প্রথম পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
তৃতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
চতুর্থ পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
ইংল্যাণ্ডেশ্বরী রাণী ভিক্টোরিয়া, ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স থেকে শুরু করে ডিউক অভ ডেভনশায়ার, ব্রিটিশ আর্মির প্রধান প্রমুখ ব্যক্তির সাথে দিন কাটল দ্বারকানাথের। এঁদের ব্যবহারে তিনি অত্যাশ্চর্য হয়ে গেলেন। স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়া তাঁর সাথে দুবার মধ্যাহ্ন ভোজ সেরেছেন। ইংরেজরা যে সত্যি রাজাত জাত, তা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না।
তিনি আরও বুঝলেন, ভারতে আগত বেশিরভাগ ইংরেজই তৃতীয় শ্রেণীর বণিক ছাড়া কিছুই নয়। তারা ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝেনা। অথচ ইংল্যাণ্ডের লোকেরা কল্পনাও করতে পারবেনা, তাদের জাতভাইরা ভারতীয়দের উপর কতটা বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি আরও অবাক হয়ে দেখলেন, বেশিরভাগ ইংরেজই ভারতবর্ষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা সে দেশের সংস্কৃতিকে তারা মোটেই খাটো করে দেখেনা। এমনকি এক লর্ড তাঁকে কালীপ্রসাদ সম্বন্ধেও জিজ্ঞেস করেছিলেন!
তবে একটা ব্যাপারে দ্বারকানাথ যেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন, তেমনি হতাশ হলেন। বেলগাছিয়ায় তাঁর প্রাসাদটিকে তিনি মনে মনে যে কোনো ইংরেজ ব্যারন, কাউণ্টের বাসভবনের সাথে তুলনা দিতেন, তাঁর সে ধারণা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। রুচির সর্বোত্তম ব্যবহার ইংল্যাণ্ডের বাড়িতে বাড়িতে দেখতে পেলেন। সেখানে অতিশয় জাঁকজমক নেই, কিন্তু সূক্ষ্ণ রুচিবোধের তীব্র প্রকাশ আছে। এক ডিউকের বাসায় তিনি ফায়ারপ্লেস নামক চমৎকার একটি জিনিস দেখলেন, পাপোষ হিসেবে ভালুকছাল ব্যবহার হতে দেখলেন। অনিন্দ্যসুন্দর সব ফুলের বাগানের কাছে তাঁর লক্ষাধিক মুদ্রা ব্যয়ে নির্মিত বাগান তুচ্ছ মনে হল। তিনি পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখলেন,' অর্থ শুধু উপার্জন ও খরচ করিলেই হয়না, তা ব্যবহার করিবার পন্থা জানিতে হয়, রুচির ব্যবহার জানিতে হয়। আমার মন বলিতেছে ইংলণ্ডের উদ্যানগুলিতে ঘুরিয়া অবশিষ্ট জীবন কাটাইয়া দেই। এখানে কোনোরূপ অশান্তি নাই, কলঙ্ক নাই। সবকিছুই অত্যধিক পবিত্র, অত্যধিক স্নিগ্ধ।'
সবচেয়ে চমৎকৃত করল তাঁকে ইংরেজদের নিজ দেশ, নিজ সংস্কৃতির প্রতি গভীর সম্মান। তারা যে কোনো মূল্যে নিজ দেশের আসবাব, গৃহস্থালি ব্যবহার করে। অতি উৎকৃষ্ট সুগন্ধি এখন লণ্ডনেই তৈরী হচ্ছে, তারা আর ভুলেও ফরাসী সুগন্ধি ব্যবহার করেনা। নিজ বাসস্থানের কথা চিন্তা করে লজ্জা হল দ্বারকানাথের। সেখানে হিন্দুস্থানে তৈরী একটাও আসবাব নেই। তিনিতো দেশীয় জিনিস নিজ ঘরে রাখতে লজ্জাই বোধ করেন। এখানে এসে তাঁর বড় একটি ভুল ভাঙল। এছাড়া ট্রেন নামে সদ্য আবিষ্কৃত এক অত্যাশচর্য বস্তু দেখলেন। বিরাট হাঁ-এর মধ্যে কয়লা গলাধঃকরণ এ বস্তু, তারপর যেন চিবিয়ে চিবিয়ে তা থেকে সব শক্তি নিঃসরণ করে বিরাট এক যান টেনে যায়। কয়লা ভক্ষণের তাপে ট্রেনের উপর দিয়ে ধোঁইয়া ভলকে ভলকে বের হয়। 'আমাদের ভারতবর্ষেও তো এই বস্তুকে স্থাপন ক্রয়া যেতে পারে,' ভাবলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি ঠিক করলেন, দেশে গিয়েই বড়লাটকে পত্র মারফত প্রস্তাব পেশ করবেন। কোম্পানী সরকার প্রয়োজনে লক্ষাধিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করবেন।
ইংলিশ নারীদের অবাধ বিচরণ তাঁকে মুগ্ধ করল। পুরুষের পাশাপাশি তারাও সকলে কাজে অংশ নেয়, হাট-বাজারে যায়। পড়াশোনা করে, বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করে। সাহেবদের স্ত্রীগণ অতিশয় মিশুক, তাঁদের আন্তরিকতায় দ্বারকানাথ মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের কন্যারা বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, থিয়েটার নামক অভিনব এক ধরনের নাট্যস্থানে ছেলেদের পাশাপাশি গলা কাঁপিয়ে শেক্সপীয়ার আবৃত্তি করে। সে তুলনায় ভারতের অন্তঃপুরবাসিনীদের কথা চিন্তা করে তিনি আপনমনেই শিউরে উঠলেন।
