ্মকে বাদ দিয়ে কেশবকে আচার্য নির্বাচিত করায় ব্রাহ্মদের ভেতর চাপা একটা অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল।কেশবের কার্যক্ষমতা নিয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই,কিন্তু তার বয়সটা যে বড্ড কম!

তবে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।কেশবকে ঠাকুরবাড়িতে স্থান দিয়ে তিনি ব্রাহ্মসমাজ থেকে অনেকটাই দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।যদিও কেশবের সাথে পরবর্তীতে তাঁর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতবিরোধ হয়েছিল,তিনি কেশবের মতকেই সবক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।কিন্তু পুত্রবৎ এ যুবকের উপর তাঁর নিশ্চয়ই কিছুটা অভিমানও হয়েছিল।সেজন্যেই তিনি ইচ্ছে করে কেশবের হাতে ব্রাহ্মসমাজকে ছেড়ে দিলেন।

পরিবারকে প্রথম জীবনকে গৌণ হিসেবে ধরলেও বাকি জীবন পরিবারকে নিয়েই কাটাবেন বলে ঠিক করলেন দেবেন্দ্রনাথ।তাঁর ইচ্ছে ছিল কলকাতা থেকে অনেক দূরে একটি আশ্রম খোলার,যেখানে তিনি মাঝে মাঝে দিনযাপন করবেন।অবশেষে বীরভূমে ভূবনডাঙ্গা নামক একটি স্থানে বিশাল জমি ক্রয় করে ১৮৬৭ সালে তিনি একটি আশ্রম স্থাপন করেন।এই আশ্রমই পরবর্তীকালের বিখ্যাত শান্তিনিকেতন।এছাড়া এ বছর তিনি ব্রাহ্মসমাজের কাছ থেকে “মহর্ষি” উপাধি পান।

কনিষ্ঠ পুত্র রবির যখন চৌদ্দ বছর বয়স,তখন সারদা দেবী পরলোকগমন করলেন।দেবেন্দ্রনাথের বৈচিত্রময় জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন সারদা দেবী,অনেকের মতে তাঁর ভালোবাসাই দেবেন্দ্রনাথকে বারবার সংসারে ফিরিয়ে এনেছে।চৌদ্দটি সন্তানের জননী সারদা দেবী অনেকদিন থেকেই অসুখে ভুগছিলেন,দেবেন্দ্রনাথ তাঁর চিকিৎসার ত্রুটি করেননি।কিন্তু শেষরক্ষা হলনা।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর আশ্রমেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে লাগলেন দেবেন্দ্রনাথ।কনিষ্ঠ পুত্রকে তিনি সবচেয়ে বেশি স্নেহ করেন,সে প্রায়ই পিতার সাথে আশ্রমে আসে।ইতোমধ্যে রবির অতীব তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় দেবেন্দ্রনাথ পেয়েছেন।যদিও তাঁর অন্য পুত্র সন্তানরাও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে এরইমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে ও বিভিন্ন মহলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে,তাঁর ধারণা রবি তাদের সকলকে ছাড়িয়ে যাবে।দ্বিজেন্দ্রনাথ,সত্যেন্দ্রনাথ,জ্যোতিরিন্দ্রনাথ,হেমেন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই সাংস্কৃতিক বিষয়ে গভীর পারদর্শীতা প্রদর্শন করেছে।হেমেন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্র যদিও একটু বেশী রক্ষণশীল,তবু তাঁরা নিজে নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল।হেমেন্দ্রর মধ্যে তার পিতামহ দ্বারকানাথের সকল বৈশিষ্ট্য অত্যুজ্জ্বল।দ্বিজেন্দ্র গান-বাজনার খুব ভক্ত,সে প্রায়ই ছোটবোন স্বর্ণকুমারীর সাথে পিয়ানোতে সুর তুলে গান বেঁধে সবাইকে গেয়ে শোনায়।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অতিশয় সুপুরুষ যুবক।জুড়িগাড়ি থেকে নেমে তিনি যখন রাজপথ দিয়ে হেঁটে যান,অনেকেই ফিরে ফিরে তাকায়।গানবাজনা,নাটকে জ্যোতিরিন্দ্রের খুব আগ্রহ।তিনি রবির মধ্যেও সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখেছেন।তাই বিভিন্ন নাটক রচনায় রবির সাহায্য নেন।তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সাথে রবির বড় খাতির।

রবির অসাধারণ কাব্যপ্রতিভা সবচেয়ে কাছ থেকে অবলোকন করেন কাদম্বরী দেবী।রবি ও কাদম্বরী দেবীর বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়,দুজনকে হঠাৎ দেখলে দেবর-বৌদি বলে মনেই হবে না।রবি এরই মধ্যে তার দুটি বই কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেছে।প্রথম বইটিতে সরাসরি লিখলেও সে “ছবি ও গান” বইটিতে উৎসর্গপত্রে শুধু লিখেছে “তোমাকে”।
শুধু কাব্যগন্থ নয়,রবির সকল কবিতাই সে মনে মনে বৌদিকে উৎসর্গ করে।কাদম্বরী দেবীকে বেশিদিন না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে।কাদম্বরী দেবীরও তাঁর দেবরের দেখা না পেলে দিন যেন কাটতেই চায়না।রবির সকল কবিতাই সবার আগে কাদম্বরী দেবীকে শোনানো চাই।

২৩ বছর বয়সে রবি যখন ভবতারিণী দেবীকে বিয়ে করে,তখন কাদম্বরী দেবীর কথামত রবি তার স্ত্রীর নাম দেয় মৃণালিণী।বস্তুত বিয়ের পরেও কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবির ভালোবাসা একবিন্দুও কমেনি।কাদম্বরী দেবীর কাছে আসলেই তার অশান্ত মন শান্ত হয়,কবিতা ছন্দ খুঁজে পায়।জ্যোতিরিন্দ্রনাথসহ ঠাকুরবাড়ির সকলেই ততদিনে এই দেবর-বৌদির গভীর বন্ধুত্বের কথা জানলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথে এ ব্যাপারে কোন উক্তি না করায় পানি আর বেশিদূর গড়ায়নি।



জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

কিন্তু অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ভুল বুঝে সন্তানহীন কাদম্বরী রবির বিয়ের এক বছর পরই আত্মহত্যা করেন।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে স্ত্রীকে ভালোবাসতেন না তা নয়,কিন্তু তাঁর সকল ধ্যানধারণা ছিল থিয়েটার নিয়েই।রবির কবিতা শুনে কতদিন,কতরাত শিহরিত হয়েছেন কাদম্বরী দেবী,কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে হয়তো কাদম্বরীর সাথে দেখাও করেননি।রিডিং রুমে বসে গেছেন নাটকের সংলাপ লিখতে,কিংবা সামান্য খাওয়া-দাওয়া করে সারারাতের জন্যে আবার বেরিয়ে গিয়েছেন থিয়েটারের অনুশীলনে।

কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর রবির কাব্য রচনায় ধরনে পরিবর্তন আসে।আগের মতো নিছক ভালোবাসা নয়,ভালোবাসা হারানোর বেদনাও তাঁর কবিতায় এখন স্পষ্ট।কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরেও সে তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করেছে।



রবী ঠাকুর ও মৃণালিনী

এখান থেকেই বলা যায় আমাদের রবীন্দ্রনাথের শুরু।স্মৃতির উপর ধুলো পড়তে বাধ্য,তাই কাদম্বরীর স্মৃতিও একসময় তাঁর মনে ঝাপসা হয়ে এসেছিল।স্ত্রী মৃণালিনীর ঘরে তাঁর প্রথম কন্যা মাধুরীলতার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৬ সালে।একে একে তাঁদের আরও চারটি
সন্তান জন্মগ্রহণ করে,কিন্তু রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের শিশুকালেই মৃত্যু হয়।১৮৯৮ সালে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে পিতার নির্দেশে পরিবার নিয়ে চলে আসেন রবীন্দ্রনাথ,এখানে থেকে জমিদারি দেখাশোনা করেন।পাশাপাশি চলে তাঁর সাহিত্যচর্চার স্বর্ণযুগ।

১৯০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এরপরের কাহিনী আমাদের সবারই জানা।কবিগুরু খ্যাতি পেলেন রবীন্দ্রনাথ,নোবেল পুরষ্কার পেলেন।১৯৩৭ সালে তিনি একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন।তখন মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন,রচনা করেন কিছু অবিস্মরণীয় রচনা।তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে যে অসুখে পড়েন,তা থেকে আর বেঁচে উঠেননি রবীন্দ্রনাথ।মূলত শল্য চিকিৎসার জটিলতার কারণেই ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান।

আমার এই লেখা কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়।আমি শুধু তাঁর পূর্বপুরুষদের একটি Chronicle তুলে ধরতে চেয়েছি।এই সিরিজ ব্লগ পুরোটা পড়লে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন,অনেক লতায়-পাতায় হলেও রবীন্দ্রনাথের এককালীন পূর্বপুরুষ পিরালী ব্রাহ্মণরা আমাদের বাংলাদেশেরই অধিবাসী।আরো গভীরভাবে দেখলে,খান জাহান আলীর বংশধরদের একটি শাখাতেই রবীন্দ্রনাথের জন্ম।এবং খান জাহান আলী ছিলেন আরবের বিখ্যাত সৈয়দ বংশের সন্তান।আবার অন্যদিক থেকে দেখলে রবীন্দ্রনাথের আদি পূর্বপুরুষ পিরল্যা ছিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের বংশধর।পিরল্যার পূর্বপুরুষ আবার ছিলেন রাজা আদিশূর,যিনি আদি হিন্দু ধর্মের অন্যতম রক্ষক।বিপরীত দুই আদি জাতির বংশে এরুপ বিখ্যাত একজন মানুষের জন্মগ্রহণ করার নজির খুব বেশি নেই।যদিও অনেক কাটকাটি করে তবেই ছকটা মেলে,তবু মেলে তো!

তবে ইতিহাস নির্ভুল নয়।আমি শুরুতেই আমার লেখার উৎস জানিয়েছি,কেউ চাইলে আরও জানাবো।কিন্তু ইতিহাসে কিছু ত্রুটি থাকতেই পারে।যেমন-সুকদেব নিজ কন্যাদের কারও সাথে বিয়ে না দিয়ে কেন বোনের সাথে জগন্নাথের কুশারীর বিয়ে দিলেন,তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।এমন অনেক ব্যাপারেই খটকা আছে,থাকবে।কিন্তু বিকল্প যেহেতু নেই,তাই এই কাহিনী সন্তুষ্ট থাকাই বোধহয় শ্রেয়।

লেখার যেকোনো ভুল অবশ্যই আগ্রহের সাথে সংশোধন করব।মন্তব্য করে জানালে খুশি হব।


সবাই ভালো থাকবেন।ধন্যবাদ।
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×