দেশে ফিরেই তিনি বড়লাট সহ সকল ইংরেজ বড় বড় কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বিরাট এক নৈশভোজের আয়োজন করলেন। দেশীয় পণ্ডিত ও সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও বাদ পড়লেন না। ইংরেজ এবং ভারতীয়দের একই সাথে একই অনুষ্ঠানে দাওয়াত করার ঘটনা সেটিই প্রথম। বিলেত হতে সর্বপ্রথম জীবিত ফেরা মানুষটিকে দেখার উদ্দেশ্যে সকলেই উপস্থিত হল। বড় বড় ইংরেজ কর্মকর্তারা দ্বারকানাথের অভিজ্ঞতার কথা শুনে চোখ কপালে তুললেন। ইংরেজ জাত হয়েও তাঁরা কখনো সরকারী মহলের দেখা পাননি, আর ইনি স্বয়ং ভিক্টোরিয়ার সাথে ভোজ করে এসেছেন! রাণীর সিলমোহরাঙ্কিত বিভিন্ন উপহার দেখেও তারা বিস্ময় প্রকাশ করলেন। দ্বারকানাথের প্রতি ইংরেজদের বেশ সম্ভ্রম জেগে উঠল। বোধকরি শুধু দ্বারকানাথ নয়, সমগ্র ভারতীয়দের প্রতিও তাদের চিন্তা কিঞ্চিৎ হলেও নমনীয় হল।
কিন্তু যখন তিনি বেলগাছিয়ায় আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে শ্যাম্পেন পানের সাথে মৃদু কণ্ঠে খোশগল্পে মত্ত ছিলেন, তখন তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ বেলগাছিয়ার নৈশভোজ থেকে পিতাকে কিছু না বলেই জোড়াসাঁকোয় চলে এসেছেন। বাড়ির উঠোনে একটা আরাম কেদারায় বসে স্থির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দুচোখ বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে যাচ্ছে। পিতার মতোই দীর্ঘ গড়নের তিনি, গৌরবর্ণ, মুখখানিতে প্রবল পৌরষের ঔজ্জ্বল্য। এমন মুখে অশ্রু মানায় না, কিন্তু তিনি নিজেকে কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারছেন না। "জীবন উদ্দেশ্য কী" প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি রাতের পর রাত নির্ঘুম ছিলেন, অতুল বৈভবের মধ্যে থেকেও ছটফট করেছেন। বিষয়সম্পত্তির ঝনঝনানি, পাখির পালকের বিছানা, পারস্যের সর্বোৎকৃষ্ট শিভাস রিগ্যাল, বত্তিচেল্লীর নগ্ন নারীমূর্তি থেকে তাঁকে নক্ষত্রখচিত নীল আকাশ অনেক বেশি আকর্ষণ করে। অজানা কারও উদ্দেশ্যে তিনি দিনের পর দিনের ক্রন্দন করে চলেছেন। তাঁর মুক্তি চাই। রাজকুমার সিদ্ধার্থের মত মুক্তি। তাই বেলগাছিয়ার মদ, সুরা, বাঈজীর কাছ থেকে দূরে সরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে চলেছেন।
মূলত নিজ চোখের সামনে ঠাকুমাকে মৃত্যু করতে দেখার দেখার পর থেকেই দেবেন্দ্রের পরিবর্তন শুরু হয়।
আজ জীবনের সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন দেবেন্দ্র। পিতার সাথে তিনি সরাসরি কথা বলবেন। পার্থিব ধন-সম্পদ, জমিদারী, ব্যবসা ত্যাগ করবেন দেবেন্দ্র।
দ্বারকানাথ চুপ সব শুনলেন। মুখের অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝা না গেলেও তার অন্তর যে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল, তা দেবেন্দ্র বুঝবেন কিভাবে? ছোটকাল থেকে তাঁর বিপুল সম্পত্তি পরিচর্যার জন্যে দেবেন্দ্রনাথকে পর্যাপ্ত শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন তিনি। তরুণ বয়সে ছেলে একটু আনন্দ ফূর্তি করুক তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু এই বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনায় দেবেন্দ্র যাতে কোনো ভুল না করে, সেজন্যে তিনি নিজে তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। ব্যবসা, জমিদারি হাতে-কলমে বুঝিয়েছেন। দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি বিষয়ে দেবেন্দ্রকে শিক্ষা দিয়েছেন। সেই দেবেন্দ্র আজ বলছে তাঁর কিছুই দরকার নেই! তাহলে এই অতুল ঐশ্বর্য, জমিদারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কি হবে? নিজ চেষ্টায় তিনি এতোদূর এসেছেন, মৃত্যুর পর দশ ভূতে তা লুটে-পুটে খাবে? পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ তাঁর অন্যতম ঘৃণার কাজ, আর তাঁর পুত্র তা-ই করতে যাচ্ছে? তাঁর সারাজীবনের কষ্টের কোনোই মূল্য নেই?
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাগে, দুঃখে সারাজীবনের মতো বিলেতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বারকানাথ।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ রাত ৯:০৪